Valentine's Day Special: কবিগুরু এভাবেই তাঁর কবিতায় অনন্ত প্রেমের ছটা ছড়িয়ে ছিলেন। এই বাংলায় এখনও প্রেম আছে, ভালোবাসা আছে, মনের মিলনও আছে। আমরা হাজির হয়েছিলাম দুই দৃষ্টিহীন যুগলের অনন্য প্রেম কাহিনী জানতে। একজনের কাঁধে অপরজনের ভার নেওয়ার অনুভূতি বুঝিয়ে দিচ্ছে এ প্রেমও যুগযুগান্তরের। একজন অপরজনের পরিপূরক। একে অপরকে না দেখেই প্রেমের স্রোতে ভেসেছে বছরের পর বছর।
মুর্শিদাবাদের (Musrshidabad) বহরমপুরে (Berhampore) বাড়ি মহম্মদ নীল বক্সের। জীবন-জীবিকার টানে বাড়ি থেকে ২০০ কিলোমিটার দূর থেকে এসেছেন এই তিলোত্তমা শহরে। ট্রেনিংয়ে এসে খুঁজে পেয়েছেন মনের মানুষকে। তাঁর সাড়া পেতে হাল ছাড়েনি। দক্ষিণ ২৪ পরগণার মগরাহাটে (Magrahat) বাড়ি আসমিনার। প্রথমে কিছুটা নিমরাজি হলেও প্রেমের সাগরে ভাসতে মন উজাড় করে দিয়েছেন নীল বক্সকে। হৃদয়ের দৃষ্টি থেকেই একে অপরকে দেখেছেন। মনে মনে ছবি এঁকেছেন। টানা তিন বছর চুটিয়ে প্রেমে মেতেছেন নীল ও আসমিনা। তারপর চারহাত এক। তবে প্রথমে ছেলের বাড়ি মানতে চায়নি। এখন অবশ্য এক সন্তানকে নিয়ে সুখে দিন কাটছে তাঁদের। কিন্তু এখনও প্রেমের আবেগে টান পড়েনি। গানে গানে একে অপরকে প্রেম নিবেদনে করেন অনায়াসে। ১৪ ফেব্রুয়ারির কাহিনিও আলবাত জানেন এই জুটি।
ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলাকে আসমিনা বলেন, 'কবরডাঙার প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে বিভিন্ন ধরনের কাজ শেখানো হত। আমার এক বন্ধু ওকে আমার ফোন নম্বর দিয়েছিল। হঠাৎ ফোন এসেছে। আমার বন্ধু ওকে ফোন ধরিয়ে দেয়। আমি প্রথমে একটু বিরক্তি হই। তারপর ওকে ফোনটা দেয়। বলে আমি নীল বক্স বলছি। একটু কথা বলে ফোনটা কেটে দিই। আবার ফোন করে। আমি বলি বারবার ফোন করছেন কেন? নীল বলে, আপনাকে আমার ভাল লেগেছে। আমি চিনলাম না, একবার কথা বললেন তাতেই ভাল লেগে গেল। তখন নীল বলে, আপনার গলায় স্বরটাই পছন্দ।' নীল গ্র্যাজুয়েট। আমি জানিয়ে দিয়েছিলাম, 'আমি পড়াশোনা জানি না। একেবারে ঘরোয়া মেয়ে। তখন বলে, সব শুনেছি। আমার কি পছন্দ জানতে চায়। আমি জানিয়ে দি ভাবতে দিন। প্রথম দিন ৫ বার ফোন করেছি। আমি জানাই, দেখা করে তারপর বলব। দেখা করব বলে চলে যাই ট্রেনিং সেন্টারে। আমি জিজ্ঞেস করলাম আপনার লাইফ পার্টনার আছে? আমারও নীলের গলার স্বর ভাল লাগে। ২০১৩-তে আমরা বিয়ে করি। এখনও সংসার চালাতে কষ্ট হলেও মনের দিক থেকে আমরা একইরকম আছি।'
এই সম্পর্কের শুরু থেকে এখনও বেজায় খুশি বছর ৩৫-এর নীল বক্স। তাঁর কথায়, 'ছোট থেকে বাইরে বাইরে আছি। প্রথমে আমি রামপুরহাটে (Rampurhat) পড়েছি। তারপর বেহালা ব্লাইন্ড স্কুলে (Behala Blind School)। নরেন্দ্রপুর রামকৃষ্ণ আশ্রমেও (Ramakrishna Mission Ashrama, Narendrapur) ট্রেনিং নিয়েছি। তারপর গোবরডাঙা। পরিচয়ের প্রথম তিন বছর আমাদের ব্যাপক কেটেছে।' নীল বক্সের কথায় ঘাড় নাড়ে মেয়েটি। আমিও ওর দিদিকে বলে দিয়েছিলাম, 'আমি ওকেই বিয়ে করব। বলেছিল, মা মেনে নেবে না। তখন বলেছি, 'অসুবিধা নেই। কথায় আছে, মিঁয়া-বিবি রাজি তো কেয়া করেগা কাজি।"
তবে আর্থিক সমস্যার জন্যই একটু অশান্তি হয় বলে জানায় আসমিনা বিবি। তবে রাগ হলেও দাদার কোনও রাগ নেই। মাঝে মধ্যে আসমিনার মান ভাঙাতে নীল কবিতাও শোনান। 'ম্যায় তুঝে ছোড়কে কাহা যায়ুঙ্গা'----- গান ধরলেন নীল বক্স। পাল্টা গান ধরলেন ডায়মন্ড হারবারের আসমিনা। সংসারের চরম আর্থিক সঙ্কটেও কিন্তু নীল ও আসমিনার প্রেম অটুট। কেউ কাউকে না দেখে শুধু গলার স্বরেই দুজন দুজনকে একাত্ম করে রেখেছেন। তাঁদের সমুদ্রের প্রকৃতি বারে বারে টানে। নীল বক্সের কথায়, 'প্রেম তো অন্ধই। আমাদের কাছে প্রেম মধুময়। প্রেম না থাকলে মানুষ বাঁচতোই না। মনের আকর্ষণই সব।'
দক্ষিণ ২৪ পরগণার মন্টু পাঠক ও দক্ষিণ বারাসতের অনিমার এখনও অতীতের প্রতিটি কথা মনের কোণে জমা রেখেছেন। মাঝেরহাটে (Majherhat) প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে যাতায়াতেই দুজনের পরিচয় ৩০ বছর আগে। অন্যদের মতো মন্টুকে হাত ধরে ট্রেনের সিটে বসিয়ে দিতেন অনিমা। সেই থেকে দুজনের মনের কাছাকাছি আসা। অনিমা যদিও তখন দেখতে পেত, মন্টু দৃষ্টিহীন ছিল। তবে এখন অনিমাও দেখতে পায়নি। মন্টুর কথায়, 'আমাদের মধ্যে মারামারি-কাটকাটি হয়, আবার মিলমিশও হয়ে যায়। ১৯৯৫ সালের ৩১ জুলাই বিয়ে হয়। বিয়ের আগে ট্রেনে কথাবার্তা হত। যেতে-আসেত অনিমা ধরে ধরে নিয়ে যেত। ক্লাসের সময়ও কথাবার্তা হত। লুকিয়ে চুরিয়ে কথা হত।' ভ্যালেন্টাইন ডে-র (Valentines Day) কথাও জানেন মন্টু। ভ্যালেন্টাইন ডে শুধু নয় রোজ ডে, চকোলেট ডে-র (Chocolate Day) কথাও জানেন। তিনি বলেন, 'এসব শুনি রেডিওতে। তবে এসব বাহ্যিক বলে মনে করেন মন্টু ও অনিমা। তাঁদের কথায়, 'সবই অন্তরের টান।'
অনিমার কথায়, 'রাতে দেখতে পেতাম না। চাঁদের আলোয় দেখতে পেতাম। অনেক ডাক্তার দেখিয়েছি। এখন একেবারে দেখতে পাই না। তবে ওকে আমি দেখেছি। তখন বেশ দেখতে পেতাম। কথাবার্তা বললে ভয় কাজ করত। শাশুড়ি মায়ের পছন্দ হয়। আমার বোনের ননদকে বলে। তারপর বিয়ের পাকা কথা হয়।' মন্টু তবলা সঙ্গত করে। কখনও কখনও অনুষ্ঠানে গান করে। তাতে সংসার না চললেও চালিয়ে নিতে হয়, বলেন অনিমা। মন্টুর কথায়, 'অনিমা সঙ্গে না থাকলে অসহায় লাগে।' তবে এতগুলি বছর পেরিয়ে গেলেও প্রেমের রং যে ফ্যাকাসে হয়নি, ও কেন এত সুন্দরী… গানের মাধ্যমে প্রকাশ করতে দ্বিধা করল না মন্টু।
আরও পড়ুন- Digha: বেড়ানোর দুরন্ত অভিজ্ঞতা হবে দিঘায়! পর্যটকদের জন্যই অভূতপূর্ব এই উদ্যোগ
নীল-আসমিনা বা মন্টু-অনিমারা মনেই আঁকেন প্রেমের রঙ। স্বরেই দেখে ফেলেন একে অপরকে। একজন অন্যজনকে না দেখেও প্রেমের সাগরে ডুবে থাকতে পারেন অনায়াসে। হ্যা, চরম আর্থিক অনটন সত্ত্বেও।