Advertisment

তিনবিঘা করিডোরে ব্রাত্য ভারতীয়রাই?

চুক্তি-পরবর্তী সময়ে এই ভূখণ্ড পর্যটন কেন্দ্রে পরিণত হয়েছিল। প্রতিদিন হাজারো ভারতীয় ওই করিডোর দেখতে যেতেন। এখন আর কেউ ওই মুখো হন না।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
NULL

3Bigha corridor India-Bangladesh border Express Photo Shashi Ghosh

তিনবিঘা করিডোর। যে সরু ভূখণ্ড নিয়ে আশি এবং নব্বইয়ের দশকে তিনজন ভারতীয় আন্দোলনকারীর মৃত্যু হয়েছে। যা আন্তর্জাতিক রাজনীতির ক্ষেত্রেও পরিচিত নাম। যে ভূখণ্ডে আজ বেশ কিছু নাগরিক কার্যত 'নিজভূমে পরবাসী'। তিনবিঘায় পা রেখেই দেখা যায় সাইনবোর্ড, 'ছবি তোলা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ'। কিন্তু এই ভূখন্ডেই বাংলাদেশী নাগরিকরা ছবি তুলছেন, কোনও বাধা নেই বিএসএফের তরফে। এমনকী এই সীমান্তের পাহারাদার সীমান্তরক্ষী বাহিনীর প্যারেডও বন্ধ।

Advertisment

publive-image ভারতীয় পর্যটকের সংখ্যা শূন্যের কোঠায়। ছবি: শশী ঘোষ

ভারতের এই তিনবিঘা করিডোর নিয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে ইন্দিরা গান্ধী-মুজিবুর রহমান চুক্তি সই হয় ১৯৭৪ সালে। দ্বীপের মত বিচ্ছিন্ন বাংলাদেশের আঙ্গড়াপোতা ও দহগ্রাম অঞ্চলকে সেদেশের মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে যুক্ত করে এই করিডোর। অনেক টানাপোড়েনের পর এই দুই ছিটমহল বাংলাদেশের মধ্যেই রয়ে গিয়েছে। সেখানকার বাসিন্দাদের যাতায়াতের পথ তিনবিঘার রাস্তা। ভারতের নাগরিকরা নিজেদের দেশেই যাতায়াত করেন। একেবারে ছোট্ট চৌরাস্তার মোড়। একসময় এই তিনবিঘায় বহু ভারতীয় পর্যটক আসতেন। কিন্তু সেই সংখ্যাটা শূন্যে গিয়ে ঠেকেছে। বরং দিনভর ভিড় থাকে বাংলাদেশের পর্যটকদের।

আন্তর্জাতিক সীমান্ত এলাকা, সেক্ষেত্রে ছবি তোলার ক্ষেত্রে বিধিনেষধ থাকাটা স্বাভাবিক। সেখানে বিএসএফের দায়িত্বপ্রাপ্ত হেড কনস্টেবল রামনিবাসও জানিয়ে দিলেন, "এখানে তো ছবি তোলা নিষেধ আছে।" আবার তিনবিঘার চৌরাস্তায় বাংলাদেশের নাগরিকদের যাতায়াতের পথে পা দিতেও ফের নিষেধাজ্ঞা। আমাদের দেশ, আমাদের মাটিতে দাঁড়াতেও পারব না? কিন্তু বাংলাদেশের নাগরিকদের যাতায়াত দেখে মনে হতেই পারে, কলকাতা শহরের বড়বাজারের সামিল কয়েক ফুট দৈর্ঘ্যের এই রাস্তা। টোটো, স্কুটার, সাইকেল, চোখ ধাঁধানো গাড়ি, মালবাহী যানবাহন ছুটে বেড়াচ্ছে। এমনটাও মনে হতেই পারে, চুক্তির ফলে বোধহয় ভারতীয় এই ভূখণ্ড আর এদেশেই নেই।

publive-image দিনভর ভিড় থাকে বাংলাদেশী পর্যটকদের। ছবি: শশী ঘোষ

ওই ভূখণ্ডের মধ্যেই বাংলাদেশের নাগরিকরা ঘুরে বেড়াচ্ছেন। রীতিমত পোজ দিয়ে ছবি তুলছেন। এক্ষেত্রে কোনও বাধা নেই বিএসএফের পক্ষ থেকে। কেন এই দশা তিনবিঘার? বিএসএফের দায়িত্বপ্রাপ্ত ৪৫ নম্বর ব্যাটালিয়নের ওই হেড কনস্টেবল জানিয়ে দিলেন, ওপরের নির্দেশ। নিজের দেশে পা রাখা যাবে না, এমন নির্দেশ কীভাবে কেউ দিতে পারে? তাঁর স্পষ্ট জবাব, "আমি শুধু নির্দেশ কার্যকরী করতে পারি। এর বেশি কিছু বলতে পারব না।"

এই তিনবিঘা করিডোর বাংলাদেশকে ব্যবহার করতে দেওয়া নিয়ে দীর্ঘ সময় ধরে আন্দোলন হয়েছে। তিনজন আন্দোলনকারীর মৃত্যু হয়েছে। বারেবারে খবরের শিরোনামে এসেছে তিনবিঘা করিডোর। চুক্তি-পরবর্তী সময়ে এই ভূখণ্ড পর্যটন কেন্দ্রে পরিণত হয়েছিল। প্রতিদিন হাজারো ভারতীয় ওই করিডোর দেখতে যেতেন। এখন আর কেউ ওই মুখো হন না। তিনবিঘার পাশে দোকান রয়েছে সুনীল রায়ের। সুনীলবাবুর আক্ষেপ, "এখন আমাদের দেশের পর্যটকরা এখানে কেউ আসেন না। একসময় আমার এই দোকানে ভিড় লেগে থাকতো। এখন যা ভিড় তা ওই দেশের পর্যটকদের। তাঁরা তো আর তিনবিঘার বাইরে বের হতে পারেন না।"

শুধু তাই নয়, বিএসএফের প্যারেডও বন্ধ হয়ে গিয়েছে এখানে। বিগত কয়েক মাস ধরে এই প্যারেড হয় না। আগে বিকেলের এই প্যারেড দেখতেও পর্যটকরা আসতেন এখানে। রামনিবাস জানান, চুক্তি অনুযায়ী বাংলাদেশে দিকের গেট বন্ধ রাখা যায় না। প্যারেড হলে গেট বন্ধ রাখতে হত। তাই প্যারেড বন্ধ রয়েছে। তাহলে আগে কীভাবে প্যারেড হত? এর কোনও জবাব নেই তাঁর কাছে।

১৯৭৪ সালে ইন্দিরা-মুজিব চুক্তি অনুযায়ী তিনবিঘা দিয়ে যাতায়াতের সুযোগ পেয়েছিলেন বাংলাদেশের নাগরিকরা। তিনবিঘা সংগ্রাম কমিটির সম্পাদক ছিলেন পরেশ অধিকারী। তিনি জানান, ১৯৮১ তে সুধীর রায় জমি জরিপ সংক্রান্ত আন্দোলন চলাকালীন পুলিশের গুলিতে প্রাণ হারান। ১৯৯২ সালে মারা যান ক্ষীতেন অধিকারী ও জীতেন রায়। তিনবিঘার ৯৯৯ বছরের লিজের প্রতিবাদ করতে গিয়ে এঁদের মৃত্যু হয়।

বাংলাদেশের কুজারবাজারে বাড়ি মহম্মদ হোসেনের। ভাই হাসান আলি থাকেন দহগ্রামে। সাইকেলে চড়ে পাঁচ কিলোমিটার দূরে ভাইকে খবর দিতে এসেছেন বাড়িতে আত্মীয় এসেছেন বলে। এই করিডোর ব্যবহার করেই তাঁদের নিত্য যাতায়াত। হোসেন জানান, "আগে এক ঘণ্টা অন্তর এই গেট খোলা থাকত। এখন ২৪ ঘণ্টা খোলা থাকে। তাই সবসময় যাতায়াত করতে পারি।" ভারত সরকারকে বিশেষভাবে ধন্যবাদ দিতে ভুললেন না হোসেন। ওই বাংলাদেশী নাগরিকরা হয়ত জানেন না, নিজের দেশে ভারতের অধিবাসীদের কত বিধিনিষেধ পালন করতে হয়।

publive-image তিনবিঘার অদূরেই কোচবিহারের মেখলিগঞ্জ। ছবি: শশী ঘোষ

দহগ্রাম-আংড়াপোতা ছিটমহল নামেই পরিচিত। বাংলাদেশের ওই ছিটমহল লালমনিরহাটের পাটগ্রাম উপজেলার অধীন। এর চারদিকেই ভারতীয় ভূখন্ড। একমাত্র এই তিনবিঘা করিডোরের সরু পথ দিয়েই বাংলাদেশের মনিরহাট, পাটগ্রামের সঙ্গে যোগাযোগ রাখেন এখানকার প্রায় ২৫,০০০ বাসিন্দা। আয়তনের পরিমাপ অনুযায়ী এর নাম তিনবিঘা।

শুরুতে দুঘণ্টা পর পর এক ঘণ্টা খোলা থাকত গেট। তারপর এক ঘণ্টা পর এক ঘণ্টা খোলা থাকত। ২০০১ থেকে সকাল ছটা থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ১২ ঘণ্টা খোলা থাকত তিনবিঘার গেট। ২০১১ থেকে ২৪ ঘণ্টা খোলা থাকে গেট। ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং ৬ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে বৈঠকে বসার পর ওই ঘোষণা করা হয়।

Bangladesh
Advertisment