উপাচার্যের পদত্যাগের দাবিতে তাঁর বাড়ির সামনে লাগাতার ধরনায় বসেছিলেন। তবুও চেয়ার ছাড়েননি তিনি। বিদ্যুৎ চক্রবর্তী তখন বলেছিলেন, 'আমাকে কি আন্দোলনকারীরা অ্যাপয়েন্টমেন্ট দিয়েছে যে পদত্যাগ করব। যিনি নিয়োগ করেছেন তিনি বললে পদত্যাগ করব।' বছরভর একাধিক বিতর্কিত বিষয়ে তিনি সংবাদের শিরোনামে থেকে গিয়েছেন। পৌষ মেলা থেকে বসন্ত উৎসব বন্ধ থেকেছে এই সময়কালে। আশ্রমিকদের সঙ্গে নানা বিষয়ে বিতর্কে জড়িয়েছেন। অবসরের শেষ সময়ে হেরিটেজ নিয়ে ফলক বিতর্কে রাজ্য তোলপাড় হয়েছে। যে কোনও ক্ষেত্রে নিজের সিদ্ধান্তেই অনড় থেকেছেন বিদ্যুৎ চক্রবর্তী। শেষমেশ বিজেপি নেতৃত্বের একাংশের সঙ্গেও চরম বিবাদে জড়িয়েছেন বিশ্বভারতীর উপাচার্য।
বীরভূমের শান্তিনিকেতেনে এই কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে এর আগে উপাচার্য এসেছেন, চলে গিয়েছেন। চাপে পড়ে কেউ কেউ পদত্যাগও করেছেন। শিক্ষামহল মনে করে, সারা বছর ধর এমন বিতর্ক কখনও হয়নি। ২০১৯ সালে শেষবারের মতো পৌষমেলো হয়। খয়রাতি ও কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে মামলার কারণে মেলা বন্ধ করে দেওয়ার কথা জানিয়ে ছিলেন উপাচার্য। পাশাপাশি রাজ্য সরকারের কাছে আর্থিক সহযোগিতা চেয়েছিলেন তিনি। এদিকে ঐতিহ্যের পৌষ মেলা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় আশ্রমিক থেকে রবীন্দ্র অনুরাগীরা ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। শান্তিনিকেতনের পৌষমেলা এখন বোলপুরের মেলায় পরিণত হয়েছে। এমনকী মেলাকে কেন্দ্র করে তৃণমূল বিধায়কের নেতৃত্বে মিছিল ও ভাঙচুরের অভিযোগও ওঠে। নতুন উপাচার্যের আমলে নতুন করে পৌষমেলা বিশ্বভারতীর মাঠে ফিরে আসে কিনা সেদিকে নজর রয়েছে সকলের।
বসন্ত উৎসবে মেতে উঠতো শান্তিনিকেতন। পৌষমেলার মতো বসন্ত উৎসবে করোনার সময় ২০২০ থেকে বন্ধ রয়েছে। তৎকালীন উপাচার্য বলেছিলেন, 'বসন্ত উৎসব নয়, বসন্ত তাণ্ডব'। বিদ্যুৎ চক্রবর্তীর এই মন্তব্য নিয়েও কম বিতর্ক হয়নি। আগামী বছর কি ফের বসন্ত উৎসবে আবিরে রঙিন হবে কবিগুরুর শান্তিনিকেতন? সেই আশায় বুক বেঁধেছেন রবীন্দ্র অনুরাগীরা।
বিদ্যুৎ চক্রবর্তীর সময়ে বড় বিতর্ক হয়েছে নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেনের জমি নিয়ে। বিতর্ক এমন জায়গায় পৌঁছায় খোদ মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে ছুটে যেতে হয় শান্তিনিকেতনের 'প্রতীচি'তে। তবু কিন্তু নিজের অবস্থান বদল করেননি উপাচার্য। ১৩ ডেসিবেল জমি ফেরত চেয়ে বারে বারে বিশ্ববিদ্যালয়ের তরফ থেকে অর্থনীতিবিদকে চিঠি দেওয়া হয়েছে। আদালত পর্যন্ত গড়িয়েছে অমর্ত্য সেনের জমি জট। উপাচার্য দাবি করেছিলেন, শুধু অমর্ত্য সেন নয়, আরও প্রায় ৪৫ জন সমাজের বিশিষ্ট ব্যক্তি রয়েছেন যাঁরা বিশ্ববিদ্যালয়ের জমি হরপ করেছেন। কিন্তু তাঁদের নাম প্রকাশ করেননি তিনি। শিক্ষামহলের বক্তব্য, প্রকৃতই যদি বিশ্ববিদ্যালয়ের জমি কেউ দখল করে নেয় তাঁদের নাম প্রকাশ্যে আসা উচিত। সে বিষয়ে বাস্তব কি তা খোলসা হওয়া প্রয়োজন।
অধ্যাপক থেকে ছাত্র-ছাত্রীদের কেউ কেউ কড়া সিদ্ধান্তের মুখে পড়েছে এই সময়ে। সরাসরি বিতর্কে জড়িয়েছেন বিদ্যুৎ চক্রবর্তী। তাঁর বাসভবনের যাওয়ার রাস্তার পাশে টেন্ট করে অবস্থান করেছে ছাত্র-ছাত্রীরা। আন্দোলনকারীরা পদত্যাগ দাবি করেছে উপাচার্যের। কিন্তু নিজের সিদ্ধান্ত থেকে সরেননি উপাচার্য। ফলক বিতর্কে তৃণমূল সুপ্রিমো মমতা বন্দ্যোপাধ্য়ায়ের নির্দেশে টানা অবস্থান করেছে দলীয় কর্মী-সমর্থকরা। উপাচার্যের মেয়াদ বৃদ্ধি না হওয়ায় আন্দোলনের জয় দেখছে তৃণমূল নেতৃত্ব।
আরও পড়ুন- কালীপুজো মিটলেই বঙ্গে কনকনে ঠান্ডা? শীতের সাড়াজাগানো আপডেট জানুন
উত্তরাখণ্ডে বিশ্বভারতীর নয়া ক্যাম্পাসের পরিকল্পনার কথা বলেছিলেন প্রাক্তন উপাচার্য বিদ্যুৎ চক্রবর্তী। নানা বিতর্কের মাঝে এই ক্যাম্পাস তৈরির কাজ সেভাবে শুরুই হয়নি। আশ্রমিক সুপ্রিয় ঠাকুর, সুবীর বন্দ্যোপাধ্যার বারে বারে অভিযোগ করেছেন, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মুক্ত চিন্তা-ভাবনার কথা আটকে গিয়েছে বিদ্যুৎ চক্রবর্তীর আমলে। এমনকী উঁচু দেওয়ালই দেওয়া হয়েছে কোনও কোনও জায়গায়। গতানুগতিক পড়াশুনা নয়, শিল্পকর্ম নয়, গতের বাইরে গিয়ে শিক্ষার কথা ভেবেছিলেন কবিগুরু। সব ক্ষেত্রেই ১০টা-৫টার মতো সময়ের বিষয় নয়। তা বারে বারে বাধা পেয়েছে, বলেছেন অধিকাংশ আশ্রমিক। এবার সেই মুক্তমনা পরিবেশ কতটা ফিরে আসবে সেটাই এখন দেখার।