বাংলায় রাজনীতিতে কান পাতলেই শোনা যায় শাসকদলের মুষ্টিমেয় সাংসদ যোগাযোগ রাখছেন বিজেপির সঙ্গে। এই দাবি করে আসছেন বিজেপি নেতা মুকুল রায়, পাশাপাশি দলের অন্দরের বৈঠকে বিজেপি যোগ নিয়ে হুঁশিয়ারি দিয়ে তাকেই যেন মান্যতা দেন তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তবে তৃণমূল, বিজেপি দুই যুযুধান পক্ষই নয়, এই বাংলায় এখন কংগ্রেস ও সিপিএমেও সমানে চলছে এই খেলা। অভিজ্ঞ মহলের মতে, এই দলবদলে সংশ্লিষ্ট দলে শক্তি বৃদ্ধি পেয়েছে বলে প্রচার করা হয়। কিন্তু একইসঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতার নজিরও সৃষ্টি হয়।
দলবদল, ভোলবদল। নির্বাচন এলেই এর গুরুত্ব বেড়ে যায় রাজনৈতিক মহলে। বাংলার রাজনীতিতে তৃণমূল জমানায় এই দলবলের রাজনীতি বেড়েছে বহুমাত্রায়। এখন সিপিএমের মত বামপন্থী দলেও যোগ দেওয়ার ঘটনা প্রচার করা হয় ফলাও করে। বাদ যাচ্ছে না কংগ্রেসও। তৃণমূল-বিজেপি এখন রাজ্যের দুই প্রধান প্রতিপক্ষ। সেক্ষেত্রে দলবদলের বাজারে তাদের 'কদর' যে অন্যদের থেকে অনেকটাই বেশি থাকবে তা নিয়ে একমত রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞরা।
আরও পড়ুন: আগে তৃণমূল পরে বিজেপি, প্রার্থী তালিকা নিয়ে কৌশলী মুরলীধর সেন লেন
২০১১ তে রাজ্যে তৃণমূল ক্ষমতায় আসার কিছু সময় পরেই কংগ্রেস ও তৃণমূল কংগ্রেসের মধ্যে জোট ছিন্ন হয়ে যায়। তারপরই একসময়ের দাপুটে রাজ্য নেতা মানস ভুঁইয়া সহ একাধিক কংগ্রেস বিধায়ক তৃণমূল কংগ্রেসে যোগ দেন। পরবর্তীতে ২০১৬ বিধানসভা নির্বাচনের পর এতজন কংগ্রেস বিধায়ক দল ছেড়েছেন, যে বিধানসভায় বিরোধী দলনেতার পদটাও কংগ্রেসের দখলে থাকার কথা নয়। রাজনৈতিক মহল জানে, এই দলবদলের খেলায় তৃণমূলের মূল কারিগর এখন অন্য দলের কান্ডারী। স্বাভাবিক ভাবেই সেই দলও যেভাবে হোক দলবদলে যে তৃণমূল সহ অন্যদের টেক্কা দিতে চাইবে, তা নিয়েও কোনও সন্দেহ নেই।
উল্লেখযোগ্যভাবে, কলকাতা ছাড়িয়ে এখন বাংলার দলবদলের রাজনীতি পৌঁছে গিয়েছে রাজধানী শহর দিল্লিতে। দলবদলকে জাতীয় স্তরে নিয়ে গিয়েছেন মুকুল রায়। তাঁকে টেক্কা দিতে তৃণমূল কংগ্রেসকেও অতএব এগিয়ে এসে খেলতে হচ্ছে। বিজেপির চন্দন মিত্র কলকাতায় এসে যোগ দিয়েছেন তৃণমূলে। গত ১৯ জানুয়ারি ব্রিগেড ময়দানে তৃণমূলের সভায় এসেছেন বিজেপির তিন বিক্ষুব্ধ নেতা।
আরও পড়ুন, রাজ্যে একাই লড়বে তৃণমূল কংগ্রেস: মমতা
কিন্তু রাজনৈতিক মহল এই দুই দলের দলবদলের খেলার পাশাপাশি নজর রেখেছে কংগ্রেস ও সিপিএমের ওপরেও। সিপিএমে প্রাথমিক সদস্যপদ পেতে বিস্তর কাটখড় পোড়াতে হয়। অন্তত আমরা তাই জানতাম। সেই সিপিএমেও এখন যোগদানের পর্ব চলছে।
সোমেন মিত্র রাজ্য কংগ্রেস সভাপতি হওয়ার পর দলের রাজ্য দপ্তরে দলবদলের অনেক ঘটনাই ঘটেছে। মোটের ওপর এরাজ্যের সংখ্যালঘুরা কংগ্রেসের ওপর ভরসা রাখছে, এমন বার্তাই দিতে চাইছে রাজ্য কংগ্রেস। এমনকী মুর্শিদাবাদে অধীর চৌধুরির দুর্গেও অনেক পুরানো কংগ্রেস কর্মী আনুষ্ঠানিক দলবদল করে ঘরে ফিরেছেন। তাই ফলাও করে প্রচার করেছে কংগ্রেস। সব মিলিয়ে এরাজ্যে দলবদল যে আনুষ্ঠানিক রূপ পেয়েছে তা নিয়ে কোনও সন্দেহ নেই। রাজনীতিতে দলবদল না দলবদলটাই রাজনীতি, খেই হারাচ্ছেন বোদ্ধারাও।
আরও পড়ুন,বাংলায় তৃণমূল-বিজেপি বিরোধী ভোট একত্র করতে ‘হাত’ ধরার পথে সিপিএম
যে দলেই যে স্তরের নেতাই যোগ দিন না কেন, সেই দল তাতেই "শক্তিশালী" হয়ে যায়। আর যে দলে ছিলেন, সেই দলের "বিস্তর ক্ষতিসাধন" হয়। এটাই 'নতুন' দলের সাধারণ বক্তব্য। তার পাশাপাশি আরও নানান বার্তা তো রয়েছেই। বিজেপির দিকে ঝুঁকছেন শাসকদলের সাংসদ ও বিধায়করা। এই দাবি করে আসছে পদ্মশিবির। এখন পর্যন্ত একজন সাংসদ যোগ দিয়েছেন। বিষ্ণপুরের তৃণমূল প্রতীকে জয়ী সৌমিত্র খাঁ। লোকসভার নির্বাচন দোরগোড়ায়। কিন্তু আর কেউ আর এগোচ্ছেন না গেরুয়া শিবিরে। মায় একজন তৃণমূল বিধায়ক পর্যন্ত যোগ দেন নি। স্রেফ জল্পনার জোরেই তোলপাড় রাজ্য রাজনীতি।
রোজ ভ্যালি, সারদা, নারদা যোগদানের কাহিনী, রাজনীতির অন্দরমহলে। ঠিক সময় হলে নাকি বাকিরা ঝাঁপিয়ে পড়বে। অভিজ্ঞ মহলের মতে, এটাই একধরনের চাপের খেলা। বোঝানো, "তুমি যাঁদের ভরসায় ময়দানে নামছ, তাঁরা কিন্তু ভেতরে ভেতরে আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছেন।" আর এক বিশ্বাসভঙ্গের রাজনীতি। বিশ্বাসঘাতকতার রাজনীতি।
আরও পড়ুন: ভোটের আগেই জোট, ঘোষণা মমতার
মীরজাফর বিশ্বাসঘাতকতা করেছিলেন কী না, তা নিয়ে মতপার্থক্য আছে ইতিহাসবিদদের মধ্যে। কিন্তু মালদা উত্তরের সাংসদ মৌসম বেনজির নূর যে কংগ্রেসের সঙ্গে 'বিশ্বাসঘাতকতা' করেছেন, এ নিয়ে কোনো দ্বিমত নেই রাজ্য কংগ্রেস সভাপতি সোমেন মিত্র, সাংসদ প্রদীপ ভট্টচার্য সহ কংগ্রেস নেতৃত্বের মধ্যে। কখনও কংগ্রেস ছাড়বেন না বলেই তিনি নাকি কথা দিয়েছিলেন 'সোমেন মামাকে'। কিন্তু মৌসম একেবারে নবান্নে গিয়ে যোগ দেন তৃণমূলে, দল এবং সরকারকে এক করে।
মালদা উত্তরের নির্বাচনের ফলেই টের পাওয়া যাবে তাঁর তৃণমূলে যোগদান সেখানকার মানুষ কীভাবে নিয়েছেন। চারজন নেতার কংগ্রেসে উপস্থিতি নিয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় একদা কংগ্রেস ছেড়েছিলেন। তাদের মধ্যে ছিলেন নদিয়ার বিধায়ক শঙ্কর সিং। সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে তিনি কংগ্রেস থেকে আজ তৃণমূলে।
রাজনীতি ও দলবদল এখন আর নেতৃত্বের মধ্যেই শুধু সীমাবদ্ধ নেই। সেই হাওয়া সমানে চলছে নীচুতলার কর্মীদের মধ্যেও। শুধু নেতাদের হাত ধরেই নয়, তাঁরা নিজেরাও এখন প্রস্তুত হাওয়ায় গা ভাসিয়ে দিতে। শুধু যেন সময়ের অপেক্ষা। কারও ক্ষমতায় থেকে যাওয়ার প্রচেষ্টা, কারও বদলার দলবদল।