Lok Sabha Elections 2024: মনোজ লেপচা। দেশের স্বাধীনতার বয়স থেকে ২৬ বছর কমিয়ে তাঁর বয়স এখন ৫১ বছর। বসতি বক্সার সদর বাজারের ডাড়াগাঁও। জীবিকা গাইড (Guide)। বাবা লাক্ষুচ্ছ্রিং লেপচাকে হারিয়েছেন মাত্র ২০ বছর বয়সেই। সংসারের বোঝা টানছেন তখন থেকেই। বছর তিনেক বাদে মারা গিয়েছেন মা মায়া লেপচাও। পড়াশোনার পাঠ চুকিয়ে দিতে হয়েছে সেই পঞ্চম শ্রেণিতেই। কিন্তু তাঁর দু'চোখ ভরা স্বপ্ন ছেলে ও মেয়ের ভবিষ্যৎ নিয়ে। তাঁরা যেন লেখাপড়া শিখে নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারে। খাঁড়া পাহাড়ে এভাবে দিনভর তাঁদের যেন ওঠা-নামা করতে না হয়। মনোজ লেপচার মতোই জীবনযুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছেন বক্সার ১৩টি গ্রামের আরও অনেকেই। ভোট (Election) তাঁদের কাছে তেমন কোনও অর্থ বহন করে না।
মনোজ লেপচা পাহাড়ে উঠতে উঠতে ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলাকে বলেন, "বহু কষ্ট করে ছেলেমেয়েকে পড়াশোনা করতে বাইরে পাঠিয়েছি। এখানে তো অষ্টম শ্রেণি অবধি পড়াশোনার ব্যবস্থা আছে। তবে শিক্ষক তেমন নেই। অষ্টম শ্রেণির পর অন্যত্র যেতেই হবে লেখাপড়া করতে হলে। ছেলে সুজল লেপচা জলপাইগুড়িতে দ্বাদশ শ্রেণিতে পড়ে। মেয়ে প্রশাংসা দশম শ্রেণির ছাত্রী। বাড়িতে রয়েছে ছোট ছেলে আশিষ লেপচাও। গাইডের কাজ করে কোনওরকমে সংসার চলে। এখানে না আছে হাসপাতাল, অসুস্থ হলে দুর্গতির শেষ থাকে না। স্ট্রেচারে করে বহু কষ্টে নামাতে হয়। কয়েক কিলোমিটার হাঁটার পর জিরো পয়েন্ট (Zero Point) থেকে গাড়ি চলাচল করে।" ভোট এলেই প্রার্থী ও রাজনৈতিক দলগুলো নানা প্রতিশ্রুতি দিয়ে যায়। তারপর আর তাঁদের দেখা মেলে না। একনাগাড়ে বলে চললেন মনোজ লেপচা।
আত্মা, ফুলবাড়ি, টাঁসি গাঁও, বক্সা (Buxa), সদর বাজার, ডাড়াগাঁওসহ ১৩ গ্রাম নিয়ে এই বক্সা অঞ্চল। মনোজ জানান, এখানে মোট ভোটারের সংখ্যা প্রায় ২ হাজার। ২টো বুথ। বক্সা ফোর্টের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের বুথ সমুদ্রপৃষ্ট থেকে প্রায় ২,৬০০ ফুট উঁচুতে। ভুটান সীমান্তের এই গ্রামগুলির বাসিন্দারা জীবনযুদ্ধ জারি রেখেছেন। একদিকে প্রাকৃতিক প্রতিকূলতা, বন্য প্রাণীর হানা তো রয়েছেই। অন্যদিকে, স্বাধীনতার ৭৭ বছর পরেও উন্নয়নের ছোঁয়া না পৌঁছালেও হারতে রাজি নয় মনোজ লেপচারা। প্রতিদিন তাঁরা বাঁচার স্বপ্ন দেখেন। ঘুম থেকে উঠেই শুরু করেন জীবন জয়ের সংগ্রাম।
প্রাথমিক স্কুলে (Primary School) তখনও ছাত্র-ছাত্রীদের পড়াচ্ছিলেন নরবাহাদুর থাপা ও কুলবাহাদুর থাপা। ছিলেন প্যারাটিচার বিকাশ থাপাও। প্রাথমিক স্কুলে ছাত্র-ছাত্রীর সংখ্যা ১৪। শিক্ষকরা জানালেন, ক্রমশ কমছে ছাত্র-ছাত্রীর সংখ্যা। প্রাথমিক স্কুলে মিডডে মিলের (Mid Day Meal) রান্না চলছিল। জলের কষ্টকাহিনী শোনালেন গ্রামের মহিলারাও। সেই জল বয়ে আনতে হয় কয়েকশো মিটার দূরের নদী থেকে। মিড ডে মিলের কর্মী দামু থাপা বলেন, "আমাদের জলকষ্টের শেষ নেই। হাঁড়ি-কলসি ভরে ঝরনা থেকে জল আনতে হয়। ভোট এলে নেতারা প্রতিশ্রুতি দিলেও আমাদের কষ্টের কোনও মুক্তি নেই।"
বিকাশ থাপার স্ত্রী কিনলে বুধা ডুপ্পা গ্রাম পঞ্চায়েতের সদস্যা। বিকাশ থাপার বক্তব্য, "আমাদের এখানে রাস্তা বলে তেমন কিছু নেই। জিরো পয়েন্ট পর্যন্ত গাড়ি যাতায়াত করে। তারপর ওপরে পাহাড়ের গ্রাম যত দূরেই হোক হেঁটে যেতে হবে। স্ট্রেচারে করে রোগী নামাতে গিয়ে মৃত্যু পর্যন্ত ঘটেছে। আমাদের একেবারে সীমান্ত ঘেঁষা গ্রামের দুর্দশা ভাষায় প্রকাশ করতে পারব না। শনিবার ছাড়া স্বাস্থ্য কেন্দ্রে সরকারি কর্মীর দেখা মেলে না। তবে হ্যাঁ, লক্ষ্মীর ভাণ্ডার (Lakshmir Bhandar) মেলে। ১০০ দিনের টাকা পাওয়া নিয়ে অবশ্য সমস্যা আছে। তাছাড়া বন্য প্রাণীর হামলার সম্ভাবনা তো থাকেই।" এলাকার সমস্যার কথা ভিডিওগ্রাফি করে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে (Narendra Modi) তাঁরা জানিয়েছেন।
এখানকার বক্সা ফোর্ট (Buxa Fort) নির্মাণ করেছিল ব্রিটিশ (British) সরকার। আন্দামানের (Andaman) সেলুলার জেলের (Celular Jail) পর এটা স্বাধীনতা সংগ্রামীদের দ্বিতীয় সেল। রাজ্য সরকার ৩ কোটি ১ লক্ষ টাকা দিয়ে ফোর্টের কিছু অংশ মেরামত করেছে। বহু বিপ্লবীকে এখানে বন্দি করে রাখতো ইংরেজ সরকার। তখন চারিদিকে বসতিও ছিল না, শুধু ছিল জঙ্গল আর জঙ্গল। সেই ফোর্ট দেখতে আসেন পর্যটকরা (Tourists)। তাঁদের এখানে যাতায়াতেই স্থানীয় বড় অংশের জীবীকা নির্বাহ হয়।
আরও পড়ুন- Premium: যুবকের অকল্পনীয় তৎপরতায় শ্রেষ্ঠত্বের শিখরে একঝাঁক কচিকাঁচা! গর্বে বুক চওড়া বাংলার
বক্সার এক দোকানি অরুণা থাপা বলেন, "পর্যটক এলে বিক্রি হয়। তাই চলে যায়।" তবে ক্ষোভের আগুন জ্বলছে তাঁর মনেও। তিনি বলেন, "এই পাহাড়ি বসতিতে হাসপাতাল নেই, ডাক্তার নেই, রাস্তাঘাট নেই, জলের ব্যবস্থা নেই। ভোট এলে নেতারা বলেন, রাস্তাঘাট করে দেব, হাসপাতাল হবে। ভোট চলে যায়, প্রতিশ্রুতিও চলে যায়। কোনও সরকার সেভাবে কিছু করছে না। তবে লক্ষ্মীর ভাণ্ডার পাই। কেউ কেউ এখন ১০০ দিনের মজুরিও পেয়েছে।"
পাহাড়ের ওপারে কিছু পথ হাঁটলেই পড়শি দেশ ভুটান (Bhutan)। এপারের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রতিবারই ভোটকেন্দ্র হয়। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ২,৬০০ ফুট উচ্চতার বুথে পাহাড়ি এবড়ো-খেবড়ো পাথরের রাস্তা দিয়ে ভোটযন্ত্র নিয়ে যান ভোটকর্মীরা। পাহাড়ি এলাকার উন্নয়নের গতি থমকে আছে আদ্যিকালের এমন যাতায়াত ব্যবস্থার মতোই। এমনই পরিস্থিতি যে অষ্টম শ্রেণি পাশ করলেই পড়াশোনা চালিয়ে যেতে গেলে গ্রাম ছাড়তেই হবে। কেউ অসুস্থ হলে দুর্গতির শেষ থাকে না। অসুস্থ হওয়া মানেই বড় বিপদ। জল কষ্ট তো রয়েছেই। এত কিছু নেইয়ের পরেও বক্সা এলাকার ১৩ টি পাহাড়ি গ্রামের বাসিন্দারা জীবন সংগ্রাম জারি রেখেছেন প্রকৃতিকে সাক্ষী রেখেই।