Advertisment

Premium: সুবজ পাহাড়ে ঘেরা 'রানিঝর্ণা', অনেক না পাওয়ার মাঝেও 'স্বর্গোদ্যান'-এ 'বিন্দাস' কিস্কুরা

৯০ বছরের ভিটেই যেন স্বর্গ।

author-image
Joyprakash Das
New Update
single family lives in Ranijharna village of Bankura surrounded by hills and forests , অনেক কিছুর মত নেই প্রচারের কোলাহল! জঙ্গল-পাহাড়ঘেরা নির্জনতায় একটি গ্রামে একটিই পরিবারের বাস!

কোনও অভিযোগ নেই, গ্রাম ছেড়ে অন্যত্র যেতে নারাজ এই পরিবারটি। ছবি- শশী ঘোষ

দু'দিকে জঙ্গলের মাঝে চিকন সরু পাথুরে রাস্তা দিয়ে যাওয়ার সময় মনেই হবে না ভিতরে কোনও বাড়ি রয়েছে। প্রায় দু'কিলোমিটার হাঁটতেই এল প্রথমে মাঠ, ডান দিকে পুকুর। তারপরই গরুর হাম্বা হাম্বা ডাক, পাতি হাঁসের প্যাক প্যাক আর মুরগির কুক-কুক-কুক শব্দ কানে এল। দিনের বেলাতেও ঝিঝি পোকার হালকা শব্দ বারে বারে মনে করাচ্ছিল জঙ্গলের নিঝুম পরিবেশ। শোনা যাচ্ছিল পাখির কলতান। আর এই জঙ্গল-পাহাড়ে মানুষের কোলাহলহীন পরিবেশের মাঝেই কালিদাস কিস্কুর পরিবার বাস করছে ৯০ বছর ধরে। একটি পাড়ায় একটিই পরিবারের বাস। স্থানীয় ভাবে রানীঝর্ণা গ্রাম নামেই পরিচিত।

Advertisment
publive-image
অপরূপ রানীঝর্ণা গ্রাম। এক্সপ্রেস ফটো শশী ঘোষ

চারিদিকে পাহাড় আর জঙ্গল। তার মধ্যিখানে রানীঝর্ণা। তবে সব থেকে তাজ্জব বিষয় এই গ্রামে বসবাস করে একটিই পরিবার। কালিদাসবাবুর বাড়িতে বিদ্যুৎ নেই। ১৮ থেকে ২০টা বিদ্যুতের খুঁটি বসাতে হবে। আবেদন করেও সাড়া পাননি। সোলার আলোয় কোনওরকমে রাতে আলো জ্বলে। বাড়িতে টেলিভিশন নেই, ফ্রিজ নেই, নেই ইলক্ট্রিক পাখা। বসত বাড়ি মাটির দোতলা, বড় রান্না ঘর, উঠোন। গভরী নলকূপ আছে যদিও তাতে জল না ওঠায় কুঁয়োর জলই একমাত্র ভরসা। রয়েছে হাতির দল আসার ভয়, বুনো শুয়োরও যখন তখন আক্রমণ করতে পারে। ১৯৩৪ সাল থেকে এখানে বসবাস করছে প্রাথমিক স্কুলের শিক্ষক কালিদাস কিস্কুর পরিবার।  

publive-image
গৃহকর্তা কালিদাস কিস্কু। এক্সপ্রেস ফটো শশী ঘোষ

বাঁকুড়ার খাতড়ার রানীঝর্না গ্রাম। মূল রাস্তা থেকে পাহাড়ী রাস্তা ধরে প্রায় দু'কিলোমিটার গিয়ে পৌঁছানো গেল রানীঝর্নায়। পুকুর, খেলার মাঠ সবই আছে এখানে। বাড়িতে পৌঁছে দেখা মিলল গৃহকর্তা কালিদাস কিস্কুর সঙ্গে। বাড়িতে ছিলেন পরিবারের মেজভাই লক্ষ্মণচন্দ্র কিস্কু। ছোট ভাই রবীন্দ্রনাথ কিস্কু পশ্চিম বর্ধমানের দুর্গাপুরে থাকেন, হাইস্কুলের শিক্ষক। রানীঝর্নায় রানী কে ছিলেন জানা না গেলেও এটা বলাই যায় কালিদাসবাবুর ঠাকুরদা বিপিন কিস্কু এই গ্রামে একাই রাজত্ব শুরু করেছিলেন। তাঁর ছেলে শ্যামাপদ কিস্কুর ছেলে কালিদাস।

publive-image

যে কোনও পর্যটক এই বাড়িতে এলে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যে মোহিত হয়ে যান। চারদিকে বাঁশপাহাড়, রাজপাহাড় এমন নানা পাহাড়। পাহাড়, জঙ্গলই কিস্কু পরিবারকে ঘিরে রেখেছে। প্রাকৃতিক রূপের অপরূপ ছটা ছড়িয়ে রয়েছে। বাড়িতে গরু, হাঁস-মুরগির প্রতিপালনও হচ্ছে। কালিদাস কিস্কু ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস  বাংলাকে বলেন, '১৯৩৪ সাল থেকে ঠাকুরদা এই গ্রামে বসবাস শুরু করেন। তাঁর মামার বাড়ি ছিল একটু দূরের খড়িডুংরি গ্রামে। মামার বাড়িতেই থাকতেন দাদু। ঘুরতে ঘুরতে এখানে এসে হয়তো এমন নির্জন প্রাকৃতিক পরিবেশ তাঁর পছন্দ হয়েছিল। তখন তো জঙ্গল আরও গভীর ছিল।' তিনি বলেন, 'বাড়িতে টিভি, ফ্রিজ, পাখা কিছুই নেই। বিদ্যুতের জন্য আবেদন করেছিলাম। কিন্তু বিদ্যুৎ দফতরের নাকি খরচেই পোষাবে না। কি আর করা যায়, সোলার সিস্টেমের কিছু লাইট আছে। আর একটা বড় সোলার বাতি একবছর আগে বিধায়ক কোটায় বসিয়ে দিয়েছে। দু'বছর আগেও কেরোসিনের হ্যারিকেন, লন্ঠনই আমাদের রাতের অন্ধকারে একমাত্র ভরসা ছিল। গ্যাস নয়, বাড়িতে রান্না করা হয় কাঠের উনুনে। জঙ্গল অধ্যুষিত হওয়ায় কাঠের জ্বালানির কোনও অভাব হয় না। তবে বর্ষায় যাতায়াতের একটু অসুবিধা হয়।'

publive-image
গ্রামে বিদ্যুৎ নেই, বড় সোলার বাতিই ভরসা। এক্সপ্রেস ফটো শশী ঘোষ

একেবারে পাড়া-প্রতিবেশিহীন পাহাড়-জঙ্গলের মাঝে এখানে থাকতে কি কোনও ভয় নেই? 'ভয়ের কোনও ব্যাপারই নেই, 'বলেন কালিদাস। লক্ষ্মণচন্দ্র দাস বলেন, 'কয়েকবার হাতির দল এখানে হানা দিয়েছিল। একবার প্রায় ৪৭টি হাতির দল টানা এক সপ্তাহ বাড়ির পাশেই জঙ্গলে ছিল। বন দফতরের লোকজন ওই  হাতির দলকে তাড়ানোর ব্যবস্থা করে। তাছাড়া বুনো শুয়োর, বনবিড়ালের ভয় আছে।'

কালিদাস কিস্কু বাড়ি থেকে ৬ কিলোমিটার দূরে রাজাডালি শিবরাামপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেন। লক্ষ্মণচন্দ্র কিস্কু জমিতে চাষাবাদের কাজ করেন। বেশিরভাগ সময় বাড়িতেই থাকেন। লক্ষণবাবু বলেন, 'এখন ধানের বীজতলা বসানো হয়েছে। কিন্তু বৃষ্টির তো দেখা নেই। বৃষ্টির ওপরই আমাদের চাষ নির্ভরশীল। পুকুর, জমি বাড়ি সহ ২১ বিঘে জমি রয়েছে। ১০ বিঘে জমিতে চাষ করি। মূলত ধান চাষ হয়।' ধগড়া মুকুটমনিপুর জুনিয়র হাইস্কুলে সপ্তম শ্রেণিতে পড়ছে কালিদাস কিস্কুর দুই সন্তান রামজনম ও রাইমা। ওদের সঙ্গেই পড়ে লক্ষ্মণবাবুর মেয়ে জয়দীপা কিস্কু। সাইকেল নিয়ে পাশের গ্রামের স্কুলে যায় তাঁরা। লক্ষ্মণবাবুর এক ছেলে থাকে দুর্গাপুরে ছোট ভাইয়ের কাছে।

publive-image
কাঠের উনুনেই রান্না হয়। এক্সপ্রেস ফটো শশী ঘোষ

এই পরিবেশেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্য কালিদাস কিস্কুর পরিবার? তিনি জানিয়ে দিলেন, খুবই ভাল লাগে এই পরিবেশ। আমরা একটি পরিবার থাকলেও কোনও ভয় নেই। বরং চারিদিকে পাহাড়-জঙ্গল ঘেরা এমন পরিবেশ ছেড়ে কোথাও যাওয়ার কথা কোনও দিনই ভাবেননি কালিদাসবাবু। অনেকে গ্রাম ছেড়ে শহরে বসবাস করছে, বলছে ছেলেমেয়ের পড়াশুনার জন্য বসতি স্থাপন করেছে। কালিদাসবাবুর কথায়, 'নির্জন এই পাহাড়ী গ্রাম্য পরিবেশে থেকে ছোটভাই হাইস্কুলের শিক্ষক হয়েছে।' প্রাথমিক স্কুলের শিক্ষকের বক্তব্য, 'এখানে থেকে পড়লেও ভাল ফল হবে। শহরে চলে যাওয়ার কথা স্বপ্নেও ভাবতে পারি না। ঝঞ্ঝাট-ঝামেলাহীন সম্পূর্ণ এমন প্রাকৃতিক পরিবেশই তো মানসিক গঠন আরও বৃদ্ধি করবে।'

publive-image
পঞ্চায়েতের প্রচারে এ গ্রামে আসেনি কোনও দলেরই প্রার্থী। এক্সপ্রেস ফটো শশী ঘোষ

রাজ্যের মন্ত্রী ও রানীবাঁধের বিধায়ক জ্যোৎস্না মান্ডি বলেন, 'আমি ওই পাড়াতে গিয়েছিলাম। ওখানে একটি পরিবার বাস করে। ওই পরিবারের জন্য বিধায়ক তহবিল থেকে সোলার সিস্টেমের আলোর ব্যবস্থা করা হয়েছে। আমার খুব ভালো লেগেছে, খুব সুন্দর। ওরা ভাল আছে।'

publive-image
গভীর নলকূপ আছে যদিও তাতে জল না ওঠায় কুঁয়োর জলই একমাত্র ভরসা। এক্সপ্রেস ফটো শশী ঘোষ

'এখানে আছি মাটির টানে। শহরে গিয়ে বসবাস করতে পারব না। এডজাষ্ট করতে পারব না।' সহজ-সরল স্বীকারোক্তি ৫৭ বছরের কালিদাস কিস্কুর।

West Bengal News
Advertisment