দেবস্মিতা দাস
বাংলা ছবির সঙ্গে কলকাতার সিনেমা হলের কী সম্পর্ক?
দৃশ্যত তারা একে অপরের পাশেই আছে অথচ ব্যবসার নিরিখে দাঁড়িয়ে আছে পরস্পরের বিরূদ্ধে। আগে অভিযোগ ছিল বাংলা ছবি চিত্রনাট্য নাকি দর্শক নিচ্ছেন না। ফলে সিনেমা হল চলছে না। পরিত্রাতা হতে হচ্ছে হিন্দি সিনেমাকে। এখন বদল এসেছে বাংলা সিনেমার চেনা চিত্রে। ছবির ভাষা বদলেছে, দর্শকও হলে ফিরেছেন। তবুও সমস্যার সুরাহা হয়নি।
প্রায়ই অভিযোগ শোনা যাচ্ছে, বাংলা ছবিকে নস্যাৎ করে দিয়ে কলকাতার হল কাঁপাচ্ছে হিন্দি এবং ইংরাজি সিনেমা। কিছুদিন আগেই নিজের ছবির হামি'র শো টাইম নিয়ে সরব হয়েছিলেন পরিচালক শিবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়। একটি সংবাদপত্রে নাম উল্লেখ করে বলেছিলেন প্রিয়া সিনেমার কর্ণধার অরিজিৎ দত্ত হিন্দি সিনেমা 'রাজি' চালানোর জন্য 'হামিকে' শো টাইম দিতে পারবেন না। একরম ঘটনা বিরল নয়। এর আগে হল যুদ্ধে কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়ের 'বিসর্জন' পরাস্ত হয়েছিল দক্ষিণি 'বাহুবলীর' কাছে। সাম্প্রতিক অতীতে কমলেশ্বর মুখোপাধ্যায়ের 'গুড নাইট সিটিরও' একই দশা হয়েছে। বাংলা ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির ভালমন্দ নিয়ে কি তাহলে সত্যিই কলকাতার হলমালিকরা আদৌ ভাবিত নন?
একথা মানতে নারাজ প্রিয়ার অরিজিৎ দত্ত। তাঁর বক্তব্য, "প্রিয়া সবসময়েই বাংলা ছবিকে প্রায়োরিটি দিয়ে এসেছে। কিন্তু আমায় ব্যবসা এবং কমিটমেন্টের কথাটাও মাথায় রাখতে হয়। যদি কোনও বাংলা ছবি ভাল না হয়, সেটা আমরা প্রাইম শোতে রাখতে পারব না। এখানে ক্ষতি দুপক্ষেরই। আর সব হলে বাংলা ছবি চলে না। হিন্দ সিনেমা, প্যারাডাইস, নিউ এম্পায়ার এগুলোতে বাংলা চলবে না। তেমনই দর্পণায় হিন্দি ছবি চলবে না। এই কমার্সটা তো বুঝতে হবে।"
আরও পড়ুন: ছবির মিউজিক লঞ্চে সাংবাদিকদের সঙ্গে অভব্য আচরণ টিম জিতের
শিবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় মনে করেন, সমস্যার সমাধানে এগিয়ে আসা উচিত ইন্ডাস্ট্রির সঙ্গে যুক্ত মানুষদেরই। 'হামির' পরিচালকের বক্তব্য, "হল না পাওয়ার সমস্যায় নতুন পরিচালকদের ভুগতে হয় ঠিকই। কিন্তু নিজেকে প্রমাণ করতে পারলে দর্শক ছবি দেখবেনই। আর এই সমস্যার সমাধানের জন্য ইম্পার (EIMPA, Eastern India Motion Pictures Association) হস্তক্ষেপ প্রয়োজন।"
পরিস্থিতি নিয়ে যথেষ্ট হতাশ কমলেশ্বর মুখোপাধ্যায়। সম্ভবত সে কারণেই কিঞ্চিৎ মরিয়াভাবে তিনি বলেন, "মহারাষ্ট্র বা দক্ষিণের মতো নিয়ম বেঁধে দিলে পরিস্থিতির কিছুটা সুরাহা হতে পারে।" অর্থাৎ, রাজ্য সরকার যদি ফরমান জারি করেন, যে দিনের কিছু বিশেষ সময়ে আঞ্চলিক ভাষার ছবি দেখাতেই হবে সব প্রেক্ষাগৃহকেই, তবেই রাহুর দশা কাটবে। শুধু তাই নয়, তাঁর শেষ ছবি হলে সুযোগই পায়নি বলে আক্ষেপ করেছেন 'গুড নাইট সিটি'-র পরিচালক। তাঁর অভিজ্ঞতায়, "সিনেমার কনটেন্ট ভাল না খারাপ সে বিচারের সুযোগই দর্শক অনেক সময়ে পেয়ে উঠছেন না। ছবি তৈরি অনেক হচ্ছে, সে তুলনায় হলের সংখ্যা কম।"
সম্প্রতি মুক্তি পাওয়া 'রেনবো জেলি' অবশ্য অপেক্ষাকৃত ভাল অবস্থায় আছে। পরিচালক সৌকর্য ঘোষাল জানালেন, দ্বিতীয় সপ্তাহে তাঁদের ছবি হলে ৯০ শতাংশ দর্শক টানতে সক্ষম হয়েছে। ফলে তৃতীয় সপ্তাহেও ভাল শো টাইম পেয়েছেন তিনি। তবে যা চলছে, সে পরিস্থিতি বদলাতে তাঁর টোটকা, "একমাত্র দর্শকই পারেন এর হেরফের ঘটাতে। সারা ভারতবর্ষেই তো একই অবস্থা চলছে।"
আরও পড়ুন: Byomkesh Bakshi: শুটিং ফ্লোরে আসছে ‘ব্যোমকেশ গোত্র’, হয়ে গেল মহরৎ
অরিজিৎবাবু যে ব্যবসায়িক দিকের কথা বলছিলেন তার পুনরাবৃত্তি শোনা গেল সিঙ্গল স্ক্রিন হল মিত্রার কর্ণধারের মুখেও। দীপেন মিত্রর সাফ বক্তব্য, "ব্যবসা করতে নেমেছি, যা বিক্রি হবে তাই বেশি চালাব। আমি সবসময়েই বাংলা ছবি চালাই, কিন্তু সামনের হপ্তায় সলমন খানের রেস থ্রি চালাব।" তাঁর কন্ঠে বাংলা ছবির পরিচালক-প্রযোজকদের প্রতি চ্যালেঞ্জের সুর, "বাংলায় চলার মত ছবি হয় নাকি? কোয়ালিটি না থাকলে কোয়ান্টিটি দিয়ে তো ব্যবসা চলবে না।"
অর্থনীতিই যে মুখ্য, তা স্পষ্ট আইনক্সের আঞ্চলিক অধিকর্তা শুভাশিস গঙ্গোপাধ্যায়ের কথায়। "বাংলা সিনেমা যদি চলে, তাহলে ১০০ দিন চালানো হবে। কিন্তু সিনেমা চলতে হবে, সেটা প্রাথমিক শর্ত।" তিনি মনে করিয়ে দিলেন, গত ১০ বছরেরও বেশি সময় ধরে বিভিন্ন বাংলা ছবি চলেছে আইনক্সের বিভিন্ন স্ক্রিনগুলিতে।
ইম্পা-র কৃষ্ণ দাগা জানিয়েছেন, এ নিয়ে আলোচনা চলছে, এমনকি কিছুদিনের মধ্যে সমাধানসূত্র মিলবে বলে আশাও প্রকাশ করেছেন তিনি।
নতুন রকম ছবির ভাষায় নতুন ধরনের বাংলা ছবিও কি শেষ পর্যন্ত পুরনো জায়গাতেই পড়ে থাকছে? আঞ্চলিক ভাষার ছবি হিসেবে দর্শকধন্য হয়ে ওঠার পথে কি বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে সে নিজেই? নাকি দেশ জুড়ে আঞ্চলিক ভাষাকে দমিয়ে রাখার যে চক্রান্তের অভিযোগ ওঠে মাঝে মাঝেই, তার শিকার হচ্ছে টালিগঞ্জ? কোন এক ফেলু মিত্তির কি কোথাও বলে উঠছেন, "ভালো ঠেকছে না রে তোপসে!"