বয়সজনিত কারণে রাজনীতি থেকে অবসরের দাবি তুলে হইচই ফেলে দিয়েছেন তৃণমূল কংগ্রেসের প্রবীণ নেতা তথা বিধায়ক তাপস রায়। একসময় ছাত্র আন্দোলনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিলেন। কংগ্রেস থেকে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে তৃণমূলে এসেছিলেন তাপস রায়। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রসংসদ নির্বাচন হওয়া প্রয়োজন বলেই মনে করেন বরানগরের বিধায়ক। পঞ্চায়েত নির্বাচন-সহ নানা বিষয়ে সোজাসাপটা কথা বললেন ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলার প্রতিনিধির সঙ্গে।
প্রশ্ন- ছাত্র রাজনীতির আমূল পরিবর্তন ঘটেছে। বর্তমান প্রজন্মকে কী পরামর্শ দেবেন?
তাপস রায়- পরামর্শ সবসময় দিয়ে থাকি। ওরা তা নেয়ও। কিন্তু, কতটা প্রয়োগ করতে পারে সেটা বলব না। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে শুধু ছাত্রদের ক্ষেত্রে নয়, সর্বক্ষেত্রে বিরাজমান পরিবর্তন। সেক্ষেত্রে ছাত্ররাই ভবিষ্যতের কান্ডারি। তাঁদেরকে সেই ধরনেরই পরামর্শ দিয়ে থাকি। তবে নির্বাচনটা হওয়া উচিত। কোভিডের কারণ-সহ সব মিলিয়ে প্রায় ৫ বছর নির্বাচন বন্ধ। অবিলম্বে ছাত্র ইউনিয়নের নির্বাচনগুলো হওয়া উচিত।
প্রশ্ন- ছাত্র রাজনীতি থেকে উঠে এসেছেন অধিকাংশ নেতৃত্ব….
তাপস রায়- শুধু আমাদের দল নয়, সমস্ত দলেরই রিক্রুটিং সেন্টারটা হচ্ছে স্টুডেন্ট পলিটিক্স। ভালো ভালো ছেলে উঠে এসেছে। এখনও যাঁরা উঠে আসছেন, ছাত্র-যুব থেকেই। তাঁরাই ভবিষ্যৎ।
প্রশ্ন- পঞ্চায়েত নির্বাচনের আগে খুন-জখম বেড়েই চলেছে। এটাকে কী করে আটকানো যাবে?
তাপস রায়- এটাকে আটকানোর জন্য মুখ্যমন্ত্রী বলছেন, আমরাও বলছি। পুলিশ-প্রশাসনকে আরও বেশি সতর্ক হতে হবে। আগাম খবর রাখতে হবে। ইদানিং কালে খবর রাখছে বলে বহু জায়গা থেকে অস্ত্র বা বোমার মশলা উদ্ধার হচ্ছে।
প্রশ্ন- কুকথা তো থামছেই না বঙ্গ রাজনীতিতে।
তাপস রায়- আসলে এদের সামাজিক শিক্ষা ও রাজনৈতিক শিক্ষা দু'টোই নেই। তার ফলে এই সমস্ত অকথা-কুকথা বলে। সস্তার হাততালি সাময়িক কুড়োনোর জন্য এসব বলে থাকে। এটা বাংলার সংস্কৃতি নয়, বাংলার রাজনৈতিক সংস্কৃতিও নয়।
প্রশ্ন- লোকসভায় বিজেপির বিরুদ্ধে আপ, তৃণমূল, বাম-কংগ্রেস সবাই পৃথক ভাবে লড়াইয়ের প্রস্তুতি নিচ্ছে। ভোট ভাগাভাগিতে তো বিজেপিরই ফায়দা?
তাপস রায়- এটা আমি মনে করি না। বহুদলীয় গণতন্ত্রে সকলেই তো লড়বে। এখন কে কার সঙ্গে জোট করবে, কী করবে না, প্রকাশ্যে না গোপনে, সেটা তো আর এখনই বলা যায় না। যখন হবে তখন বা তারপরে বলা যায়। তবে মাল্টি পার্টি সিস্টেমে বিভিন্ন দল তো দাঁড়াবে। এর আগেও তো দাঁড়িয়েছে। সেখান থেকেই তো আমরা বেরিয়ে এসেছি। সুতরাং এগুলো নিয়ে আমরা ভাবিত বা চিন্তিত নই।
প্রশ্ন- শুভেন্দুর ডিসেম্বর বিপ্লব, ডিসেম্বরে কিছু ঘটবে, এবার বলছে বড় ডাকাত বা বড় চোর ধরা পড়বে। এই আগাম বলাটাকে কী ভাবে দেখছেন।
তাপস রায়- এগুলো তো ওরা করেই চলেছে। শুভেন্দু, দিলীপ ও সুকান্ত তিন জনেই করে চলেছে। এটা দেখে মানুষ যেটা বোঝার সেটা বুঝছেন। আগাম বলে দেওয়া। একটা তদন্তসাপেক্ষ বিষয়, আদালতের বিচারাধীন বিষয় আগাম বলে দেওয়াটা ঠিক নয়। আগাম কখনও বলা যায়! তার মানে, যে সমস্ত তদন্ত হচ্ছে সেই তদন্তকারী সংস্থাগুলোকে কি তাঁরা নিয়ন্ত্রণ করছেন?
প্রশ্ন- বয়স হয়ে গেলে রাজনীতিতে কি থাকা উচিত?
তাপস রায়- আগামী প্রজন্মের কথা বলব, এগিয়ে আসতে বলব আর নিজেরা চেয়ার আঁকড়ে ধরে থাকব। এটাতে আমি বিশ্বাসী নই। সেটা আমি নিজে প্রমাণও করব। শুধু বলে নয়। আমার মনে হয় আজ বা কাল হওয়া উচিত, হবেও। তার কারণ হচ্ছে রাজনীতি তো এখন খুবই প্রতিযোগিতামূলক হয়ে গিয়েছে, ফাস্ট। সেক্ষেত্রে সেবা পরিষেবা কেন্দ্র, সাধারণ মানুষ, কর্মীদের সময় দিতে গেলে যে পরিমাণ পরিশ্রমটা করতে হয়, তা বয়স্কদের ক্ষেত্রে শারীরিক ও বয়সজনিত কারণে সম্ভব হয় না। পরিষেবা বা সেবা যদি কোনও রাজনীতিবিদের নিজেরই প্রয়োজন হয়, সেটাও তো বয়সজনিত কারণে, সেটাও তো প্রাকৃতিক। এসব ক্ষেত্রে, তাহলে তাঁদের নিজেদেরই উচিত সরে যাওয়া। এই ব্যাপারে একটা সিদ্ধান্ত নিশ্চয়ই নেবে দল।
প্রশ্ন- সিপিএম জমানায় সায়েন্টিফিক রিগিংয়ের কথা বলা হত। এখনও পঞ্চায়েতে প্রার্থী না-দিতে দেওয়া ও ভোটের দিন সন্ত্রাসের অভিযোগ অব্যাহত। কী বলবেন?
তাপস রায়- এসব আমরা একাধিকবার বলেছি। আমাদের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেকও বলেছেন। অনেক নেতা বলেছেন। আমিও কয়েকবার বলেছি। এবারে ওই সমস্ত কোনও সম্ভাবনা নেই। শান্তিতেই ভোট হবে। মানুষ ভোট দেবেন।
প্রশ্ন- দল ১১ বছর ক্ষমতায় আছে। বিভিন্ন জায়গায় পঞ্চায়েত থেকে পুরসভা, বিধায়ক থেকে সাংসদ তাঁদের এখন গাড়ি-অট্টালিকা, সম্পদ সব হুহু করে বেড়েছে। এই কাটমানির তো অভিযোগ আছেই। আটকানো কি সম্ভব?
তাপস রায়- আটকানোরই তো চেষ্টা চলছে। অনেকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। এবারে মনোনয়ন দেওয়ার ক্ষেত্রে সেই জিনিসগুলো দেখা হবে।
প্রশ্ন- বিজেপির বিরুদ্ধে সার্বিক লড়াই করতে গেলে কী করবেন এই রাজ্যে?
তাপস রায়- একটা তো সাংস্কৃতিক পার্থক্য রয়েছে। তারপরে সাম্প্রদায়িকতা। ওরা কতটা বাঙালি বিদ্বেষী, তা বাংলার মানুষ অনুধাবন করেছেন। শুধু তাই নয়, ভারতীয় রীতিনীতি, সংস্কৃতি, ধর্ম, পরম্পরা এসবের বিরুদ্ধে ওরা। ওরা অন্য কিছু জোর করে চাপিয়ে দিতে চাইছে। সেটাকে সামনে রেখে বিজেপি-বিরোধিতা করছে বাংলার মানুষ।
আরও পড়ুন- Sudip Banerjee on Tapas Roy: তাপস রায়ের বাড়িতে ইডি, শুনেই সাংসদ সুদীপ বললেন…
প্রশ্ন- সিপিএমকে বাংলার মানুষ আর সুযোগ দেবে?
তাপস রায়- ওরা চেষ্টা করছে। মানুষ সময় দিক বা বলপূর্বক ৩৪ বছর বাংলার শাসনে থাকুক তাতে তো মানুষের মোহমুক্ত ঘটেছে সিপিএম থেকে। যার জন্য বিধানসভায় একটাও আসন পায়নি। কংগ্রেসেরও নেই। এই অবস্থা এল কেন, সেটাই এখন ওরা নিজেদের মধ্যে আলোচনা-পর্যালোচনা করুক।
প্রশ্ন- নীচুস্তরে, গ্রামে সমবায় নির্বাচনে কোথাও রাম-বাম জোট হচ্ছে, কোথাও কংগ্রেস-তৃণমূল জোট হচ্ছে। সামনে পঞ্চায়েত ভোট আসছে। তৃণমূল কী করবে?
তাপস রায়- সেটা একেবারে নীচুস্তরে নিয়ন্ত্রণ করা পুরোপুরি কঠিন। তথাপি সেগুলোর চেষ্টা করা হবে। রাম-বাম, লেফট-রাইট কী করে হয়, জানি না। আগে এটা আমরা বলতাম, পরে প্রকাশ্যে দেখা গেল। আমার দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, এই জোটগুলোকে মানুষ ভালোভাবে নেয় না।