প্রথমে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, তার কয়েক ঘন্টা পর অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। মুখ্যমন্ত্রী বললেন, ''পুলিশ ইচ্ছে করলে গুলি চালাতে পারত। সংযমের পরিচয় দিয়েছে।'' পরক্ষণেই মঙ্গলবারের ঘটনায় পুলিশের সংযমের কথা বললেও, তৃণমূলের সাধারণ সম্পাদকের ঘোষণা, 'আমার সামনে এমন আক্রমণের ঘটনা ঘটলে (নিজের কপাল দেখিয়ে বলেন) মাথার ওপর গুলি করতাম।' গুলি চালানোর মন্তব্য নিয়েই তোলপাড় বঙ্গ রাজনীতি। বাম আমলের ইতিহাস ফিরে দেখার কথা বলছে রাজনৈতিক মহল।
বাম আমলের ২১ জুলাই পুলিশের গুলিতে মৃত্যু হয়েছিল ১৩ জন যুব কংগ্রেস কর্মীর। সেই দিনটা পরবর্তীতে শহিদ দিবস হিসাবে স্মরণ করে তৃণমূল কংগ্রেস। এই দিনটা তৃণমূলের কাছে ঐতিহাসিক দিন। বার্ষিক এই বড় সমাবেশে দলের কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়। তারপর বাম আমলেই নন্দীগ্রামে পুলিশের গুলি চালনা। তখন গর্জে উঠেছিলেন রাজ্যপাল থেকে বিদ্বজনেরা। এসবের প্রতিবাদ করেই সংগঠন মজবুত করেছে তৃণমূল কংগ্রেস। রাজ্যের মানুষের সমর্থন পেয়েছিলেন তৃণমূলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
মানবিক আন্দোলনেই নজর কেড়েছিল ঘাসফুল শিবির। সেই দলের দুই শীর্ষ নেতার গুলি চালানোর মন্তব্যে হকচকিয়ে গিয়েছেন রাজনৈতিক মহল। অভিজ্ঞ মহলের মতে, যদিও মুখ্যমন্ত্রী কিছুটা রাখঢাক করেই গুলি চালাতে পারত বলে অভিমত প্রকাশ করেছেন, কিন্তু দলের সাধারণ সম্পাদক বলে দিয়েছেন তিনি হলে মাথায় গুলি করতেন। অভিজ্ঞমহলের মতে, এই 'আলটপকা' মন্তব্যে শোরগোল পড়ে গিয়েছে।
আইন-অমান্য আন্দোলনে পুলিশকে লক্ষ্য করে ইঁট বৃষ্টিও নতুন নয়, তা কাম্য হোক বা না হোক। আবার পুলিশের লাঠিচার্জ, কাঁদানে গ্যাসের সেল ফাটানো বা জলকামান ব্যবহার করাও অত্যন্ত স্বাভাবিক ঘটনা। অনেক ক্ষেত্রে বিক্ষোভ দমাতে পুলিশ রাবার বুলেট ব্যবহার করে। রাজনৈতিক মহলের মতে, প্রাণহানি কোনও ক্ষেত্রেই বাঞ্ছনীয় নয়। তবে রাবার বুলেট ব্যবহার করতেই পারে। আইন অমান্য আন্দোলন বা বিক্ষোভে সামলাতে রাবার বুলেট ব্যবহার করলেও অন্তত প্রাণহানির মতো ঘটনা ঘটবে না বলেই অভিমত রাজনৈতিক মহলের। নবান্ন অভিযানে কলকাতা পুলিশের এসিপি দেবজিৎ চট্টোপাধ্যায়কে একা পেয়ে তাঁকে বেধরক মারধর করে আন্দোলনকারী বিজেপি কর্মী-সমর্থকরা। সেই প্রেক্ষিতেই তৃণমূলের যুবরাজ মাথায় গুলি চালনার কথা বলেছেন। তাতেই বিজেপি রাজ্য সভাপতি কটাক্ষ করেছেন, ট্রিগার হ্যাপি পুলিশ।
আরও পড়ুন- রাজ্যে ৬০০ কোটির বিনিয়োগ টাটা গোষ্ঠীর, খড়গপুরে নয়া ইউনিটের উদ্বোধন মুখ্যমন্ত্রীর
পুলিশ রেগুলেশনস বেঙ্গল ১৯৪৩-এ ১৫৪, ১৫৫, ১৫৬, ১৫৭-তে পুলিশের গুলিচালনা সংক্রান্ত বিষয়ের উল্লেখ রয়েছে। নিয়ন্ত্রিত ভাবে গুলি চালনা, বেশি আঘাত না করা, মিনিয়াম ইনজুরির কথা উল্লেখ আছে সেখানে। লক্ষ্য, গুলি করার রাউন্ড নির্দিষ্ট করে দিতে হবে। ম্যাজেস্ট্রেট থাকতে হবে তা নাহলে প্রয়োজনে সংশ্লিষ্ট আধিকারিক নিজে দায়িত্ব নিয়ে আদেশ দিতে পারেন। এমন ভাবে গুলি চালনার নির্দেশ দেবেন যেন তাৎক্ষণিক ভাবে ন্যূনতম ক্ষতি হয়। গুলি যেন কোনও নিরপরাধ ব্যক্তির ক্ষতির কারণ না হয়। এই গুলি চালনার তদন্ত করবেন ম্যাজিস্ট্রেট পর্যায়ের আধিকারিক। এমন নানা নিয়ন্ত্রণের কথা উল্লেখ রয়েছে সেখানে। অভিজ্ঞমহলের মতে, গুলি চালনার ক্ষেত্রে চরম সতর্কতা রয়েছে পুলিশ রেগুলেশন বেঙ্গল ১৯৪৩-তে।
আরও পড়ুন- দিলীপের প্রশংসায় কুণাল! নাম না করে বিরোধী দলনেতাকে ‘বীভৎস’ আক্রমণ
উত্তর দিনাজপুরের দাড়িভিটে ২০১৮-এর সেপ্টেম্বরে স্কুলে বিক্ষোভ চলাকালীন পুলিশের গুলিতে দুই ছাত্রের মৃত্যু হয়েছিল বলে অভিযোগ উঠেছিল। পুলিশের গুলিতে মৃত্যুর অভিযোগ যদিও রাজ্য সরকার অস্বীকার করেছিল। ওই অভিযোগ অস্বীকার করে তখন ইসলামপুরে তৃণমূল কংগ্রেসও সভা করেছিল। এখনও জানা যায়নি সেদিন কে গুলি করেছিল। পরের বছর ২০১৯ লোকসভার ভোটে ওই গুলি চালনার ঘটনার স্থানীয়স্তরে ব্যাপক প্রভাবও পড়েছিল। রায়গঞ্জ লোকসভায় জয় পেয়েছিল বিজেপি। দুজনের মৃতদেহ এখনও স্থানীয় নদীর পাশেই কবরস্থ হয়ে রয়েছে। পরিবারের সদস্যরা এখনও সিবিআই তদন্তের অপেক্ষায় দিন কাটাচ্ছে। এক স্কুলে পুলিশের গুলিতে মৃত্যুর অভিযোগে স্থানীয় রাজনৈতিক দৃশ্যপটের বদল ঘটে গিয়েছিল এই তৃণমূলের আমলেই।
আরও পড়ুন- ডায়মন্ডহারবার মডেলেই চার তৃণমূল নেতার সম্পত্তির পাহাড়, ভয়ঙ্কর অভিযোগ শুভেন্দুর
রাজনৈতিক মহলের বক্তব্য, গুলি চালানোর মন্তব্যে আখেরে কখনও শাসকদলের লাভ হয় না। সাময়িক ভাবে দল বা পুলিশ চার্জড হলেও বিরোধীরা সেই মন্তব্যের সুযোগ নেবে এটাই স্বাভাবিক। তৃণমূল কংগ্রেস বাম আমলে পুলিশের গুলি চালনার বিরুদ্ধে আন্দোলনে ঝড় তুলেছিল, তৎকালীন সরকারের অমানবিক পদক্ষেপ তুলে ধরেই সাফল্য এসেছিল ঘাসফুল শিবিরের।