ভারতীয় টেলিভিশনের ইতিহাস লিখতে বসলে শুধু একতা কাপুর ও তাঁর কে-ধারাবাহিকগুলি নিয়েই একটি গোটা খণ্ড রাখতে হবে। নব্বইয়ের মাঝামাঝি মা শোভা কাপুরকে সঙ্গে নিয়ে একতা শুরু করেন বালাজি টেলিফিল্মস। মিলেনিয়াম পার করতে না করতেই একতা কাপুর হয়ে ওঠেন একটি ফেনোমেনন। মিলেনিয়ামের পরেই ভারতীয় টেলিভিশন ইন্ডাস্ট্রির বাড়বাড়ন্তের পিছনে যাঁদের সবচেয়ে বড় অবদান রয়েছে, তাঁদের একজন অবশ্যই একতা কাপুর।
আসলে একতা কাপুর ও তাঁর ধারাবাহিক একটা প্রাতিষ্ঠানিকতার জন্ম দেয়। সমাজতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ করতে বসলে সেখানে অনেক আপত্তিকর বিষয় চোখে পড়বে। অনেকের কাছেই কে-সিরিজের কিছু ধারাবাহিকের কনটেন্ট প্রগতিশীলতার পরিপন্থী। অতিরিক্ত পারিবারিক ষড়যন্ত্র ও কূটকচালি-তে ভরপুর বলেও বহুবার সমালোচিত হয়েছে একতা কাপুরের ধারাবাহিকগুলি।
আরও পড়ুন: চলতি ধারাবাহিক ফিরলেও আপাতত বন্ধ হচ্ছে না ‘মহাপ্রভু’
কিন্তু টেলিপর্দায় ড্রামা তৈরি করার ও দর্শককে মন্ত্রমুগ্ধ করে রাখার একটি ঐশ্বরিক ক্ষমতা রয়েছে তাঁর মধ্যে। আবার সময়ের সঙ্গে সঙ্গে দর্শকের পছন্দ-অপছন্দ যখন বদলেছে, তখন সেই মতো কনটেন্টকে বদলেছেন একতা। যেমন 'কিঁউকি সাঁস ভি কভি বহু থি' যদি একটা ধাঁচ হয়ে থাকে তবে 'বড়ে অচ্ছে লাগতে হ্যায়'-এর মেজাজ আলাদা।
আবার তালিকায় সাম্প্রতিক সময়ের সবচেয়ে বেশি সমালোচিত অথচ হায়েস্ট টিআরপি ধারাবাহিক 'নাগিন'-ও রয়েছে। নাগিন-জাতীয় ধারাবাহিক নিঃসন্দেহে খুব একটা কাম্য নয় যদি দর্শকের রুচি এবং মননের পুষ্টির কথা ভাবা যায়। কিন্তু মোদ্দা ব্যাপার হল, একতা টেলি-দর্শককে মননশীল করে তোলার উদ্দেশ্য নিয়ে মাঠে নামেননি। বিনোদন চ্যানেলগুলি তেমনটা তাঁকে করতে বলেওনি। তিনি একটা ট্রেন্ড সেট করতে চেয়েছিলেন, একটা মডেল তৈরি করতে চেয়েছিলেন যা টিআরপি চার্টে বিস্ফোরণ ঘটাবে, পাশাপাশি বিপুল ব্যবসা দেবে।
জাতীয় টেলিভিশনে যত প্রযোজনা সংস্থা রয়েছে তাদের মধ্যে এই সাফল্য কিন্তু সবচেয়ে বেশি বালাজি টেলিফিল্মসের ও প্রযোজক একতা কাপুরের। এবার এক ঝলকে দেখে নেওয়া যাক প্রযোজক একতার টাইমলাইন--
১৯৯৫-- টেলি-ধারাবাহিকের প্রযোজক হিসেবে যাত্রা শুরু। চারটি সিরিজ লঞ্চ করেছিলেন একতা এই বছর। ডিডি মেট্রো চ্যানেলের জন্য 'পড়োসন' ও 'ক্যাপ্টেন হাউস'। ওই বছরই জি টিভি-তে আসে 'হাম পাঁচ' (সিজন ১) ও 'মানো ইয়া না মানো'। সিটকম ও হরর সিরিজ, পাশাপাশি দুই-ই চালিয়ে গিয়েছেন একতা প্রথম থেকেই।
২০০০-- শুরুটা জমিয়ে হলেও নব্বইয়ের শেষ দিকে একটু গতিটা শ্লথ হয়ে যায়, নতুন করে স্ট্র্যাটেজি সাজান একতা। 'ক' দিয়ে ধারাবাহিকের নামকরণ করার ট্রাডিশনটাও ওই বছর থেকেই শুরু। মোট ৯টি ধারাবাহিক লঞ্চ করে বালাজি টেলিফিল্মস ওই এক বছরে। জাতীয় টেলিভিশনে তাঁর একচেটিয়া সাম্রাজ্য স্থাপনের ওটা ছিল প্রথম ধাপ। 'কিঁউকি সাঁস ভি কভি বহু থি' এবং 'কাহানি ঘর ঘর কি'-- দুটি ধারাবাহিকই লঞ্চ হয় একসঙ্গে।
২০০১-- একদিকে একতা সাম্রাজ্যের অন্যতম সেরা হিট, 'কসৌটি জিন্দেগি কে'-র লঞ্চ অন্যদিকে বলিউড ছবির প্রযোজনা শুরু। গোবিন্দা-সুস্মিতা সেন অভিনীত ছবি 'কিঁউকি ম্যায় ঝুট নেহি বোলতা' মুক্তি পায় এই বছর। আবার ২০০১ সালেই আসে 'কহিঁ কিসি রোজ'-এর মতো পারিবারিক থ্রিলার ধারাবাহিক।
২০০৯-- এই বছর লঞ্চ করা হয় 'পবিত্র রিশতা'-- সুশান্ত সিং রাজপুত ও অঙ্কিতা লোখান্ডের জুটি এখনও দর্শক ভুলতে পারেননি। এই বছর থেকেই আবার 'ক' দিয়ে ধারাবাহিকের নামকরণের ট্রেন্ড থেকে বেরিয়ে আসেন একতা। বলা বাহুল্য তাতে খুব খারাপ কিছু হয়নি। বরং 'ব' দিয়ে রাখা নামের ধারাবাহিক সফল হয়েছে পরবর্তীকালে যেমন, ২০১১ সালের ধারাবাহিক 'বড়ে অচ্ছে লাগতে হ্যায়'।
২০১২-- 'গুমরাহ' এবং 'সাবধান ইন্ডিয়া'-র মতো জনপ্রিয় ক্রাইম সিরিজের প্রযোজনার সূচনা। আধা ফিকশন সিরিজেও বেশ সফল বালাজি টেলিফিল্মস।
২০১৪-- এই বছর লঞ্চ হয় 'কুমকুম ভাগ্য' যা এখনও চলছে। জাতীয় টেলিভিশনের দীর্ঘতম ও সফলতম ধারাবাহিকগুলির একটি। এখনও এই ধারাবাহিকের টিআরপি শীর্ষেই ঘোরাফেরা করে। অবশ্য তার ঠিক আগের বছর লঞ্চ হওয়া ধারাবাহিক 'ইয়ে হ্যায় মহব্বতেঁ'-র কথাও উল্লেখ করতে হয়। গত বছর শেষ হয়েছে ধারাবাহিকটি।
আরও পড়ুন: ক্ষুরধার চরিত্রে সুস্মিতার কামব্যাক, মুক্তি পেল ‘আর্য্যা’-র ট্রেলার
২০১৫-- 'নাগিন' সিরিজের সূত্রপাত। কিছুদিন আগেই একতা ঘোষণা করেছেন যে সিজন ৫-এর কাজ শুরু হয়ে গিয়েছে। এই ফ্যান্টাসি ধারাবাহিকটির মতো সফল প্রযোজনা জাতীয় টেলিভিশনে বিরল। বলা যায় টিআরপি টানার একটি নতুন মডেল তৈরি করেছে 'নাগিন'।
২০১৭-- অল্ট বালাজি প্ল্যাটফর্ম-এর সূচনা। ভারতীয় দর্শককে ওয়েব সিরিজে অভ্যস্ত করিয়েছে কিন্তু অল্ট বালাজি। তখনও মানুষ নেটফ্লিক্স-অ্যামাজন প্রাইমে ডুবে থাকতে শেখেনি। ঠিক যেমন একতা বিপুল সংখ্যক দর্শককে সারা সন্ধ্যা টিভির সামনে বসে থাকতে বাধ্য করেছিলেন মিলেনিয়ামের গোড়ায়, তেমনই ওয়েব দর্শকের সামনে 'দেব ডিডি'-র মতো কনটেন্ট নিয়ে এসে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন ওয়েবে ঠিক কেমন কনটেন্ট পেতে চলেছেন দর্শক। নারীর যৌনতার দাবি যে একটি পুরুষের মতোই স্বাভাবিক সেকথাও জোরগলায় বুঝিয়েছেন তিনি ট্রিপল এক্স-এ। অন্যান্য বহু ওয়েব প্ল্যাটফর্ম নারী শরীরকে শুধুই পণ্য হিসেবে দেখেছে। ট্রিপল এক্স-এ নারীর যৌনতার অধিকারের প্রসঙ্গ এসেছে।
২০২০ সালে পদ্মশ্রী সম্মানে ভূষিত করা হয়েছে তাঁকে। ব্যবসায়িক সাফল্য, জনপ্রিয়তা, টেলিভিশনের পর্দায় নতুন ট্রেন্ডের সূচনা-- এ সব কিছু বাদ দিয়েও আরও একটি বিষয় রয়েছে যা অনস্বীকার্য। তা হল একটি আদ্যন্ত পুরুষশাসিত ইন্ডাস্ট্রিতে মহীরুহ হয়ে উঠতে পেরেছেন একতা। খুবই একপেশে নারীবাদী শোনালেও কথাটা সত্যি এবং এই সাফল্যটা প্রয়োজন ছিল, জাতীয় টেলিভিশন জগতে খুব নিঃশব্দে একটা লিঙ্গ-সাম্যের পরিবেশ সৃষ্টি করার জন্য।