সবসময়ে একটা-দুটো বই সঙ্গে রাখতেন সুশান্ত। 'শো-বিজ'-এর লঘুতা থেকে দূরে তাঁর যে একটা নিজস্ব ভাবনা ও বৌদ্ধিক চর্চার জগৎ রয়েছে, সেই নিয়ে বেশ গর্ববোধ ছিল সুশান্তের, এমনটাই জানিয়েছেন দিবাকর বন্দ্যোপাধ্যায় একটি সাম্প্রতিক সাক্ষাৎকারে। ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ থেকে আসা হাসিখুশি এক ছোকরা, যে কি না নাচ ভালবাসে, কষ্ট করে ঠিক বলিউডে তার জায়গা করে নেয় নিষ্ঠা, স্থির লক্ষ্য ও ইচ্ছাশক্তির জোরে - এভাবেই সুশান্তকে দেখেছেন 'ডিটেকটিভ ব্যোমকেশ বক্সী'-পরিচালক।
রবিবার মুম্বইয়ের বান্দ্রাতে, নিজস্ব অ্যাপার্টমেন্টে মৃত অবস্থায় পাওয়া যায় সুশান্তকে। মাত্র ৩৪ বছর বয়সে, বন্ধুবান্ধব-আত্মীয়স্বজনদের বাকরুদ্ধ করে চলে গিয়েছেন সুশান্ত সিং রাজপুত। মধ্যমেধাসম্পন্ন, অধ্যবসায়হীন, বলিউডের প্রতিষ্ঠিত অভিজাত বৃত্তের বাইরে থেকে আসা একজন পরিশ্রমী ও নিষ্ঠাবান অভিনেতা, সুশান্ত সিং রাজপুতকে ফিরে দেখেছেন দিবাকর বন্দ্যোপাধ্যায়, সম্প্রতি পিটিআই-কে দেওয়া একটি সাক্ষাৎকারে।
আরও পড়ুন: ‘আমার মনের একটা অংশ তোমার সঙ্গে চলে গেল’
সেই সাক্ষাৎকারের নির্বাচিত অংশ রইল:
সুশান্তের কেরিয়ারের একদম প্রথমদিকে ওকে নিয়ে কাজ করেছেন আপনি। ডিটেকটিভ ব্যোমকশে বক্সী ছবিতে ওঁকে কাস্ট করার মূল কারণটা কী ছিল?
বেশ কোমল একটা ব্যক্তিত্ব, তীব্র আবেগ আর বলিউডের গড়পড়তা কাজের থেকে অন্য রকম কিছু করার উচ্চাকাঙ্ক্ষা।
অভিনেতা সুশান্ত ও ব্যক্তি সুশান্তের স্মৃতিগুলি নিয়ে কিছু যদি বলেন
অভিনেতা হিসেবে ওকে দেখতাম, কোনও সিনের আগে খুব উত্তেজিত থাকত। টেকের পর টেক আর ও ক্রমশ ডুবে যেত। প্রস্তুতিতে খুব গুরুত্ব দিত। শুটের আগের দিন রাত জেগে হলেও সিনগুলো পড়ত ভাল করে, নোটস নিত। তার পর যখন সিন করতে আসত, তখন পুরোপুরি প্রস্তুত।
ব্যোমকেশের শুটিংয়ের সময় ও সব সময়েই ১০০ শতাংশ দিয়েছে - যতটা কঠিন শিডিউল হোক না কেন। তারকা বলে ইউনিটকে আলাদা করে কোনও কিছু ভাবতে হতো না। ওভাবেই মনে আছে সুশান্তকে - পুরোপুরি লক্ষ্যস্থির, একনিষ্ঠ আর প্রাণশক্তিতে ভরপুর।
আর ব্যক্তি সুশান্তের কথা যদি বলা যায় - আমার কাছে সুশান্ত হলো ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ থেকে আসা হাসিখুশি এক ছোকরা, যে ঠিক কষ্ট করে 'শো-বিজ'এ নিজের জায়গাটা তৈরি করে ফেলতে পেরেছে, আর অভিনয় নিয়ে অত্যন্ত সিরিয়াস। তবে কলেজের দিনগুলোকে খুব মিস করত। সেই নিয়ে আমরা খুবই হাসাহাসি করতাম মনে আছে।
সুশান্তের বন্ধুরা বলেন বই নিয়ে, জ্যোতির্বিজ্ঞানের প্রতি ওঁর ভালবাসা নিয়ে অনেক বেশি কথা বলতেন, তুলনায় ফিল্ম, সিনেমার ভবিষ্যৎ ইত্যাদি নিয়ে কম। ইন্ডাস্ট্রির কোনও অভিনেতাদের বিচার করলে এটা খুবই বিরল।
পুরোপুরি সত্যি। বিজ্ঞান, বিশেষত জ্যোতির্বিজ্ঞান অন্ত প্রাণ ছিল। সব সময়েই একটা-দুটো বই সঙ্গে রাখত সুশান্ত। 'শো-বিজ'-এর লঘুতা থেকে দূরে ওর যে একটা নিজস্ব ভাবনা ও বৌদ্ধিক চর্চার জগৎ রয়েছে, সেই নিয়ে বেশ গর্ব ছিল ওর মধ্যে। বলিউডের পাঁক যাতে পুরোপুরি ওকে ঢেকে না ফেলতে পারে, তার জন্য নিজেকে বাঁচাতে এটা একটা রিফ্লেক্স প্রোটেক্টিভ অ্যাকশন বলেই আমার মনে হয়। নিজের এই আলাদা সত্তাকে যত্ন করে ও বাঁচিয়ে রাখতে চাইত।
আরও পড়ুন: সুশান্ত সিং রাজপুতের স্মৃতিতে ওয়েবসাইট লঞ্চ করছে তাঁর টিম
সুশান্তের মৃত্যুর পরে যে কথাগুলি আবার উঠে আসছে - বাইরে থেকে যাঁরা বলিউডে আসছেন তাঁদের একঘরে হয়ে থাকা এবং ইন্ডাস্ট্রির স্বজনপোষণের সংস্কৃতি। আপনার কি মনে হয় সুশান্ত খুব সফল অভিনেতা হওয়ার পরেও সেই লড়াইটা চালিয়ে যাচ্ছিলেন?
লড়াই আমাদের সকলকে করতে হয়, রাতদিন - সফল হই আর না হই। এখানে এই সাফল্য আর অসাফল্য বলতে কী বুঝব, সেটা নিজেকেই ঠিক করতে হয়। প্রতিষ্ঠান কী মনে করছে, সেই ভাবনাকে মনের মধ্যে বাসা বাঁধতে দিলে চলে না। যাঁরা এটা ভাল করে বোঝেন, তাঁরাই সমস্ত ঝড়ঝাপটা কাটিয়ে টিকে যান।
এই গোটা ব্যাপারটায় যা সবচেয়ে দুঃখজনক তা হলো, যদি কেউ বলিউডের নিজস্ব অভিজাত বৃত্তের বাইরে থেকে আসেন, তখন তাঁকে দ্বিগুণ পরিশ্রম করতে হয়, দ্বিগুণ প্রতিভারও প্রয়োজন হয়। প্রতি মুহূর্তে তাঁকে প্রমাণ করতে হয় যে বলিউডের নিজের ঘরের মধ্যমেধাসম্পন্ন, উদ্যমহীন যে কোনও ছাপমারা এলিটের মতোই বক্স-অফিসে ঝড় তুলতে তিনি সমান দক্ষ।
মিডিয়া সব সময়েই এই এলিটদের পরিবার-পরিজন নিয়ে ভজন গাইতে ও তারকাপুজো করতে ব্যস্ত থাকে। এখান থেকেই গভীর রাগ ও হতাশা আসে। যাঁরা এটা পেরিয়ে যেতে পারেন, তাঁরা থেকে যান। যাঁরা পারেন না, যাঁরা অনেকটা বেশি কোমল হয়, ঝুঁকিটা সব সময়েই তাঁদের বেশি।
ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা এখন টেলিগ্রামে, পড়তে থাকুন