ছাত্র আন্দোলনে হুলস্থূল কবিগুরুর বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে। টানা অবস্থান মঞ্চ, মঞ্চ ভেঙে দেওয়ার অভিযোগ, উপাচার্যের পদত্যাগ দাবি, বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজকর্মে ব্যাঘাত। এভাবেই দিন কাটছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রতিষ্ঠিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের। আন্তর্জাতিক সম্মানে সমৃদ্ধ এই বিশ্ববিদ্যালয়ে কেন এই ছাত্র আন্দোলন, কী বলছেন উপাচার্য?
উপাচার্য বিদ্যুৎ চক্রবর্তীর বাড়ির কিছুটা দূরেই সভামঞ্চ করে অবস্থান করে আসছিলেন আন্দোলনকারীরা। এই মঞ্চকে ঘিরেই নানান কান্ড এই মূহূর্তে। কেন এই আন্দোলন? অবস্থান-আন্দোলনের নেত্রী মীনাক্ষী ভট্টাচার্য বলেন, 'আমাদের একাধিক দাবি আছে, দ্রুত রেজাল্ট প্রকাশ করা, স্কলারশিপ, হস্টেলের খালি সিটগুলো ফিলাপ করা, বিশ্বভারতীতে যে অরাজকতা চলছে তা বন্ধ করা। এখানে দেখছি উপাচার্যের বিরোধিতার স্বর যাঁদের তাঁদের বেছে বেছে চিহ্নিত করে শিক্ষক, কর্মী বা ছাত্র হোক হেনস্থা করা হচ্ছে। যত দিন পর্যন্ত আমি আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিলাম না ততদিন আমার কোনও সমস্যা ছিল না। আমাকে একবার শোকজ, একবার হেড অব দ্যা ডিপার্টমেন্টকে দিয়ে সিবিআইয়ের নামে ভয় দেখিয়ে চিঠি, পরবর্তীতে রিসার্চে যখন প্রিসাবমিশন আবেদন করি সেটাকে নানা বানান ভুল দেখিয়ে দেরি করা হচ্ছে।'
বিশ্ববিদ্যালয়ের অরাজকতার জন্য উপাচার্যকে দায়ী করছেন আন্দোলনকারীরা। মীনাক্ষী বলেন, 'আমরা প্রধানমন্ত্রী, কেন্দ্রীয় শিক্ষামন্ত্রী সহ বিভিন্ন জায়গায় চিঠি পাঠিয়েছি। যদি উনি আশ্রমের পরিবেশের সঙ্গে মানিয়ে নিতে না পারেন ছাত্রছাত্রীদের বেছে বেছে ক্ষতি করতে চান তাহলে এমন মানসিকতার লোককে এখানে প্রয়োজন নেই।' আরেক আন্দোলনকারী সোমনাথ সৌ-এর ভর্তি হওয়া নিয়েও চলছে বিতর্ক। তাঁর ভর্তি নিয়ে আপত্তি জানিয়েছে এক্সিকিউটিভ কমিটি।
সোমনাথ সৌয়ের বক্তব্য, 'আমি ইকোনমিকসের স্টুডেন্ট, প্রথমত আমি মাস্টার্সের জন্য আবেদন করি। ইন্টারনাল হিসাবে ভর্তি হতে পারব, এটাই স্বাভাবিক নিয়ম। সোশাল ওয়ার্ক ও রুরাল ম্যানেজমেন্টে অ্যাডমিশন চেষ্ট দিয়েছি। আমাকে জনানো হল হঠাৎ করে আমার বিরুদ্ধে তদন্ত কমিটি হচ্ছে। উপাচার্যকে অপমানমূলক কথা বলেছি। ' সোমনাথের দাবি, ' পাস করেছি ভর্তি হইনি অর্থাৎ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র নই। তখন সোশাল মিডিয়ায় কোনও মন্তব্য করি তাহলে কোনও তদন্ত কমিটি করতে পারে না। ওনাকে অবমাননামূলক মন্তব্য করা হয়েছে এই কারণে অ্যাডমিশন সেলের কো-অর্ডিনেটরকে বলা হয়েছে আমাকে ভর্তি না নেওয়ার জন্য। যাঁদের বিরুদ্ধে তদন্ত হচ্ছে তাঁরা ভর্তি হতে পারবে না। হাইকোর্টের নির্দেশ ছিল আমাকে একটা অ্যাপোলজি লেটার দিতে হবে কতৃপক্ষকে। তাতেও কাজ হয়নি। আমাকে জানানোই হয়নি যে আমাকে ভর্তি নেওয়া হবে না। আদালতে যাওয়ার পর আমাকে জানানো হয়, সিদ্ধান্ত নেওয়ার এক মাস পরে।' উপাচার্যের পদত্যাগ চাইছেন সোমনাথও।
আরও পড়ুন- ‘সব জানত পুলিশ’, অভিযোগ উড়িয়ে তোলপাড় ফেলা ‘প্রমাণ’ পেশ বিজেপিনেত্রীর
বিশ্বভারতীর ফ্যাকাল্টি অ্যাসিসিয়েশনের অধ্যাপক সুদীপ্ত ভট্টাচার্য আন্দোলনকারীদের পাশে দাঁড়িয়েছেন। নিয়মিত মঞ্চেও তাঁদের সঙ্গে সামিল হয়েছেন। অর্থনীতি ও রাষ্ট্রনীতি বিভাগের এই অধ্যাপকের বক্তব্য, 'অন্যায়ভাবে অকারণে মীনাক্ষীর পিএইচডি বন্ধ করার চক্রান্ত করছে, সোমনাথ সৌ কোয়ালাফাই হওয়ার পরেও অন্যায় ভাবে গায়ের জোরে এমএ-তে ভর্তি আটকে দিয়েছে। এই অন্যায় মেনে নেওয়া যায় না। আমরা ছাত্রদের সঙ্গে আছি। আমাদের দাবি ওনাকে সরতে হবে।'
আন্দোলনকারীদের অভিযোগ উড়িয়ে দিয়েছেন উপাচার্য বিদ্যুৎ চক্রবর্তী। বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও ছাত্র-ছাত্রীদের একটা অংশের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন কাজ থমকে যাচ্ছে বলে মনে করে উপাচার্য। উপাচার্য বিদ্যুৎ চক্রবর্তী বলেন, 'সুদীপ্ত ভট্টাচার্য বাম রাজনীতি করে। ওনাকে একটা বিশেষ মন্দিরের আচার্য করি। তার জন্য আমাকে আনেক সমালোচনা সহ্য করতে হয়েছে। সে আমাকে বলছে তোর খেলা শেষ। এই লেভেলে বিশ্বভারতীর শিক্ষকরা কথা বলেন। তাহলে এখানে আমার কি করার আছে। এখানে আমরা ছাত্র-ছাত্রীও তৈরি করতে পারি না। শিক্ষককে তাঁরা গালাগালি দেন। আমি দুঃখ পেয়েছি। তাহলে কি বিশ্বভারতীর এটাই সংস্কৃতি? গায়ের জোর সব করে নেবে। এটার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছি বলেই আজ আমার বিরুদ্ধে এত প্রতিবাদ।' উপাচার্যের দাবি, 'আমাকে আটকে রেখে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রচুর ক্ষতি হচ্ছে। ওদের সঙ্গে আমার লড়াই করার সম্পর্ক নয়। ওরা তো আমার ছেলেমেয়ের মতো।'
মীনাক্ষী ও সোমনাথ চক্রান্তের কথা বলছেন। এই সম্পর্কে উপাচার্য বলেন, 'এরা কেউ আমার দুশমন নয়, সোমনাথ সৌ-এর ক্ষেত্রে বলতে পারি ইকোনমিক ডিপার্টমেন্টে গিয়ে খোঁজ নিলে জানা যাবে কেমন ছাত্র ছিল, ৩ বছরের ডিগ্রি ৫ বছরে করেছে। সেটা করোনার জন্য নয়, অনেকগুলো পেপারে ও ব্যাক পেয়েছে। সেই ব্যাক পেপারগুলো দিতে হয়েছে। পড়াশুনা তার কাছে কতটা গুরুত্ব সে সম্বন্ধে আমার দ্বিধা আছে। খোলাখুলি বলছি, এই কারণে যাঁরা পড়াশুনায় ভাল তারা তো আসছে না। মিনাক্ষীর ক্ষেত্রে ৬ বছর লেগেছে এখনও পিএইচডি সম্পূর্ণ হয়নি। এক জায়গায় চাকরি করত। এগুলো বুঝতে হবে। চার বছরের ফেলোশিপ পেয়েছে। এগুলো নিয়ে আমার কিছু বলার নেই।'
আরও পড়ুন- তুঙ্গে বিতর্ক, আবাস যোজনার তালিকা থেকে নাম কাটানোর হিড়িক বর্ধমানের শাসক শিবিরের জনপ্রতিনিধিদের
আন্দোলনকারীরা উপাচার্যের পদত্যাগ দাবি করছেন। কি বলবেন? ড. বিদ্যুৎ চক্রবর্তী বলেন, 'পদত্যাগ করার ব্যাপারে আমার হাসি পায়। যাঁরা বলছেন তাঁরা কি আমাকে চাকরি দিয়েছেন? উপাচার্যের চাকরি দিতে পারেন রাষ্ট্রপতি। একটা প্রক্রিয়ার মাধ্যমে আমি এসেছি। অন্তত তিনশোজন আবেদন করেছিলেন। সেখান থেকে আমাকে মনোনীত করা হয়েছে। রাষ্ট্রপতি সই করেছেন নিয়োগপত্রে।'
সোমনাথ সোশাল মিডিয়ায় বিতর্কিত লিখেছে সেকথা সে নিজেই জানিয়েছে। এই প্রসঙ্গে উপাচার্য বলেন, 'আমাকে অপমান করেছে ফেসবুকে। সেখানে ক্ষমা চাইলে বিবেচনা করব বলেছিলাম। সেই ছাত্র কোর্টে যায়। কোর্ট জানিয়ে দেয়, তোমাকে ক্ষমা চাইতে স্যাটিসফ্যাকটরি অব কমপিটেন্ট অথরিটির কাছে। সেটা কিন্তু আমি নই। আমাদের এক্সিকিউটিভ কাউন্সিল। সেটাতে আমি চেয়ার করিনি, সেখানে সর্বসম্মতি ক্রমে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল যাঁরা বিশ্ববিদ্যালয়ের মানসম্মানের কথা ভাবে না তাদের ভর্তি নেওয়া হবে না।' মীনাক্ষীর অভিযোগ নিয়ে উপাচার্য বলেন, 'পিএইচডির ব্যাপারে কোনও সিদ্ধান্ত হয়নি। রিসার্চ বোর্ডের কোনও মিটিং হয়নি। আমি ছাড়া ওই কমিটিতে অনেকে আছেন। এখনও পর্যন্ত যা সিদ্ধান্ত নিয়েছি তা সর্বসম্মতিক্রমে। আমি একা নয়।'