বাংলাদেশের দুর্গামণ্ডপ ও হিন্দুমন্দিরে হামলা, হিন্দুদের উপর নির্যাতনের ঘটনায় তোলপাড় বিশ্বের হিন্দুসমাজ। কুমিল্লার আক্রমণের রেশ এখনও পুরোপুরি কাটেনি বাংলাদেশে। জানা গিয়েছে, সোমবারও রংপুরে হামলার ঘটনা ঘটেছে। সেই ঘটনায় ৪০ জনকে গ্রেফতারও করা হয়েছে। অশান্তি মোকাবিলায় বাংলাদেশ বর্ডার গার্ড, সেনা, র্যাব টহলদারি দিচ্ছে। হামলা ঠেকাতে কোথাও কোথাও ১৪৪ ধারা জারি রয়েছে। প্রতিবাদে রাস্তায় মিছিল হয়েছে, পথে নেমেছে সাংস্কৃতিক জগতের লোকজন। কেন এমন ঘটনা ঘটছে? কীভাবে এই হামলা থেকে পরিত্রাণ মিলতে পারে? বাংলাদেশের খ্যাতনামা লেখক তথা মানবাধিকার রক্ষার অন্যতম পুরোধা শাহরিয়ার কবীরের সঙ্গে একান্তে কথা বলেছে দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা। শাহরিয়ার কবীর একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা, বর্তমানে সভাপতি। দেশ জুড়ে সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে কাজ করছে এই কমিটি।
প্রশ্ন: একটা ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র গড়ার শপথ নিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান। তারপরেও হিন্দুদের উপর সন্ত্রাসের ধারা অব্যাহত। কবে শুরু এই মৌলবাদের?
শাহরিয়ার কবীর: একাত্তরের স্বাধীনতা যুদ্ধের কথা মনে রাখতে হবে। অসাম্প্রদায়িক, ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র নির্মাণের জন্য ৩০ লক্ষ হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধরা রক্ত ঝরিয়েছিল। লক্ষ্য ছিল ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র হবে, ধর্মের নামে রাজনীতি হবে না। এই সংকল্প নিয়েই দেশ চলার পথ শুরু হয়েছিল। সব ওলট-পালট হয়ে যায় ১৯৭৫-এ। ৭৫-এ বঙ্গবন্ধু মুজিবর রহমানের হত্যার পরই সাম্প্রদায়িক রাজনীতি, পাকিস্তানপন্থী রাজনীতি শুরু হয়ে যায় বাংলাদেশে। স্বাধীনতা বিরোধী মৌলবাদ পাকিস্তানিপন্থী প্রশাসনে ঢুকে পড়ে। একইসঙ্গে দেশের রাজনীতিতে সাম্প্রদায়িকরণ শুরু হয়ে যায়।
প্রশ্ন: হামলা বন্ধের তো লক্ষণ নেই! এবার বেছে নেওয়া হল দুর্গাপুজোকে?
শাহরিয়ার কবীর: জামাতপন্থীরা ক্ষমতায় থাকলে একরকম হামলা করে, ক্ষমতায় না থাকলে আর একরকম পদ্ধতি অবলম্বন করে। এখনও একদল বাংলাদেশকে পাকিস্থানপন্থী মুসলিম রাষ্ট্র বানাতে চায়। এর বিরুদ্ধে নাগরিক সমাজ লড়াই করছে। এখন দুর্গাপুজো না থাকলে অন্য ভাবে অশান্তি পাকাত। পাকিস্তানের মদতে আফগানিস্থানে তালিবান ক্ষমতায় আসার পর বাংলাদেশেও তালিবানি শক্তি ক্ষমতা প্রদর্শন করতই অন্য কিছু করে। দুর্গাপুজোয় না করতে পারলেও যে ভাবে হোক সোশ্যাল মিডিয়াকে ব্যবহার করে হামলা করার ছক করত।
প্রশ্ন: এর আগেও এই সব ঘটনায় অনেকে গ্রেফতার হয়েছে, তারা ছাড়াও পেয়ে যায়...
শাহরিয়ার কবীর: আমার সঙ্গে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কথা হয়েছে। তাঁরা কড়া ব্যবস্থা নিচ্ছেন বলে আশ্বাস দিয়েছেন। শুনেছি এখনও পর্যন্ত ১৪৩ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তবে গ্রেফতার করলেও অপরাধীর বিচার করা যাচ্ছে না। বিচারপ্রক্রিয়ায় তারা ছাড়া পেয়ে যাচ্ছে। সাক্ষী পাওয়া যাচ্ছে না। ভীত-সন্ত্রস্ত, কেউ সাক্ষ দিতে চাইছে না। সাক্ষী সুরক্ষা আইন কার্যকর করার জন্য আমরা বাংলাদেশ সরকারের কাছে আবেদন করেছি। আইনমন্ত্রীর সঙ্গেও আমার কথা হয়েছে। ধর্ষণের ক্ষেত্রে ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে জবানবন্দি দেবে। তাতেই শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। আইনের বদল খুব জরুরি। জনসচেতনতা বাড়াতে হবে।
প্রশ্ন: কাদের উপর বেশি আক্রমণ হচ্ছে?
শাহরিয়ার কবীর: নিম্নবিত্ত হিন্দুদের উপর বেশি আক্রমণ হচ্ছে। উচ্চবিত্তদের ওপর হয় না। নিম্নবিত্তরা আইন-আদালত করতে সমস্যায় পড়বে। আর্থিক বিষয় রয়েছে। তার উপর ভয়ে সাক্ষী হবে না। অভিযুক্ত সহজে জামিন পেয়ে যাবে। আবার হামলা চালানোর সাহস পেয়ে যাবে। এটাই চলছে।
প্রশ্ন: গ্রেফতার করেও তো কোনও লাভ নেই। আপনারা কী ভাবে প্রতিকার চাইছেন?
শাহরিয়ার কবীর: প্রথমত সাক্ষী সুরক্ষা আইন, সংখ্যালঘু সুরক্ষা আইন ও বিচারের ক্ষমতা-সহ জাতীয় সংখ্যালঘু কমিশন গঠন। অবিলম্বে এই তিনটে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় কার্যকর করতে হবে। এই বিষয়গুলো ২০১৮ সালে নির্বাচনী ইস্তেহারে রেখেছিল আওয়ামি লিগ। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় তার কোনওটাই এখনও কার্যকরী হয়নি। আমরা আশা করছি শীঘ্রই এই তিনটে বিষয় নিয়ে পদক্ষেপ করবে হাসিনা সরকার।
প্রশ্ন: বাংলাদেশে মাটির সংস্কৃতির বদল ঘটে যাচ্ছে...
শাহরিয়ার কবীর: শুধু মৌলবাদী রাজনীতির অনুপ্রবেশ নয়, বাংলাদেশের নানা সামাজিক-সংস্কৃতি বন্ধ হয়ে গিয়েছে। মধ্যপ্রাচ্যের সংস্কৃতি প্রবেশ করছে বাংলাদেশে। সৌদি সংস্কৃতি চলে এসেছে। গ্রামের মেলা, যাত্রা, নববর্ষ-নবান্নের উৎসব বন্ধ। বহু ক্ষেত্রে ভাষা বদলে গিয়েছে। মৌলবাদী রাজনীতি বন্ধ করতেই হবে। এটা মনে রাখা দরকার অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রের জন্য ৩০ লক্ষ মানুষ জীবন দিয়েছে মুক্তিযুদ্ধের সময়। ৭২-এর সংবিধান চাই। আইন পরিবর্তন আশু করণীয়।
প্রশ্ন: পড়াশোনার ক্ষেত্রে কোনও পরিবর্তন প্রয়োজন?
শাহরিয়ার কবীর: পাঠ্যপুস্তকে কোনও সাম্প্রদায়িক বিষয়বস্তু থাকবে না। মাদ্রাসায় শিক্ষা ব্যবস্থা যুগোপযোগী করতে হবে। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস পড়াতে হবে। মাদ্রাসায় জেহাদ শেখানো হচ্ছে। বিধর্মীদের বিরুদ্ধে উসকানি দেওয়া হচ্ছে।
প্রশ্ন: এটা লক্ষ্য করা গিয়েছে বাংলাদেশে অপ্রীতিকর পরিস্থিতিতে সংস্কৃতি জগতের লোকজন বাড়িতে বসে থাকে না, আপনারা কী ধরনের উদ্যোগ নিয়েছেন?
শাহরিয়ার কবীর: প্রথমত সর্বত্র মানববন্ধন, প্রতিরোধ কমিটি ও হিন্দুপাড়ায় সুরক্ষা। এই তিনটে বিষয়ের উপর জোর দেওয়া হয়েছে। একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সারা বাংলাদেশে ১০০ শাখা রয়েছে। এই কমিটির সদস্য়রা সক্রিয় রয়েছেন। ইতিমধ্যে প্রাক্তন বিচারপতি সামসুদ্দিন চৌধুরির নেতৃত্বে উচ্চপর্যায়ের প্রতিনিধি দল গিয়েছিল কুমিল্লায়। কুমিল্লার বিতর্কিত পুজো কমিটির এক কর্তা আমাদের সংগঠনের সদস্য়। সে স্পষ্ট জানিয়েছে কোরানের কথা বলে গুজব ছড়ানো হয়েছিল। ঘটনাটা একটা গভীর ষড়যন্ত্র ছাড়া কিছু না।
প্রশ্ন: রাজনৈতিক দলগুলো কী করছে?
শাহরিয়ার কবীর: ধর্মের নামে রাজনীতি হলে ধর্মের নামে সন্ত্রাসও হবে। ধর্মের নামে রাজনীতি সবার আগে বন্ধ হওয়া দরকার। রাজনৈতিক দিক দিয়ে আওয়ামি লিগেও অনেক কট্টর দক্ষিণপন্থী ঢুকে পড়েছে। অতি সম্প্রতি তারা দলে আস্তানা গেঁড়েছে। তাদের কারও কারও বিরুদ্ধে হামলায় মদত দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। অন্যদিকে জামাত-বিএনপি তো রয়েছেই। কেউ কেউ বলতে চাইছেন শেখ হাসিনা ভারতের এজেন্ট। ভারতের নির্দেশে সরকার চালছে। অতএব এই সরকারকে উৎখাত করতে হবে। এসবও চলছে। আমি তাঁদের বলতে চাই আওয়ামি লিগের কিছু সমস্যা থাকতে পারে তা বলে বিএনপি এলে কি ভাল কিছু হবে?
প্রশ্ন: বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের উপর আক্রমণের প্রভাব পড়েছে ভারতেও, এদেশেও আন্দোলন-প্রতিবাদ শুরু হয়েছে
শাহরিয়ার কবীর: একদেশে সাম্প্রদায়িক অশান্তি হলেও পড়শি ভারতেও তার প্রভাব পড়ে। বাংলার বিজেপি নেতৃত্বও বাংলাদেশের গন্ডগোল নিয়ে নানা উক্তি করেছে। আমাদের দেশের অশান্তি মেটাব আমরাই। ভারতে কিছু হলে সেখানকার প্রশাসন করবে। ১৯৯২-এ বাবরি ধ্বংসের সময় বাংলাদেশে ৩৬০০ মন্দির ভাঙা হয়েছিল। আমাদের বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ধরে রাখতে হবে। মুক্তিযুদ্ধের সময় ঠিক হয়েছিল দেশ কী হবে। সেই ধর্মনিরপেক্ষ, অসাম্প্রদায়িক দেশ গঠন করাই আমাদের মূল উদ্দেশ্য। তার জন্য মানুষকে সচেতন হতে হবে।
ইন্ডিয়ানএক্সপ্রেসবাংলাএখনটেলিগ্রামে, পড়তেথাকুন