শিক্ষাক্ষেত্রে দুর্নীতির অভিযোগে রাজ্যের প্রাক্তন শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়, প্রাথমিক শিক্ষাপর্ষদের চেয়ারম্যান বিধায়ক মানিক ভট্টাচার্যসহ একাধিক প্রাক্তন উচ্চপদস্থ আধিকারিক জেলবন্দি। পথকে বাসা করে আন্দোলন করছেন চাকরি প্রার্থীরা। আদালতেও চলছে মামলা-শুনানি। এসএফআইও নানা ইস্যু নিয়ে পথে নামছে। সিঙ্গুর বিধানসভায় সিপিএম প্রার্থী করেছিল এসএফআইয়ের রাজ্য সম্পাদক সৃজন ভট্টাচার্যকে। তরুণ এই বামেনেতার পর্যবেক্ষণ, 'বামপন্থীরা ৩৪ বছর সরকারের দায়িত্ব পালন করেছে। সেই জড়তা থেকে বের হতে একটা সময় লাগে। ৩৪ বছর ক্ষমতায় থাকার পর বিরোধী ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে বা গা-ঝাড়া দিতেও খানিকটা সময় লাগে।' ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলাকে একান্ত সাক্ষাৎকারে রাজ্যের সামগ্রিক শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে হাজারো প্রশ্ন তুলে ধরলেন সৃজন।
প্রশ্ন- সাংগঠনিক উত্তোরন কি ঘটছে?
সৃজন- ধারাবাহিক প্রক্রিয়ায় সংগঠন এগিয়ে চলেছে। যত সময় যাচ্ছে এসএফআই আরও শক্তি সঞ্চয় করছে। কোভিডের পরে স্কুল-কলেজ বন্ধ ছিল কয়েক মাস। তারপরেও ৭,৪৪,৩০৬ জন সদস্য।
প্রশ্ন- কলেজে ছাত্র সংসদ নির্বাচন বন্ধ, কি হবে?
সৃজন- নির্বাচন করতে হবে। বাপ বাপ বলে করতে হবে। আজ নয় কাল, কাল নয় পড়শু আন্দোলনের চাপে করতেই হবে। মাঝে স্টুডেন্ট কাউন্সিল করতে গিয়েছিল। ছাত্র ভোট ঘেঁটে গিয়েছে, ৫ বছর ধরে ভোট হয়নি কলেজে। প্রেসেডেন্সি যাদবপুরের ছাত্ররা কথা বলতে শুরু করেছিল। ১৯-এর শেষে কুড়ির প্রথমে প্রেসিডেন্সি ও যাদবপুরে ভোট হয়েছে, এসএফআই জিতেছে। ডায়মন্ডহারবার ও রবীন্দ্রভারতীতে ভাট হয়েছে, তৃণমূল জিতেছে। যার কারণে কেকের মতো ঘটনা ঘটছে। ফেস্ট কমিটি, অ্যাডহক কমিটি। দুর্নীতির মধূভান্ডার গড়ে উঠেছে। স্বচ্ছ ও সৎ ছাত্র সংসদ নির্বাচন অবিলম্বে দরকার।
প্রশ্ন- ছাত্র রাজনীতির হাল…..
সৃজন- যাঁরা আরাবুল ইসলাম ও অনুব্রত মন্ডলকে নিজেদের দলের সম্পদ মনে করে তাঁরা তো চাইবে না ছাত্র রাজনীতি থাকুক। আরাবুল জগ ছুড়ে মারবে সে হচ্ছে দলের তাজা ছেলে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, সুব্রত মুখোপাধ্যায় ছাত্র রাজনীতি করেই উঠে এসেছেন। তৃণমূল বুক ঠুকে বলতে পারবে পরের প্রজন্মে ছাত্র আন্দোলন থেকে উঠে আসা ভরসা করার মতো নেতা আছে। পটুয়াপাড়ার যুবরাজ কোথায় ছাত্র রাজনীতি করেছে? হীরকরাজার দেশে ছিল না যত বেশি পড়ে তত বেশি জানে তত কম মানে। ছাত্ররা রাজনীতি করুক এটা তৃণমূল চায় না। তাহলে আগামী প্রজন্মকে তাবে রাখতে আসুবিধা হবে।
প্রশ্ন- রাজ্যে এখন একাধিক ভয়ঙ্কর ইস্যু, এই পরিস্থিতিতে কেউ কেউ মমতা বন্দ্যোপাধ্য়ায়ের আন্দোলনের সঙ্গে বিরোধীদের তুলনা করছেন। কি বলবে?
সৃজন- মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় একজন মহিলাকে ধর্ষিতা সাজিয়ে জ্যোতি বসুকে হেনস্তা করতে গিয়েছিলেন। এটা আমার দ্বারা হবে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় টাটাদের তাড়ানোর আন্দোলন করে এখন বলছেন আমি তাড়াইনি। ওটা পূর্ব ভারতে পাইলট প্রোজেক্ট হতে পারত। মমতা কি করেছেন আমরা কি করছি সেই তুলনা আসতেই পারে। কিন্তু এত পদে পদে অসততা সেটা আমদের পক্ষে করা মুশকিল। আমরাও নবান্ন অভিযান করেছি। ২১ জুলাই মহাকরণ দখল করার উদ্দেশ্য ছিল কয়েকটা লাশ পড়ুক। আমরা চাইতে পারি আন্দোলন করতে গিয়ে কোনও সহকর্মীর লাশ? কোনও মানবিক বোধ সম্পন্ন মানুষ সেটা পারবেন? বিরোধী থাকাকালীন মশা মরলে সিবিআই তদন্ত চাইতেন। সরকারে এসে সিবিআই দুচক্ষের বিষ। যখন বিরোধী ছিলেন ১২ বছরে ৭৩টা বন্ধ ডেকেছিলেন। এখন বন্ধ খারাপ। আমাদের অলসতা, ঘাটতি বা সাংগঠনিক দুর্বলতা থাকতেই পারে কিন্তু অতটা সংকীর্ণ স্বার্থে নীচে নামা সম্ভব নয়।
প্রশ্ন- প্রাথমিকে ইংরেজি তুলে দেওয়া নিয়ে এখনও সমালোচনা হয় বামফ্রন্ট সরকারের। তোমার কি মতামত?
সৃজন- কলকাতা বা শহরের মধ্যবিত্তদের মধ্যে একথা শোনা গিয়েছে। ১৯৭৭-এ বাম সরকার ক্ষমতায় আসর সময় রাজ্যে সাক্ষরতার হার ছিল ২৪ শতাংশ। তখন প্রথম চ্যালেঞ্জ ছিল গ্রামে গ্রামে শিক্ষার প্রসার করা। শিক্ষার বিকেন্দ্রীকরণ করাই ছিল মুখ্য উদ্দেশ্য। আলোচনার মাধ্যমে ঠিক হয় মাতৃভাষাই প্রাথমিক শিক্ষাদানের প্রদান মাধ্যম হবে। যাতে গরীব, দরিদ্ররাও শিক্ষা পায়।
বাম সরকার চলে যাওয়ার সময় সাক্ষরতার হার ৭৮ শতাংশ হয়েছিল। মাতৃভাষায় সাক্ষর করতে হবে এটা ছিল প্রাথমিক চ্যালেঞ্জ। এমবিএ করাতে হবে তাহলে ইংরেজিত শিক্ষা দেওয়া হত। ঘরে ঘরে গ্রামে গ্রামে শিক্ষা পৌঁছানো। একমাত্র পশ্চিমবঙ্গ নয়। গোটা দেশজুড়ে চলছিল তারই অঙ্গ হিসাবে এরাজ্য়ে হয়েছে। যে ভাষার মাধ্যমে বড় হয়েছি সে ভাষা ভাবতে সাহায্য করে, আমাদের রাজ্যে শুধু নয়, শিক্ষা সংক্রান্ত দেশের প্রতিটি কমিশন মাতৃভাষায় শিক্ষার কথা বলেছে। জ্যোতি বসু অচানক কিছু করেনি। প্রাথমিকে মাতৃভাষার শিক্ষার পর পঞ্চমশ্রেণি থেকে ইংরেজি শিক্ষার কথা বলা হয়েছিল।
প্রশ্ন- সিপিএম এবিষয়ে পরে আত্মসমালোচনা করেছিল….
সৃজন- ক্ষমতা চলে যাওয়ার পরে সরকারের মূল্যায়ন নিয়ে সিপিএম দলিল প্রকাশ করে বলে আরেকটু আগে ইংরেজি অপশনাল করে দিতে পারতাম। আমরা আত্মসমালোচনা করেছিলাম বাম বলেই। সিপিএম বলেই আত্মসমালোচনা করতে পেরেছিল। আত্মসমালোচনার পর যেমন জোর দেওয়া উচিত। তবে সেই সময়কার পরিস্থিতির কথাও ভাবতে হবে। কম্পিউটার নিয়ে বলেছিল এভাবে এলে কর্মসংস্থান কমবে। তবে প্রযু্ক্তি এলে পুরনো ধরনের কাজ চলে যাবে নতুন ধরনের কাজ হবে। পরবর্তীকালে যাঁদের কম্পিউটারের বিরোধিতা করেছিল বলা হয়েছিল সেই বামপন্থীরা রাজারহাট-নিউটাউন, সেক্টর ফাইভ করেছিল। সিঙ্গুরসহ নানা উৎপাদন কারখানার উদ্যোগ নিয়েছিল। তখন একপক্ষ স্যান্ডউইচ খেয়ে অনশনে দাঁড়িয়ে গেল।
প্রশ্ন- দিল্লিতে সরকারি স্কুলে ব্যাপক উন্নতি হয়েছে। এখানে কি অবস্থা?
সৃজন- তৃণমূল আমলে শিক্ষাক্ষেত্রটা টাকা রোজগারের জায়গা। শিক্ষক নিয়োগে ব্যাপক দুর্নীতি। সরকার, শাসকদল, মন্ত্রী ও প্রশাসনের সর্বোচ্চ স্তর উৎসাহ দিয়েছেন, নিজে থেকেছেন চক্রের সঙ্গে। এসএসসি, টেট, কলেজে শিক্ষক নিয়োগ লাটে উঠেছে। পরিকাঠামোয় দুর্বলতা। এমনতো নয় একজন বিডিও প্রধান শিক্ষককে নিয়ে দুর্নীতি করেছে তা নয়, শিক্ষামন্ত্রী নিজে দুর্নীতি করেছেন। তার সুফলভোগ করছেন। গ্রামের স্কুলে শিক্ষক নেই। শহরে চলে আসছেন। লাটে উঠে শিক্ষাব্যবস্থা।
প্রশ্ন- কলেজে ভর্তি হচ্ছে না..
সৃজন- অনলাইনে ভর্তিতে দুর্নীতি একটু কম হচ্ছে। বামেদের সময় ১৮ শতাংশ শিক্ষাক্ষেত্রে বাজেট ছিল। এখন কলেজে সিট খালি আছে কিন্তু ছেলেমেয়েরা পড়তে আসছে না। পড়াশুনার পরিবেশ নেই। ভবিষ্যৎ নেই। কাশফুলের বালিস বানাও বা চপ ভাজো। বা দলে এসে সিন্ডিকেট করো। নিশ্চিত নিরাপদ জীবন তরুণপ্রজন্ম পেলে মুখ্য়মন্ত্রী কাউকে কি পুছবে?
প্রশ্ন- এসএসসি, টেট ছাড়া সিএসসিতে আরও বড়সড় কেলেঙ্কারির অভিযোগ উঠছে।
সৃজন- পাবলিক এডুকেশন সেক্টর ধ্বংস করতে চাইছে তৃণমূল সরকার। সিএসসিতে দুর্নীতি। সিএসএসিতে কিছু লোককে টাকা নিয়ে চাকরি দিয়ে দিচ্ছে। তাহলে আদালতে যোগ্য চাকরিপ্রার্থীরা মামলা করবে। দীর্ঘ দিন সিএসসি হচ্ছে না। মোদ্দা কথা শিক্ষক নিয়োগের পদ্ধতি ঘেঁটে দেব, এটাই সরকারের উদ্দেশ্য। ২০১৪ ও ১০১৭ টেট পাশ চাকরি প্রার্থীদের মধ্যে ঝগড়া বাধিয়ে দিচ্ছে। নিয়ম অনুযায়ী প্রাথমিকে ১লক্ষ ২০ হাজার শিক্ষক নিয়োগ করতে পারে। সব যোগ্যপ্রার্থীদের নিয়োগ হোক। ২০১৮ কলেজ শিক্ষক নিয়োগে বড় ধরনের দুর্নীতি হয়েছে।
প্রশ্ন- বিদ্যার্থী পরিষদ বা টিএমসিপির ভূমিকা নিয়ে কি বক্তব্য?
সৃজন- ধ্বংসাত্মক, বিভেদকামী মতাদর্শ ছাত্রদের মুখে দিয়ে বলানোর চেষ্টা করছেন। বাংলার ছাত্র সমাজ, নাগরিক সমাজ তা মেনে নেবে না। শাসকদলের ছাত্র সংগঠন গা-জোয়ারী করে অনেক দিন ধরে ছাত্র সংসদগুলি চালাচ্ছে। টিএমসি ছাত্রদের ইস্য়ু নিয়ে শেষ কবে আন্দোলন করেছে? জাতীয় শিক্ষানীতি গোটা দেশের শিক্ষা ব্যবস্থাকে লাটে তুলে দেবে। এসএফআই সীমিত ক্ষমতা নিয়ে আন্দোলন করছে। জাতীয় শিক্ষানীতি নিয়ে তৃণমূলের ছাত্র সংগঠনের অবস্থান কী? সংগঠনে ছাত্র লিখে দিলেই ছাত্র সংগঠন হয় না। সমাজের প্রতি বাড়তি দায়িত্ব আছে। টাকা নিয়ে হল ভর্তি করে কেকের দমবন্ধ করে দেওয়া, ভর্তির সময় টাকা নেওয়া ছাড়াও ছাত্র সংগঠনের অনেক কাজ আছে।
প্রশ্ন- পঞ্চায়েত নির্বাচনে কতটা লড়াই হবে?
সৃজন- যাঁরা বামপন্থীদের থেকে সরে গিয়েছেন বা বসে গিয়েছেন তাঁরা দ্রুত ফিরছেন। মিটিং-মিছিলগুলো তা জানান দিচ্ছে। গ্রামে গ্রামে বুথে বুথে তরুণ প্রজন্মেরও ঢল নেমেছে। মানুষ খুঁটি পেতে চাইছে। মানুষ স্বৈরাচারী, সর্বনাশের শাসনকালকে শেষ করতে চাইছে, বাকিটা আমাদের ওপর নির্ভর করছে। আমরা কতটা শক্ত খুঁটি নিয়ে মানুষের সামনে হাজির হব। এখনই ভবিষ্য়ৎবানী করার জায়গায় নেই। ওরা মানুষের সামনে গুড়-বাতাসা নিয়ে হাজির হবে তাহলে মানুষের হয়ে ল্যাংচা, চমচম, সীতাভোগ, মিহিদানা প্রস্তুত থাকব।
প্রশ্ন- আঠরো বছর কি চাইছে?
সৃজন- মানুষ তরুণ প্রজন্ম দেখে জাগছেন দেখে প্রবল পরাক্রান্ত শিক্ষামন্ত্রীর দিকে জুতো মারছে তরুণ প্রজন্মকে জাগ্রত হতে দেখে। তরুণ প্রজন্মের উত্থান জরুরি। আমাদের বুকে সুকান্ত ভট্টাচার্য থাকবেন।
প্রশ্ন- এরাজ্যে বিরোধী দল তো বিজেপি……
সৃজন- শাসক তৃণমূল তার বিটিম শাসক বিজেপি, শাসক বিজেপি বা তার বিরোধী শাসক তৃণমূল। বিধানসভায় বিরোধী কন্ঠস্বর একটা আছে। বিধানসভার বাইরে সাড়ে ৯ কোটির রাজ্য়ে ৩ থেকে ৭ কোটি হচ্ছে। দাঙ্গাবাজ, বালি চোর, কয়লা চোর, গরুচোররা টাকা ফেলে পালানোর পথ খুঁজে পাবে না। সেই দিন আসছে। বিরোধী রাজনীতির রাশ বামপন্থীদের সঙ্গেই আছে। আমি জ্যোতিষী নই, বিজ্ঞানে বিশ্বাসী হয়ে মার্ক্সবাদে আস্থা রেখে এসএফআই করতে এসেছি। যে গণজাগরন শুরু হয়েছে বামপন্থীরা যদি সাংগঠনিক ভাবে পরিচালনা করতে পারে তাহলে নিশ্চিত ভাবে আগামী দিনে বাংলায় নতুন ভোর হওয়ার অপেক্ষা। সেই দিকে আমরা সবাই এগোনোর চেষ্টা করছি।
প্রশ্ন- হিন্দি আগ্রাসন নিয়ে বিরোধিতা চলছে, এসএফআইয়ের পদক্ষেপ কি?
সৃজন- আমরা মাতৃভাষা অধিকার রক্ষার পক্ষে। বহু ভাষাভাষীর দেশে অমিত শাহ যে মন্তব্য করেছেন, আরএসএসের হিন্দু হিন্দু আগ্রাসন হিসাবে মনে হচ্ছে। হিন্দি আমাদের রাষ্ট্রভাষা নয়। এগুলো মিথ্য়া কথা বলা হচ্ছে। আরএসএস তাঁদের সংস্কতি সারা দেশে চাপিয়ে দিতে চায়। পরবর্তী কালে কোনও তামিল শাসক ক্ষমতায় এলে তামিল বাধ্যতামূলক করতে পারে। হিন্দিভাষী মানুষের সঙ্গে ভুল বোঝাবুঝির জায়গা নেই। বৈচিত্র্যময় দেশে এক ভাষা চাপিয়ে দেওয়া যাবে না। হিন্দি দেশের প্রধানভাষা হতে পারে না। সকলকে হিন্দি শিখতে হবে তা হতে পারে না।