Advertisment

বাংলার মফস্বলের পথকুকুর গবেষক শিক্ষক বিশ্বে সমাদৃত, অনাদর দেশের মাটিতে  

পথকুকুরদের নিয়ে নিরলস গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছেন এই শিক্ষক। বিদেশের জার্নালে নিয়মিত আর্টিক্যাল প্রকাশিত হচ্ছে তাঁর।

author-image
Joyprakash Das
New Update
Sunil Pal, a retired teacher in Katwa, is doing research on stray dogs

পথকুকুরদের স্বভাব-আচরণ নিয়ে গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছেন অবসরপ্রাপ্ত এই শিক্ষক।

শিক্ষকতা থেকে অবসর নিয়েছেন ২০১৯-এ। তারপর অবসর জীবনেও পথকুকুরদের স্বভাব-আচরণ নিয়ে চালিয়ে যাচ্ছেন নিরলস গবেষণার কাজ। এই গবেষণা থেকে উপলব্ধ নানা তত্ত্ব-তথ্য নিয়ে আলোচনা করতে ডাক পেয়েছেন বিশ্বের ১০টি দেশে। কাটায়োর ভারতী ভবনের অবসরপ্রাপ্ত প্রাণিবিদ্যার শিক্ষক সুনীল পাল জীবনের বাকি সময়টাও কাটিয়ে দিতে চান অনাথ কুকুরদের নিয়ে গবেষণা করে।

Advertisment

সুনীলবাবুর বড় আক্ষেপ, 'দেশে আমার গবষেণা নিয়ে তেমন উৎসাহ নেই এটাই দুর্ভাগ্যজনক। অথচ বিদেশের জার্নালে নিয়মিত আর্টিক্যাল প্রকাশিত হচ্ছে, বিদেশিরা কাটোয়াতে আসছেন আমার কাছে গবেষণার কাজে তামিল নিতে। আমিও এই কাজের নিরিখেই দেশ-বিদেশ ঘুরে বেড়াচ্ছি। ইতিমধ্যে বিশ্বের দশটি দেশে ঘুরেও এসেছি এই গবেষণাকে কেন্দ্র করেই।'

পূর্ব বর্ধমানের কেতুগ্রামের ভবানীবেড়া গ্রামে বাড়ি সুনীল পালের। এখন থাকেন কাটোয়া শহরের স্টেডিয়াম পাড়ায়। ছোটবেলা থেকেই মালিকহীন রাস্তার কুকুরদের আচরণ নিয়ে কৌতুহল ছিল তাঁর। ১৯৭৫-এ মাধ্যমিক পাশের পর বর্ধমানের রাজকলেজ, তারপর বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রাণিবিদ্যায় স্নাতকোত্তর। ১৯৮৪-তে কাটোয়া ভারতীভবনে শিক্ষকতা শুরু করেন তিনি। কিন্তু মাথায় ভূত চেপেছিল পথকুকুরদের নিয়ে গবেষণার কাজ করার।

১৯৯৫-তে বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ে এই বিষয়ে পিএইচডির কাজ শুরু করেন সুনীলবাবু। এখানে তাঁর গবেষণায় কোনও গাইডও ছিল না। তবে অধ্যাপক ভূদেব ঘোষ ও অধ্যাপক সুব্রত রায়ের তত্ত্বাবধানে তিনি এই কাজ করেছেন। তাঁর পেপার পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছিলেন বিদেশের গবেষক-অধ্যাপকরা। ১৯৯৯-তে তাঁর পিএইচডি সম্পূর্ণ হয়। কিন্তু গবেষণার কাজ থামেনি মফস্বলের এই শিক্ষকের। সুনীলবাবু বলেন, 'আমার বর্ধমান বিশ্বিদ্যালয়ের গবেষণার কাজ দেখে দিয়েছিলেন আমেরিকা ও ইউরোপের লোকজন।'

সুনীল পাল ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলাকে বলেন, 'আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সেমিনারে আমাকে আমন্ত্রণ জানানো হয়। বিদেশ সফর শুরু হয়েছিল ২০০৫-তে জাপান দিয়ে। তারপর আয়ারল্যান্ড, মেক্সিকো, আমেরিকা, স্পেন, অস্ট্রেলিয়া, থাইল্যান্ড, চিনে গিয়েছি। এবার গিয়েছিলাম গ্রিসে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই যাঁরা আয়োজন করে তাঁরা গ্রান্ট দিয়ে নিয়ে যান। এবার আমেরিকার একটি পশুখাদ্য তৈরির সংস্থা আমার আসা-যাওয়া, থাকা-খাওয়া সবই স্পনসর করেছে।'

পথকুকুরদের নিয়ে বেশ কিছু গবেষণালব্ধ তত্ত্বের কথা জানিয়েছেন কাটোয়ার এই ৬৩ বছরের শিক্ষক। সুনীল পাল বলেন, 'এবছর কুকুরের বাচ্চা নিয়ে কাজ করেছি। একটা সময় বিদেশি গবেষকদের একাংশ বলতেন, কুকুরের বাবারা বাচ্চার কেয়ার নেয় না। আমি দেখিয়েছি মায়ের মতো বাবা কুকুররাও বাচ্চা পাহারা দেয় ও তাঁদের খাবারের ব্যবস্থা করে। মা দুপুরের দিকে খাবারের সন্ধানে এক দেড় ঘন্টার জন্য বাইরে যায়। তখন আবার দিদিমা, দিদি, মাসি, বোন বাচ্চাদের যত্ন নেন। অনেকটা আমাদের মতোই, তবে তা মাতৃতান্ত্রিক। একটা সময়ে আমাদের ক্ষেত্রে মামার বাড়িতেও অনেকে মানুষ হত।'

এই স্কুল শিক্ষকের আক্ষেপ, 'গবেষণার জন্য বিশ্ববিদ্যালেয়র প্রফেসররা অনেক সাহায্য পায়। আমি কখনও সাহায্য পাইনি। প্রণব মুখোপাধ্যায় রাষ্ট্রপতি থাকার সময় সাহায্য চেয়ে চিঠি লিখেছি তাতে কিছু হয়নি। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে চিঠি লিখেছিলাম। রাজ্যের ব্যাপার বলে সেই চিঠি এখানে পাঠিয়েছে। কিন্তু কোনও সরকারি সাহায্য পাইনি গবেষণার জন্য। তবে আমি কাজ চালিয়ে যাব। ২০১৮-তে শিক্ষারত্ন দিয়েছে রাজ্য সরকার। সেবছর রামকৃষ্ণ মিশন শিক্ষক বাছাইয়ের দায়িত্বে ছিল।'

আরও পড়ুন- টিটাগড়ে স্কুলে বোমাবাজি, ধৃত ৪ জনের একজন বিদ্যালয়েরই প্রাক্তন ছাত্র

কেন পথকুকুরদের নিয়েই গবেষণা? সুনীলবাবুর কথায়, 'কেতুগ্রামের ভবানীবেড়া গ্রামে ছোটবেলা কেটেছে। গ্রামে রাস্তার কুকুরের আচরণ দেখে আমার মনে কৌতূহল জন্মায়। পরবর্তীকালে প্রাণিবিদ্যায় পড়াশুনা করার সময় সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম পথকুকুরদের নিয়ে গবেষণা করেই জীবনটা কাটিয়ে দেব।'

গবেষণার বিষয়বস্তু বলতে গিয়ে তিনি জানান, অনেক সময় দেখা যায় কুকুর যেখানে জন্মায় যেকটা বেঁচে থাকে তাদের নিয়ে সেখান থেকে অন্য পাড়ায় চলে গিয়েছে মা কুকুর। একটা গাছের অনেক বীজ সেই গাছের তলায় পড়লে একটা গাছও বাঁচবে না। কারণ আলো, বাতাস, পুষ্টি পাবে না। তাই জলে, বাতাসে ছড়িয়ে অন্যত্র সেই বীজ থেকে গাছ জন্মায়। এই ডিসপার্সাল কুকুরের ক্ষেত্রেও হয়। এই গবেষণার কাজ তিনিই প্রথম করেন। নিজেদের অস্তিত্ব বজায় রাখার তাগিদে কুকুররা এটা করে থাকে বলে তিনি জানান। সুনীলবাবু বলেন, ''আগের জায়গায় সংখ্যা বেশি হলে খাবারের অভাব হবে, মেটিং কমপিটিশন হবে। তা এড়ানোর জন্য অন্যত্র বাচ্চা নিয়ে চলে যায় মা কুকুর।''

আরও পড়ুন- দিন কয়েকেই বিরাট বদল আবহাওয়ায়, ফের এক দফায় ঝেঁপে বৃষ্টি জেলায়-জেলায়

তাঁর উপলব্ধি, 'কুকুরকে খাবার দিয়ে মাথার ওপরে হাত দিয়ে আদর করলে যদি লেজ নাড়ে সেই কুকুর সহজে পোষ মানে। তার মানে কখনও সে কামড়াবে না। ১০ বছর পরও মনে রেখে দেবে। ওদের ঘ্রাণশক্তি আমাদের থেকে আড়াইশো গুণ বেশি।' তাঁর মতে, 'বাচ্চা হওয়া ও মেটিং সিজনে এগ্রেসিভ বিয়েভিয়ার বেড়ে যায় কুকুরের। খাবারের দখল নিয়েও তারা নিজেদের মধ্যে মারামারি করে।' এই শিক্ষক গবেষকের মতে, 'কুকুর প্রতিপালন করার সেরা সময় বাচ্চা কুকুরকে সাত সপ্তাহের আগে আনলে হবে না। ১০ সপ্তাহের মধ্যে আনতে হবে। এই সময়ের মধ্যে ট্রেনিং দিলে ভাল অভ্যাস গড়ে উঠবে তা নাহলে বদ অভ্যাস হবে।'

আমেরিকা থেকে ছাত্র-ছাত্রীরা এসেছেন কাটোয়াতে এই শিক্ষকের কাছে। সুইজারল্যান্ড থেকে এক ছাত্রীও এসেছিলেন। একমাস ছিলেন কাটোয়াতে। 'কীভাবে রাস্তার কুকুর নিয়ে স্টাডি করবে তা জানার জন্যই আমার কাছে বিদেশী ছাত্র-ছাত্রীরা আসেন,' বলেন সুনীল পাল। তাঁর আক্ষেপ, 'এদেশে শুধু ইগোর লড়াই। দুর্ভাগ্য দেশে কোনও মর্যাদা নেই। তবে বিদেশীরা আমার গবেষণার সম্মান করছে, এটাই বড় বিষয়।'

West Bengal East Burdwan Stray Dogs Research
Advertisment