Advertisment

শেষমেশ কোলে ফিরল একরত্তি, চুরি যাওয়া শিশু ফিরে পেয়ে পুলিশকে কুর্নিশ মায়ের!

অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে হাসপাতাল থেকে চুরি যাওয়া সদ্যোজাত শিশুকে ফের মায়ের কোলে ফেরাল পুলিশ।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
The police rescued the child who was stolen from North Bengal Medical

শেষমেশ সদ্যোজাত সন্তানকে ফিরে পেলেন মা।

ফের শিশু চুরির অভিযোগ উত্তরবঙ্গ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে। বৃহস্পতিবার ঘটনাটি ঘটার পর অবশেষে শনিবার শিশুটির খোঁজও মিলেছে। তবে যে কায়দায় শিশুটি চুরি করা হয়েছিল তা রীতিমতো চমকে দেওয়ার মতোই। ঘটনার তদন্তে নেমে তিনজনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ।

Advertisment

উত্তরবঙ্গ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের প্রসূতি বিভাগ থেকে শিশুটি চুরি গিয়েছিল। জানা গিয়েছে, খড়িবাড়ি ভোগভিটা এলাকার বাসিন্দা রঞ্জিতা সিং মঙ্গলবার খড়িবাড়ি হাসপাতালে একটি পুত্র সন্তানের জন্ম দেন। সন্তানের জন্মের পর মহিলার শরীরে বেশ কিছু জটিলতা দেখ যায়। সেই কারণে বুধবার রাতে তাঁকে উত্তরবঙ্গ মেডিকেল কলেজে স্থানান্তরিত করা হয়। বৃহস্পতিবার দুপুরে খাবার সময় আচমকাই এক মহিলা রঞ্জিতাকে সাহায্য করতে এগিয়ে আসেন। তিনি রঞ্জিতার সন্তানকে কোলে নেওয়ার আর্জি জানান।

রঞ্জিতাও ভরসা করে তাঁর সন্তানকে ওই মহিলার কোলে দিয়ে হাত ধুতে যান। ফিরে এসে দেখেন তাঁর সন্তানও নেই এবং ওই মহিলাও নেই। ঘটনায় তোলপাড় পড়ে যায় মেডিক্যাল কলেজে। ঘটনাস্থলে পৌঁছোন মেডিক্যাল কলেজের সুপার, ডেপুটি সুপার সহ ফাঁড়ির পুলিশ। প্রত্যেকে সিসিটিভি ক্যামেরা খতিয়ে দেখতে গিয়ে দেখেন কোনও ক্যামেরাই কাজ করছে না। ঘটনার তদন্ত শুরু করে পুলিশ। শিশুটির খোঁজ শুরু হয়।

শেষমেশ চুরি যাওয়া শিশুর খোঁজ মেলে শনিবার বিকেলে। উত্তর দিনাজপুর জেলার চোপড়া থানার বলরামপুর এলাকা থেকে শিশুটিকে উদ্ধার করে শিলিগুড়ি কমিশনারেটের পুলিশ। সেই সঙ্গে গ্রেফতার করা হয় তিনজনকে। ধৃতদের মধ্যে দু'জন পুরুষ আর একজন মহিলা। ধৃতদের নাম প্রদীপ দাস, রাহুল দাস এবং অঞ্জু দাস। রাহুল ও প্রদীপ অঞ্জুর ভাই। অঞ্জুর মা শিখা দাসকে ধরতে পারেনি পুলিশ। তার খোঁজ চলছে। শনিবার রাতেই শিশুটিকে উদ্ধার করে নিয়ে এসে প্রকৃত মায়ের কোলে তুলে দিয়েছে পুলিশ।

publive-image
সদ্যোজাত সন্তান ফিরে পেয়ে আনন্দে আত্মহারা মা। ছবি: সন্দীপ সরকার।

আরও পড়ুন- কালিয়াগঞ্জে কানুনগোরা, NCPCR-এর পদক্ষেপে রেগে আগুন রাজ্য শিশু সুরক্ষা কমিশন

প্রাথমিক তদন্তের পর পুলিশ জানতে পেরেছে চুরির মূল পান্ডা অঞ্জু দাস। তিনি নিঃসন্তান হওয়ার কারণে শিশুটিকে বড় করবেন ভেবেছিলেন। তাঁর বাড়ি থেকেই উদ্ধার হয়েছে শিশুটি। মেডিক্যাল কলেজের প্রসূতি বিভাগ থেকে শিশুটি চুরি করতে সাহায্য করেছিলেন তাঁর মা শিখা।
চুরি যাওয়ার পর পুলিশ তদন্তে নেমে প্রথমেই হোঁচট খায় হাসপাতালের সিসিটিভি ফুটেজ না মেলায়। যদিও হাসপাতালের বাইরের একটি ফুটেজ মিলেছিল। তবে সেই ফুটেজে অপরাধীর মুখ বোঝা যাচ্ছিল না। বাধ্য হয়েই কলকাতা থেকে অপরাধীর ছবি আঁকাতে আনা হয় অপূর্ব ঘোষ নামে এক স্কেচ আর্টিস্টকে। ছবি আঁকা শেষ হওয়ার আগেই চুরি যাওয়া শিশুটিকে উদ্ধার করতে সমর্থ হয় পুলিশ।

তবে মেডিক্যাল কলেজের একটি সিসিটিভি ফুটেজ থেকেই চুরির সূত্র পেয়ে যায় পুলিশ। জানা গিয়েছে, শুক্রবার গভীর রাতে প্রসূতি বিভাগের সিস্টার ইনচার্জ নিজে থেকেই ওয়ার্ডের দু'দিন আগের সিসিটিভি ফুটেজ দেখছিলেন। তখনই তার সন্দেহ হয় দুই মহিলার গতিবিধি দেখে। সেই ফুটেজে দুই মহিলার মুখ স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। মহিলাকে চুরি যাওয়া শিশুটির মায়ের আশপাশে ঘুরতেও দেখা যায় বারংবার। সেই দুই মহিলার পোশাকের সঙ্গে মিলে যায় চুরি করে নিয়ে যাওয়া মহিলার পোশাকের। সঙ্গে সঙ্গে তিনি বিষয়টি পুলিশকে জানান। এরপরই কিছুটা সূত্র পায় পুলিশ।

আরও পড়ুন- জলের দাবিতে বিক্ষোভ ঘিরে তুলকালাম ঘোলায়, বেধড়ক লাঠিচার্জ, নামল RAF

পুলিশ ধৃতদের জিজ্ঞাসাবাদ করে জানতে পেরেছে, বছর ছয়েক আগে বিহারের বাসিন্দা এক যুবকের সঙ্গে বিয়ে হয় চোপড়ার বলরামপুরের বাসিন্দা অঞ্জু দাসের। এত বছর পেরিয়ে গেলেও কিছুতেই তাদের সন্তান হচ্ছিল না। দু'বছর আগে আইভিএফের মাধ্যমে সন্তান ধারনের চেষ্টা করলেও তাতে ব্যর্থ হন। এরপর থেকেই মানসিক অবসাদে ভুগছিলেন তিনি। সন্তান না হওয়ায় তাঁর স্বামীও তাঁকে ছেড়ে দিল্লি চলে গিয়েছেন। তাই অঞ্জুর কোলে কীভাবে একটা সন্তান তুলে দেওয়া যায় সেই পরিকল্পনা করতে থাকেন শিখা দাস। এরপরই তাঁর মাথায় আসে মেডিক্যাল কলেজ থেকে শিশু চুরির।

যেমন ভাবনা তেমন কাজ। গত ১৯ এপ্রিল অঞ্জু দাসের মা শিখা দাস চোপড়া থেকে সোজা চলে আসেন উত্তরবঙ্গ মেডিক্যাল কলেজে। সেখানে পৌছে খোঁজ খবর নিয়ে পৌঁছে যান লেবার ওয়ার্ডে। সেদিন থেকেই ওয়ার্ডে রেইকি করেন শিখা। রাতেও লেবার ওয়ার্ডের বাইরেই রাত কাটান। কখন ডাক্তাররা ওয়ার্ডে রাউন্ডে আসেন, নিরাপত্তারক্ষীরা কীভাবে পাহারা দেয়, কতগুলো শিশু রয়েছে, প্রসূতি মায়েদের পরিবারের নজরদারি, সবটাই নজরে রাখতে থাকেন শিখা। এর পাশাপাশি ভিজিটিং আওয়ারে গিয়ে টার্গেট করেন প্রসূতি রঞ্জিতা সিংহকে। তাঁর সঙ্গে ভাব জমান ওই মহিলা। তাঁর পরিচর্চা, শিশুকে কোলে নেওয়া সব মিলিয়ে রঞ্জিতার কাছে আপন হয়ে ওঠার চেষ্টা করেন তিনি। তাতে 'সফল'ও হন শিখা।

এরপরই ২০ এপ্রিল শিখা দাস ডেকে পাঠান তার মেয়ে অঞ্জুকে। মায়ের ডাক পেয়ে উত্তরবঙ্গ মেডিক্যাল কলেজে চলে আসেন অঞ্জু। এদিনই ১১ টা ২৬ মিনিট নাগাদ রঞ্জিতার নজর এড়িয়ে শিশুটিকে নিয়ে বেড়িয়ে পড়েন মা ও মেয়ে। এমনভাবে মেডিক্যাল থেকে তিনি শিশুটিকে নিয়ে বের হন যাতে কেউ সন্দেহ করতে না পারে। শিখার কাঁধে ব্যাগ আর অঞ্জুর পরনে নাইটি ও গায়ে চাদর ছিল। দু'জনে হাঁটতে হাঁটতে মেডিক্যাল কলেজের বাইরে গিয়ে টোটোয় চেপে বসেন। টোটোতে তাঁরা প্রথমে যান নৌকাঘাট মোড়ে। সেখান থেকে টোটোতে নেমে পরেন দু'জনে। এরপর নৌকা ঘাট মোড় থেকে বাস ধরে শিলিগুড়ি তেনজিং নোরগে বাস টার্মিনাসে যান তাঁরা। বাস টার্মিনাসে নেমে চোপড়া যাওয়ার জন্য বিহারগামী বাসে ওঠেন শিশু সহ দুই মহিলা। দুপুরে চোপড়ায় পৌঁছলে অঞ্জুর দুই ভাই তাদের বাড়ি নিয়ে যান।

আরও পড়ুন- পাহাড়ি এগ্রাম যেন প্রকৃতির নিজের হাতে গড়া! নিরিবিলি এতল্লাটের অবর্ণনীয় শোভা সত্যিই অনবদ্য!

এদিকে প্রসূতি বিভাগের এক নার্সের কাছ থেকে খবর পেয়ে ও টোটো চালককে জিজ্ঞাসাবাদ করে রাস্তায় থাকা সিসি ক্যামেরার ফুটেজ খতিয়ে দেখতে শুরু করে পুলিশ। তেনজিং নোরগে বাস টার্মিনাসের একটি ফুটেজ হাতে আসে পুলিশের। সেখানে দেখা যায় দুই মহিলা বিহারের একটি বাসে উঠেছে। এরপরই পুলিশ সেই বাসের চালকের ফোন নম্বর সংগ্রহ করে যোগাযোগ করেন। চালকের কাছ থেকে জানতে পারেন শিশুসহ দুই মহিলা চোপড়া বাস স্ট্যান্ডে নেমেছেন। বিষয়টি নিশ্চিত হতেই মেডিক্যাল কলেজ কর্তৃপক্ষ ও পুলিশ শিশুটির খোঁজে আশাকর্মীদের কাজে লাগায়।

নির্দেশ পেয়ে আশাকর্মীরাও বাড়ি-বাড়ি খোঁজ শুরু করেন চুরি যাওয়া শিশুর। আশাকর্মীরা খোঁজ শুরু করতেই এক আশাকর্মী পৌঁছোয় অঞ্জুর বাড়িতে। সেখানে তিনি দেখেন অঞ্জু বাচ্চাকে নিয়ে শুয়ে আছেন। বাচ্চার সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করতেই অঞ্জু তাঁকে জানায় আইভিএফ করে শিলিগুড়ির নার্সিংহোম থেকে শিশু এনেছেন। আর এতেই সন্দেহ আরও জোরালো হয় আশাকর্মীর। সেই সময় আর কথা না বাড়িয়ে শিশু ও মায়ের ছবি মোবাইলে তুলে নিয়ে সেই বাড়ি থেকে বেড়িয়ে পরেন তিনি। ছবি পাঠিয়ে দেন পুলিশকে।

নিশ্চিত হওয়ার জন্য সেই ছবি পুলিশ দেখায় শিশুটির মা রঞ্জিতাকে। রঞ্জিতাও চিনে ফেলেন অপরাধীকে। আর দেরি না করে শিলিগুড়ি পুলিশের একটি বিরাট দল শিশু উদ্ধারে চোপড়ার উদ্দেশে বেড়িয়ে পরে। পুলিশের দল অঞ্জুর বাড়িতে গিয়ে দেখেন প্রত্যেকেই গা ঢাকা দিয়েছে। স্থানীয়দের চেষ্টায় পুলিশ অঞ্জুর দুই ভাইকে আটক করে জানতে পারে বাঁশ ঝাড়ের পিছনে শিশুকে নিয়ে লুকিয়ে আছে অঞ্জু। পুলিশ শিশুটিকে উদ্ধার করে তিনজনকেই আটক করলেও মূল অভিযুক্ত অঞ্জুর মা শিখার খোঁজ পায়নি পুলিশ। পুলিশ এদিন রাতেই শিশুটিকে তার প্রকৃত মা রঞ্জিতার কোলে তুলে দিয়েছে।

পুলিশের ভূমিকায় খুশি মেডিক্যাল কলেজ কর্তৃপক্ষ। মেডিক্যাল কলেজের এমএসভিপি ডা: সঞ্জয় মল্লিক বলেন, 'শিশু উদ্ধারে পুলিশ খুব ভাল কাজ করেছে। সকলের আপ্রাণ প্রচেষ্টায় শিশুটিকে মায়ের কোলে ফেরানো সম্ভব হয়েছে।'

police siliguri Missing Child Rescue
Advertisment