সর্বভারতীয় দলের মর্যাদার জন্য উত্তর পূর্বের ছোট ছোট রাজ্যগুলিকে বেছে নিয়েছিল বাংলার ক্ষমতাসীন তৃণমূল কংগ্রেস। ২০১২-তে মনিপুর বিধানসভা নির্বাচনে রাজনৈতিক মহলকে অবাক করে ১৭ শতাংশ ভোট পেয়ে ৭ আসনে জয়ী হয়েছিল তৃণমূল কংগ্রেস। ওই নির্বাচনে মনিপুরে দ্বিতীয় বৃহত্তম দল হয় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, মুকুল রায়দের তৃণমূল। যদিও পরবর্তী ভোটে ঘাসফুলের নাম ও নিশানা ধুয়ে মুছে সাফ হয়ে যায় মনিপুরে। সেই সময় ভিন রাজ্যের দলীয় সংগঠন দেখভালের দায়িত্বে ছিলেন দলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক মুকুল রায়। তৃণমূলের 'চানক্য' বিজেপিতে যোগ দিতেই বাংলার বাইরে মমতার দলের সংগঠন মুখ থুবড়ে পড়ে। অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় দলের সাধারণ সম্পাদক হওয়ার পর নিজেই চ্যালেঞ্জ ছুড়ে বলেছিলেন, বাংলার বাইরে তৃণমূল ভোটে লড়তে যাবে না জিততে যাবে। আরও আগ বাড়িয়ে তিনি বলেছিলেন সরকার গড়বে তৃণমূল। রাজনৈতিক মহলের মতে, ২০২১ বিধানসভা নির্বাচনে তৃণমূলের ব্যাপক সাফল্য খানিক মাথা ঘুরিয়ে দিয়েছিল শীর্ষ নেতৃত্বকে।
প্রথমত, বাংলার প্রতিবেশী বাঙালি অধ্যুষিত রাজ্য ত্রিপুরায় প্রথমে পুরসভা নির্বাচনে সর্ব শক্তি দিয়ে ঝাপিয়ে ছিল মমতা-অভিষেকের দল। বাংলা থেকে প্রতিদিনই তখন কোন না কোনও তৃণমূল নেতা ত্রিপুরা ছুটছিলেন। মাত্র ১টি আসনে জয় পেলেও ভোট শতাংশের হার ভদ্রস্থ ছিল। যদিও পরে সেই কাউন্সিলরও গেরুয়া শিবিরে ভিড়ে যায়। ত্রিপুরা কব্জা করতে প্রক্তন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী প্রয়াত সন্তোষ মোহন দেবের মেয়ে সুস্মিতা দেবকে রাজ্যসভার সাংসদ করে ত্রিপুরার দায়িত্ব তুলে দেওয়া হয়। পুরভোটের পর লক্ষ্য করা যায়, ত্রিপুরার বিধানসভা ভোটে এনার্জি কমতে থাকে তৃণমুলের। সব আসনে প্রার্থীও দিতে পারনি অভিষেকের দল। নোটার থেকেও কম ভোট পায় তৃণমূল। শেষমেশ ত্রিপুরা অভিযানে রণে ভঙ্গ দেয় তৃণমূল। এসব প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছিল ২০২১ বিধানসভা নির্বাচনের পর। শূন্য হাতে ফিরতে হয় তৃণমূলকে।
আরও পড়ুন- ‘আমরাও রক্ত মাংসের মানুষ’, বড় উপলব্ধি অভিষেকের, পঞ্চায়েতের আগেই বাঁকুড়াকে কড়া বার্তা
এর আগে গোয়াতেও নোঙর ফেলেছিল তৃণমূল কংগ্রেস। সেখানে আরব সাগরে মাছ-হাঙড় কিছুই ওঠেনি। গেয়ার প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী তথা কংগ্রেস নেতা ফেলাইরোকে দলে নিয়ে রাজ্যসভার সাংসদ করে দেয়। টেনিস লিজেন্ড লিয়েন্ডার পেজকে দলে টেনে নেয়। এক্ষেত্রে ত্রিপুরার পলিসি নেয় দল। তবে ভোট শেষ হতেই তৃণমূলের ফানুস চুপসে যায়। গোয়ার পরের লক্ষ্য ছিল মঘালয়ের বিধানসভা নির্বাচন।
উত্তর পূর্বের পাহাড়ি রাজ্যে অভিযানের শুরুতে ১২জন কংগ্রেস বিধায়ককে দলে টেনে নেয় তৃণমূল। অবশ্য ভোট পর্যন্ত সকলে টেকেনি ঘাসফুল শিবিরে। জয়ের লক্ষ্যে সেখানে প্রচারে বারে বারে ছুটে গিয়েছেন মমতা, অভিষেকরা। তখতে বসার লক্ষ্য নিয়ে লড়াই করে ৬০ আসনের বিধানসভায় ৫ জন বিধায়ক পেয়ে সন্তুষ্ট থাকতে হয় তৃণমূলকে। জাতীয় দলের মর্যাদা হারানোর পর তারাও কতদিন তৃণমূলে থাকবে, তা নিয়ে রাজনৈতিক মহলে চর্চা অব্যাহত। অভিজ্ঞ মহল মনে করছে, সম্প্রতি তিন রাজ্যে যা দশা হল তৃণমূলের তাতে আগামী কয়েক বছর নির্বাচন কমিশনের নিয়মানুযায়ী জাতীয় দলের মর্যাদা পেতে কষ্ট আছে তৃণমূল কংগ্রেসের।
আরও পড়ুন- গনগনে রোদে জ্বলছে বাংলা, দাবদাহ থেকে বাঁচতে কী করণীয়? নির্দেশিকা নবান্নের
একটা সময় তৃণমূলের সেকেন্ড ইন কমান্ড মুকুল রায় শুধু বাংলা নয় ভিন রাজ্যে দলের দায়িত্ব সামলাতেন। পরে বিজেপিতে চলে যায় মুকুল। ২১-এ দলে ফিরলেও ভূমিকাহীন মুকুল। ভিন রাজ্যের রাজনৈতিক চতুরতায় পিছু হঠতে থাকে তৃণমূল। হিন্দিভাষী রাজ্যগুলিতে চালচুলো না থাকলেও পাঠানো হত ভাটপাড়ার তৎকালীন বিধায়ক অর্জুন সিংকে। যদিও কাজের কাজ কিছুই হয়নি। ২০১৯ লেকসভায় তৃণমূলের স্লোগান ছিল ৪২-এ-৪২, আর প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী মমতা বন্দ্যেপাধ্যায়। এরাজ্যে ৪২-এ-২২ হওয়ার পর ওই স্লোগান বন্ধ হয়ে যায়। ফের ২০২১ বিধানসভা নির্বাচনের ফল প্রকাশের পর সারা দেশে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর বিকল্প হিসাবে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় একমাত্র বিরোধী নেত্রী বলে তৃণমূল কংগ্রেস দাবি করতে থাকে। এদিকে এই সমীকরণে কংগ্রেসকে তুলোধোনা করতে থাকে তৃণমুল। জাতীয় দলের মর্যাদা চলে যাওয়ায় সর্বভারতীয় রাজনীতিতে নানা ক্ষেত্রে তৃণমূল বিপাকে পড়তে পারে বলে মনে করছে রাজনৈতিক মহল। প্রশ্ন উঠেছে, তাহলে কি বাংলার দল হয়েই থাকবে তৃণমূল!