দিল্লির সাম্প্রতিক হিংসা বহু মানুষকেই বিচলিত করেছে। বাংলা বিনোদন জগতের বহু ব্যক্তিত্বই সোশাল মিডিয়ায় এবং তার বাইরেও প্রতিবাদ করেছেন। কিন্তু শুধু মৌখিক প্রতিবাদ নয়, অভিনেত্রী সুভদ্রা মুখোপাধ্যায় আনুষ্ঠানিকভাবেই পদত্যাগ করেছেন বিজেপি-র সদস্যপদ থেকে। এই প্রসঙ্গে ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসকে দেওয়া বিশেষ সাক্ষাৎকারে অভিনেত্রী স্পষ্ট করে জানালেন তাঁর এই সিদ্ধান্তের কারণ--
ঠিক কী কারণে আপনি এমন একটি সিদ্ধান্ত নিলেন সেটা যদি একটু বলেন। এটা কি দিল্লির সাম্প্রতিক হিংসাত্মক ঘটনাগুলির জন্য?
আমি ২০১৩-তে বিজেপি জয়েন করি। ওই সময় মোদীজিকে দেখে অত্যন্ত উদ্বুদ্ধ হয়েছিলাম যে একটা মানুষ আমার দেশের জন্য, দশের জন্য এতটা ভাবছে। আমি ভেবেছিলাম তাঁর স্বপ্নকে সত্যি করার জন্য, তাঁর পায়ের তলার কর্মী হয়ে আমি কাজ করব। আমি বরাবর ওইভাবেই দলে থেকেছি। কোনওদিন কোনও পদ চাইনি। আমি নিজেকে সাধারণ কর্মীই মনে করি। কিন্তু তাঁর যে ভাবনা দেখে আমি প্রলুব্ধ হয়ে রাজনীতিতে এসেছিলাম, সেগুলো আর চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছি না... সবকিছু বিধ্বংসী লাগছে! ২০১৯-এর পরে যেন সব বদলে গিয়েছে।
আরও পড়ুন: Delhi violence LIVE updates: দিল্লি হিংসায় মৃত্যুমিছিল অব্যাহত, নিহত বেড়ে ৩৭
অর্থাৎ সাম্প্রতিক ঘটনাগুলোই আপনাকে এই সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য করেছে?
সব মানুষরাই তো দেখছে যে দেশ কীভাবে জ্বলছে। আমাদের দেশের সম্পর্কে বলা হতো-- বিভেদের মাঝে থাকে মিলন মহান। এতগুলো ভাষার লোক, এতগুলো জাতির লোক এই দেশে বাস করে। কবিতায় তো সেই কথাই বলা রয়েছে। সেই ভারতে আজ কী হচ্ছে। আমাদের সন্তানরা কী দেখবে-- খালি হিংসা ও মারপিট? আমরা দেশের কথা ভুলে যাচ্ছি। দেশের উন্নয়ন প্রয়োজন, সে সব কথা ভুলে যাচ্ছি।
সমাজকল্যাণমূলক কাজের ভাবনা থেকেই কি আপনার রাজনীতিতে আসা?
আমি রাজনীতিতে আসার অনেক আগে থেকেই সোশাল ওয়ার্ক করি, এখনও করে যাচ্ছি। মানুষের কষ্টের পাশে বরাবর দাঁড়াতে ভালবাসি। ওটা রক্তের মধ্যে মিশে যায়। আমি রাজনীতি অত বুঝি না। আমি ভীষণই সাধারণ। একদম পায়ের তলায় থেকে মানুষের জন্য কাজ করব ভেবেই আসা। এমপি নির্বাচনের সময় আমাকে বলা হয়েছিল দাঁড়াতে। আমি বলেছিলাম আমি রেডি নই। কোনওদিন কোনও পদ পাব বলে বিজেপি-তে আসিনি।
কিন্ত ইদানীং মাথার উপরে যাঁরা রয়েছেন, তাঁরা নানান পন্থী হয়ে গিয়েছেন। আমি সরল মানুষ। মোদীজির যে কথা আমাকে উদ্বুদ্ধ করত যে দেশ বড় হবে... 'আচ্ছে দিন আয়েঙ্গে'। কিন্তু দেশ কোথায় এসে দাঁড়িয়েছে? চারদিকে কালো ধোঁয়া ছাড়া তো আর কিচ্ছু নেই। একটা ন-মাসের বাচ্চাকে পুড়িয়ে মারা হলো! মনুষ্যত্ব হারিয়ে ফেলে দেশ কী করে এগোবে? আমি জানি না কারা করছে এই কাজ - কিন্তু কোনও একজন মানুষ তো করেছে। কোন দিকে যাচ্ছি আমরা?
আরও পড়ুন: ডিসকভারি চ্যানেলে ‘থালাইভা’! আসছে রজনীকান্তের বিশেষ এপিসোড
কিন্তু এই ধরনের হিংসা তো প্রথম নয়। গুজরাটের দাঙ্গায় এক সন্তানসম্ভবার পেট চিরে গর্ভস্থ শিশুকে জ্বালিয়ে দেওয়া হয়। সেটা ২০০২। আর আপনি রাজনীতিতে আসেন ২০১৩-তে। ওই দাঙ্গার সময় যে যে সংগঠন ও রাজনৈতিক দলের ভূমিকা প্রশ্নচিহ্নের মুখে পড়ে, তার মধ্যে কিন্তু বিজেপি এবং আরএসএস-এর নামও ছিল।
ওই সময় আমি দলটিকে বেনেফিট অফ ডাউট দিয়েছিলাম বলতে পারেন। আমার মনে হয়েছিল, যা যা হিংসাত্মক ঘটনা ঘটেছে দেশে, তা আর ঘটবে না। তখন একটা অন্যরকম আবহাওয়া ছিল। মোদীজির অনেক কথাই আমাকে খুব উদ্বুদ্ধ করত। তার মধ্যে যে স্লোগানটি সেই সময় সবচেয়ে বেশি নাড়া দিয়েছিল, সেটা হল 'সবকা সাথ, সবকা বিকাশ'। আমার বরাবরই লক্ষ্য ছিল সোশাল সার্ভিস। মনে হয়েছিল যদি কোনও ভালো পলিটিকাল প্ল্যাটফর্ম পাওয়া যায়, তাহলে সোশাল সার্ভিস আরও বেশি করে করতে পারব। সেটাই আমার মূল উদ্দেশ্য ছিল। আর পরে কিন্তু গুজরাট দাঙ্গার সব অভিযোগ থেকে মোদীজি ও বাকিদের মুক্ত করে দেওয়া হয়।
কিন্তু আজকে যেটা হচ্ছে, সেটা মেনে নিতে পারছি না। আজ সিএএ-তে বলা হচ্ছে যে বাংলাদেশ, আফগানিস্তান, পাকিস্তানে ১৪ লাখ হিন্দু রয়েছেন, তাঁরা অসহায়। আমরা সাগ্রহে তাঁদের অ্যাকসেপ্ট করব। কিন্তু তার জন্য ১৩৫ কোটি মানুষ, যাঁরা অলরেডি ইন্ডিয়ান, তাঁদের বিপদে ফেলে দেব। তাঁদের কাগজ দেখাতে বলব? তাঁরা ভোট দিয়েছেন বলেই তো বিজেপি সরকারে এসেছে। যারা ভোট দিয়ে সরকারে নিয়ে এল, তাদেরই দেশের বাইরে পাঠাব। তাদের আইডেন্টিটি যদি ইনভ্য়ালিড হয় তাহলে তো ভোটটাও ইনভ্যালিড। আর সেই ভোটে নির্বাচিত সরকারও ইনভ্যালিড। চোর ধরতে গিয়ে বাড়ির লোককেই বাড়ি থেকে বার করে দেব, দেশে যুদ্ধ লাগিয়ে দেব। তাহলে দেশের উন্নতি কী করে করব?
এই যে টাকাপয়সা এদিক-ওদিক হচ্ছে... স্লাম ঢাকতে দেওয়াল তুলে দেওয়া হলো। যে টাকা খরচ করে দেওয়াল তোলা হলো, সেই টাকা দিয়ে তো ওই ঝুপড়ির মানুষদের জন্য পাকাবাড়ি তৈরি করে দেওয়া যেত। আগেও কিছু মানুষ গোঁড়া ছিলেন। কিন্তু এত হিংসা ছিল না। একজন মানুষ দলিত বলে তার শরীরে স্ক্রু ডাইভার ঢুকিয়ে দেব?? এটা কী সিস্টেম??
আরও পড়ুন: অশান্ত রাজধানীতে শান্তি পুনঃপ্রতিষ্ঠার দায়িত্ব সরকারের: আরএসএস
আপনি এই বিষয়গুলো নিয়ে দলের মধ্যে কথা বলেননি? দলের নেতৃত্ব কী বলছেন?
আমি বলেছি। আরএসএস-এর কয়েকজন সদস্যের সঙ্গে কথা বলেছি। আর পার্টির অনেকের সঙ্গেই কথা বলেছি। তাঁরা অনবরত বলে গিয়েছেন, আরে তুমি ঠান্ডা হও। আরে দেখো না সব ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু আমি আর ওই সব আশ্বাসবাণীতে বিশ্বাসী নই।
দলের সদস্যদের মধ্যে শুধু কি আপনিই এই সাম্প্রতিক ঘটনাগুলি নিয়ে বিধ্বস্ত, নাকি আরও অনেকেই রয়েছেন আপনার মতো?
অনেকে অনেক কথা বলছেন। অনেকে বলছেন, কী করব বুঝতে পারছি না। কিন্তু আমি আমার ভিশনে পুরোপুরি ক্লিয়ার। এই রাজনৈতিক গোষ্ঠীর সঙ্গে আমি আর থাকতে পারব না। আমি আর কোনও দ্বিচারিতা করতে পারব না। আমি মানুষের জন্য কাজ করতে এসেছিলাম, আমি মানুষের সঙ্গে থাকব। আমরা আর্টিস্ট মানুষরা খুব ইমোশনাল তো। এটা বলতে পারি যে সম্প্রতি যা যা ঘটেছে, অনেকের মধ্যেই কিন্তু একটা সংশয় দানা বেঁধেছে। আমি আগে বেরোলাম।
আপনি কি এখন অন্য কোনও রাজনৈতিক দলে যোগদান করার কথা ভাবছেন?
আবার কোনও একটা দলে ঢুকে পড়তে হবে, এমন কোনও মানে নেই। আমি নগণ্য মানুষ। সাধারণ কার্যকর্তা। আমার মনে হয়েছে আমি ওই দলে সুটেবল নই, তাই সরে এসেছি। আপাতত আমি আমার মতো করে কাজ করব। ভবিষ্যতে যদি মনে হয় যে আমার ভাবনা-চিন্তার সঙ্গে কোনও রাজনৈতিক দলের ভাবনা মিলছে, তখন আবার ভেবে দেখব। সোশাল ওয়ার্ক আগেও যেমন করতাম এখনও করব। ওটা আমার নেচার, পাবলিসিটির জন্য কখনও করিনি। সারা জীবন মানুষের পাশে থাকব, কোনও পার্টিতে থাকি আর না থাকি।
ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা এখন টেলিগ্রামে, পড়তে থাকুন