মাথার ওপর ছাদ বলে কিছু নেই। বাসস্থান বলতে শুধু রয়েছে শিশু গাছের নীচে ত্রিপলের আচ্ছাদন দেওয়া ঝুপড়ি। সেই ঝুপড়িতে থেকেই
উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার পড়াশুনা চালিয়ে যাচ্ছে পূর্ব বর্ধমানের গলসির ছাত্রী মহুয়া চৌধুরী। ওই ছাত্রী ও তাঁর পরিবারের এমন দুর্দশার কথা স্থানীয় ব্লক প্রশাসন ও পঞ্চায়েত কর্তৃপক্ষ জানে না, এমনটা নয়। কিন্তু, কেউ পাশে না-দাঁড়ানোয় হতাশ ছাত্রী ও তাঁর পরিবার। এমন দুর্দশা থেকে কবে মুক্তি মিলবে, তা-ও জানে না ছাত্রীটি। তবুও উচ্চমাধ্যমিক পাশ করার সংকল্প নিয়ে ওই ঝুপড়ি ঘরে বসেই দিনরাত এক করে সে পড়াশুনা চালিয়ে যাচ্ছে।
অসহায় ওই ছাত্রীর বাড়ি গলসি ১ নম্বর ব্লকের লোয়া রামগোপালপুর পঞ্চায়েতের আটপাড়া গ্রামে। ছাত্রীর বাবা মান্নান চৌধুরী পেশায় দিনমজুর। মা রেখা বেগম সাধারণ গৃহবধূ। এই দম্পতির দুই মেয়ের মধ্যে মহুয়া ছোট। লোকের কাছে সাহায্য চেয়ে দম্পতি তাঁদের বড় মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন। ছাত্রী ও তাঁর পরিবার আগে মাটির দেওয়াল এবং খড়ের চালার বাড়িতে বসবাস করত।
চার বছর আগে আমফানে ভেঙে যায় সেই মাটির বাড়ি। তখন থেকে ওই বাড়ি লাগোয়া একটি শিশু গাছের নীচে ঝুপড়ি ঘরে বাবা-মায়ের সঙ্গেই বসবাস করছে মহুয়া। শীত, গ্রীষ্ম ও বর্ষার বিপদ মাথায় নিয়ে ঝুপড়িতেই দিন কাটিয়ে যাচ্ছে ওই ছাত্রী ও তাঁর পরিবার। লেখাপড়া শিখে নিজের পায়ে দাঁড়ানোর সংকল্প নিয়ে ঝুপড়ির মধ্যে কেরোসিন বাতির আলোতেই চালিয়ে যাচ্ছে পড়াশুনা।
বাবা মান্নান চৌধুরী বলেন, 'আমার রোজগার বলতে দিনমজুরের কাজ। সেটাও সপ্তাহে দু’দিন মেলে তো পাঁচ দিন মেলে না। অনেকদিন হয়ে গেল, একশো দিনের কাজও পাইনি। একশো দিনের কাজটা থাকলে হয়তো হাতে কিছু টাকা-পয়সা আসত।' মান্নান চৌধুরী জানান, বছর চারেক আগে আমফান ঝড়ে তাদের কাঁচা বাড়ি পুরোপুরি নষ্ট হয়ে যায়। সেই থেকে বাড়ি লাগোয়া একটি শিশু গাছের নীচে ত্রিপলের ছাউনি দেওয়া ঝুপড়িতেই তিনি, স্ত্রী-মেয়েকে নিয়ে দিন কাটাচ্ছেন।
ঝুপড়িতে খুবই দুঃখ ও যন্ত্রণার মধ্যেই তাঁদের দিন কাটছে। নিজেদের দুর্দশার কথা লোয়া রামগোপালপুর পঞ্চায়েত ও গলসি ১ নম্বর বিডিও অফিসে গিয়ে বারেবারে জানিয়েছেন মান্নান চৌধুরী। কিন্তু, সুরাহার কোনও ব্যবস্থা আজ অবধি হয়নি। রাজ্য সরকারের কন্যাশ্রী প্রকল্পের ২৫ হাজার টাকা মেয়ে পেলেও সরকারি একটা ঘর আজ অবধি মেলেনি। সরকারি আবাস যোজনার একটা ঘর পেলে হয়তো অনেক উপকার হত বলে তিনি জানান।
ছাত্রীর মা রেখা বেগম বলেন, 'ঝুপড়ির মধ্যে রান্নার কাজ করতে গেলে বিপদ ঘটতে পারে। তাই ঝুপড়ির ঘরের উত্তর কোণে খোলা আকাশের নীচে বসেই উনানে কাঠ জ্বালিয়ে তিন বেলা রান্নার কাজ করেন। বর্ষার দিনে রান্নাবান্না লাটে ওঠে।' আক্ষেপে প্রকাশ করে রেখা বেগম বলেন, 'আমাদের অবস্থা এখন একপ্রকার গোয়ালঘরের গোরু-ছাগলের মত হয়ে গেছে।'
আরও পড়ুন- অনন্য নজির, মেয়ের অনুপ্রেরণায় একসঙ্গে মাধ্যমিকে মা ও ছেলে
এলাকার বাসিন্দা আলাউদ্দিন শেখ বলেন, 'এমন দুর্দশার মধ্যে দিন কাটানো পরিবার গ্রামে আরও আছে। কিন্তু এলাকার জনপ্রতিনিধি, প্রশাসন সব জেনেও যেন কিছুই জানে না। এমন ভান করে রয়েছে। সরকার, প্রশাসন, পঞ্চায়েত বলে কিছু আদৌ আছে নাকি, সেটাও বোঝা যাচ্ছে না।' গলসির বিধায়ক নেপাল ঘোরুইও কোনও দিন এই গ্রামে এসে বাসিন্দাদের দুর্দশার বিষয়ে খোঁজ খবর নেননি। তবে বিধানসভা ভোটের আগে প্রচারে এসে উনি অনেক প্রতিশ্রুতি দিয়ে গিয়েছিলেন। 'ওপরওয়ালা'ই তাই এখন উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার্থী মহুয়া চৌধুরী ও তাঁর পরিবারের ভরসা।
এদিকে উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার্থী ও তাঁর পরিবারের এমন দুর্দশার মধ্যে দিন কাটানোর বিষয়টি নিয়ে তীব্র সমালোচনা করেছেন জেলা বিজেপির সহসভাপতি সৌম্যরাজ বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি বলেন, 'এর পরেও কী করে তৃণমূলের নেতারা দাবি করেন যে রাজ্যে উন্নয়নের জোয়ার বইছে। আমফানে ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য কেন্দ্রের সরকার রাজ্যকে যে কাড়িকাড়ি টাকা পাঠিয়েছিল, তার ছিটেফোঁটাও কি অসহায় ছাত্রীর পরিবার পেয়েছিল?' এই প্রশ্ন তুলেছেন ওই বিজেপি নেতা।
এই বিষয়ে জেলা পরিষদের সহ-সভাধিপতি দেবু টুডু বলেন, 'বিষয়টি আমার জানা নেই। তবে খোঁজ নিয়ে দেখছি। ব্লক প্রশাসনকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দেব।' আর গলসি ১ নম্বর ব্লকের বিডিও দেবলীনা দাস বলেন, 'সভাধিপতি ম্যাডাম আমাকে বিষয়টি জানিয়েছেন। বুধবার মহুয়া চৌধুরীকে বিডিও অফিসে ডেকে নিয়ে কথা বলব। কী ওদের সমস্যা, তা জানব।'