২০২৪-এর লোকসভা নির্বাচন দরজায় কড়া নাড়ছে। বিরোধীরা ইন্ডিয়া জোট তৈরি করে বিজেপির বিরুদ্ধে লড়াইয়ে নামতে বদ্ধপরিকর। তৃণমূল কংগ্রেস নেতৃত্ব প্রথম থেকেই দাবি জানিয়েছে, যেখানে যে শক্তিশালী সে সেখানে লড়াই করুক। এই ফর্মূলাতে ২০২৪-এ ভোট ময়দানে নামতে চলেছে ঘাসফুল শিবির। গত ২০১৯ লোকসভা নির্বাচনে এক ধাক্কায় তৃণমূলে আসন নেমে গিয়েছিল ২২-এ। এবার সেই আসন বৃদ্ধি করতে তৎপর জোড়াফুল।
তৃণমূলের নীতি ও পরিস্থিতি অনুযায়ী একাধিক লোকসভা সাংসদের এবার টিকিট পাওয়ার কোনও সম্ভাবনা নেই বলে মনে করছে সরাজনৈতিক মহল। রাজনৈতিক মহলের মতে, বৃদ্ধতন্ত্র নিয়ে দলের প্রকাশ্য বিদ্রোহ যে একেবারেই লোক দেখানো নয়, লোকসভার প্রার্থী ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গেই তা স্পষ্ট হয়ে যাবে। বর্তমান সাংসদদের প্রার্থীপদ না পাওয়ার তালিকা দীর্ঘ হতে পারে।
বয়স বাড়লে ঘটলে শারীরিক ও মানসিক পরিশ্রম করার শক্তি কমে যায়। তাই নতুনদের জায়গা ছেড়ে দিতে হয়। তা নিয়ে লাগাতার ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন বিধানসভায় তৃণমূলের মুখ্যসচেতক তাপস রায়। উত্তর কলকাতার তৃণমূল সাংসদ সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়কে লক্ষ্য করে তাপস রায়ের এই মন্তব্য শোরগোল ফেলে দিয়েছিল। এমনকী তিনিও সময় হলে রাজনীতি থেকে অবসর নেবেন বলে জানিয়েছিলেন।
সম্প্রতি দলের সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছেন, 'বয়স বাড়লে প্রোডাক্টিভিটি কমে যায়।' আবার তৃণমূলের মুখপাত্র ও রাজ্য সাধারণ সম্পাদক কুণাল ঘোষও বৃদ্ধতন্ত্র নিয়ে সোচ্চার হন। দৃষ্টান্ত দিতে এমনকী খেলোয়াড়দের অবসরের তুলনা টানেন তিনি। রাজনৈতিক মহলের বক্তব্য, তৃণমূলের শীর্ষ নেতৃত্বের অনুমতি ছাড়া এসব মন্তব্য করা সম্ভব নয়। আপাতত পরিবেশ তৈরির পর্যায় চলছে। অর্থাৎ বাজিয়ে নেওয়ার পালা। প্রতিক্রিয়া বোঝার চেষ্টায় দলের শীর্ষ নেতৃত্ব। ২০২৪-এ লোকসভার তালিকায় ফল মিলবে।
তবে অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় সাধারণ সম্পাদক হওয়ার পর যাঁরা তাঁর নেতৃত্ব মানব না, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ই তাঁদের নেত্রী বলে শোরগোল জুড়েছিলেন তাঁরা ইতিমধ্যে যুবরাজের নেতৃত্বে আন্দোলনে সামিল হয়েছেন। ২০২১-এ দায়িত্ব নেওয়ার পর অভিষেকের প্রথম ঘোষণা ছিল 'এক ব্যক্তি এক পদ'। পাশাপাশি যুব শক্তির নেতৃত্ব। ইতিমধ্যে বেশ কিছু ক্ষেত্রে এক ব্যক্তি এক পদ নীতি কার্যকরী হয়েছে। ২৩ নভেম্বর নেতাজি ইন্ডোর স্টেডিয়ামে অভিষেকহীন সাংগঠনিক বৈঠকে খোদ তৃণমূল সুপ্রিমো মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কিন্তু 'এক ব্যক্তি এক পদ'-এর কথা কৌশল করে আপামর নেতৃত্বকে স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। মমতার বক্তব্য ছিল, ইচ্ছে না থাকা সত্ত্বেও তাঁকে দু’টি দায়িত্বে রেখে দিয়েছে দল।
এই নীতির বাইরে কলকাতার মেয়র ও মন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম, মহিলা সাংগঠনিক সভানেত্রী ও মন্ত্রী চন্দ্রিমা ভট্টাচার্য-সহ ব্যতিক্রমী কয়েকজন আছেন। এই নীতিও যে কার্যকরী হতে চলেছে তা নিয়ে কোনও সন্দেহ নেই, মত অভিজ্ঞ মহলের।
২০১৯ লোকসভা নির্বাচন ও পরে উপনির্বাচনে তৃণমূল কংগ্রেসের প্রতীকে জয়ী ১০ জনের বয়স ৬৫ বছরের ওপরে। ৬০ বছরের ওপরে আছেন আরও বেশ কয়েকজন। ৬৫ বছরের ওপরের তালিকায় রয়েছেন- চৌধুরী মোহন জাটুয়া (৮৫), শিশির অধিকারী (৮২), সৌগত রায় (৭৭), শত্রুঘ্ন সিনহা (৭৭), সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায় (৭৫), প্রসূণ বন্দ্যোপাধ্যায় (৬৮), অসিত মাল (৬৮), কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায় (৬৬), মালা রায় (৬৫), সুনীল মণ্ডল (৬৫)।
প্রথম দফায় নিশানায় ছিলেন সাংসদ সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়। তারপর বয়সজনিত বিষয়ে দমদমের সাংসদ সৌগত রায়কে টার্গেট করেছেন কামারহাটির বিধায়ক মদন মিত্র। সৌগত রায়ের বয়স ৭৭ বছর, সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায় ৭৫ বছর। ইতিমধ্যে এবিষয়ে দিল্লিতে প্রতিক্রিয়াও জানিয়ে দিয়েছেন সুদীপ। বলেছেন, ‘আমি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সিদ্ধান্ত এবং অভিমত মেনে চলি। যদি দল এরকম কোনও সিদ্ধান্ত নেয়, তাহলে দলের সকলকেই মেনে চলতে হবে।’
আসানসোলের বিজেপির সাংসদ গায়ক বাবুল সুপ্রিয় পদত্যাগ করার পর ওই কেন্দ্র থেকে জয় পান তৃণমূল প্রার্থী অভিনেতা শত্রুঘ্ন সিনহা। তাঁরও বর্তমান বয়স ৭৭। কাঁথি থেকে তৃণমূলের প্রতীকে জয়ী শিশির অধিকারীর বয়স ৮২। বিজেপি যোগের কারণে তাঁর সাংসদ পদ বাতিলের জন্য লোকসভার অধ্যক্ষকে আবেদন করেছে তৃণমূল। তাঁর মেজ ছেলে শুভেন্দু অধিকারী এখন বিরোধী দলনেতা। নন্দীগ্রামে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে ২০২১ বিধানসভা নির্বাচনে পরাজিত করেছেন।
বর্ধমান পূর্ব লোকসভার সাংসদ সুনীল মণ্ডলের বয়স ৬৫। তিনি ঢাকঢোল পিটিয়ে পদ্মশিবিরে যোগ দিয়েছিলেন, এখন আবার ঘাসফুলে ফিরে এসেছেন। তাঁর বিজেপি ঘুরে আসার বিষয়টা এখনও জোর চর্চায় রয়েছে দলের অন্দর মহলে। ৬১ বছরের ব্যারাকপুরের বিজেপি সাংসদ অর্জুন সিং ক্যামাক স্ট্রিটে অভিষেকের অফিসে গিয়ে তৃণমূল ফিরে গিয়েছেন। অর্জুনের ছেলে পবন সিং ভাটপাড়ার বিজেপি বিধায়ক। বোলপুরের তৃণমূল সাংসদ অসিত মালের বয়স ৬৮ বছর। হাওড়ার তৃণমূল সাংসদ প্রসূন বন্দ্যোপাধ্যায়ও ৬৮। শ্রীরামপুরের সাংসদ কল্যান বন্দ্যোপাধ্যায় ৬৬।
অভিষেক নেতৃত্বে পাওয়ার পর সব থেকে বেশি সোচ্চার ছিলেন কল্যাণ। দক্ষিণ কলকাতার তৃণমূল সাংসদ মালা রায় ৬৫। চৌধুরী মোহন জাটুয়া একসময় কেন্দ্রীয় মন্ত্রী ছিলেন। মথুরাপুরের এই তৃণমূল সাংসদদের বয়স ৮৫ বছর। বারাসাতের কাকলি ঘোষ দস্তিদার ৬৪, মুর্শিদাবাদের আবু তাহের খান চোধুরী ৬২, জঙ্গিপুরের সাংসদ খলিলুর রহমান ৬৩, উলুবেড়িয়ার সাজদা আহমেদ ৬১।
আরও পড়ুন- মহুয়া মৈত্র রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ, নারী হিসেবেই পাশে দাঁড়িয়েছি: বৃন্দা কারাত
তৃণমূল কংগ্রেসের ৯ জন সাংসদ আছেন যাঁদের বয়স ৬০ বছরের নীচে। ৫ জনের বায়স আবার ৪০ বা তার থেকে কম। বসিরহাটের সাংসদ নুসরৎ জাহান রুহি ৩৩, যাদবপুর মিমি চক্রবর্তী ৩৪, ডায়মন্ড হারবারের অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় ৩৬, আরামবাগের সাংসদ অপরূপা পোদ্দার ৩৭, ঘাটালের দেব অধিকারী ৪০, তমলুকের দিব্যেন্দু অধিকারী ৪৬, কৃষ্ণনগরের মহুয়া মৈত্র ৪৯, বোলপুরের শতাব্দী রায় ৫৪, জয়নগরের প্রতিমা মণ্ডল ৫৭। শুভেন্দু অধিকারীর ভাই দিব্যেন্দু অধিকারীকে ব্রাত্য করে রেখেছে তৃণমূল কংগ্রেস। দলের কোনও বৈঠক বা সভায় তাঁকে দেখাও যায়নি দীর্ঘদিন।
রাজনৈতিক মহলের মতে, প্রথম বয়সের ভার, দ্বিতীয়ত বিজেপি যোগ বা ভরসা করতে না পারা বর্তমান সাংসদদের একটা বড় অংশের ২০২৪-এ টিকিট পাওয়ার কোনও সম্ভাবানা নেই। তারপরেও ‘এক ব্যক্তি এক পদ’ নীতি সত্যিই কার্যকরী হলে বাতিল তালিকার সংখ্যা আরও বাড়তে পারে।