শুটিং মানেই বিরাট কর্মকাণ্ড। যে কোনও সিরিয়ালের শুটিংয়ে অন্তত ষাট জন থাকেন ফ্লোরে, অভিনেতা-অভিনেত্রী ও টেকনিশিয়ানদের সবাইকে নিয়ে যদি ধরা যায়। প্রত্যেক শুটিংয়ে প্রোডাকশন বয়দের উপর থাকে নানা দায়িত্ব। নায়ক-নায়িকাদের সময়মতো খাওয়ানো থেকে শুরু করে টুকিটাকি জিনিস এনে দেওয়া, হাজারো বায়না সামলাতে হয় এঁদের। দিনের মধ্যে ১৪ ঘণ্টা কিন্তু তারকাদের যত্ন-আত্তি করেন এঁরাই, একদম মায়ের মতো করেই। তাই মাতৃদিবসে তাঁদের কথা ভুল গেলে চলবে কী করে?
কথায় বলে, শুধু জন্ম দিলেই মা হয় না, লালন-পালন করেন যিনি, তিনিই আসলে মা। শুটিং প্রযোজনার মতো একটি অত্যন্ত জটিল ও ব্যাপ্ত বিষয়কে সামলাতে ইউনিটে থাকেন প্রোডাকশন বয়-রা। শুটিং ফ্লোরে কারও হাত থেকে কিছু পড়ে গেলে, তড়িঘড়ি পরিষ্কার করা, ইউনিটের সকলকে ঠিক সময়ে চা-কফি দেওয়া আবার অভিনেতা-অভিনেত্রীদের কোনও বিশেষ পছন্দের খাবার রান্না করে খাওয়ানো-- এমন বিবিধ-বিচিত্র কাজের মধ্যে থাকতে হয় তাঁদের দিনভর।
আরও পড়ুন: ‘সবাই কেমন মায়ের সঙ্গে ছবি দিচ্ছে, তখন স্মার্টফোন কেনার সামর্থ ছিল না’
সিনেমা হোক বা সিরিয়াল সব শুটিংয়েই থাকেন এই দাদারা বা ভাইয়েরা, যাঁরা ইউনিটের সকলের পছন্দ-অপছন্দ আলাদা করে মাথায় রাখেন। ঠিক যেভাবে একটি বড় পরিবারের গিন্নিকে বা মা-কে সবার সবটা মনে রাখতে হয়। কেউ হয়তো সকাল ১০টায় লেবুর রস খাবেন, আবার ঠিক সাড়ে দশটায় হয়তো কাউকে জলের বোতল ভরে দিয়ে আসতে হবে। লাঞ্চে কেউ শুটিংয়ে আসা মিল খাবেন না, তাঁকে আলাদা করে চিকেন বানিয়ে দিতে হবে। সারা দিন এঁদের অক্লান্ত পরিশ্রম, কোনও মায়ের থেকে কম কী!
''ঠিকই বলেছ, একদম মায়ের মতোই যত্ন করে। আমাদের ইউনিটে খাবারের ব্যাপারটা দেখেন আহমেদদা, টিপুদা আর বিশুদা। আর মন্টুদা চা-কফির দায়িত্বে। এর মধ্যে আহমেদদাকে প্রথম দিন থেকে দেখছি', বলেন 'ত্রিনয়নী'-নায়িকা শ্রুতি, ''আমাকে ঠিক সময়ে ফল কেটে দেওয়া, বায়না করলে স্পেশাল কিছু আনিয়ে দেওয়া... সব আবদার রাখে। মা রস না করে দিলে আমি মুসাম্বি খেতে পারি না। আমার মা যখন কলকাতায় থাকে না, তখন আহমেদদা আমাকে নিয়ম করে মুসাম্বির রস দিয়ে যায়। বেদানা ঠিক ছাড়িয়ে দিয়ে যায়, বলতে হয় না। আবার বকাবকিও করে। হয়তো আমি শট দিয়ে এসে শুয়েছি, খাবারটা অনেকক্ষণ পড়ে আছে। এসে বলে কেন খাওনি তুমি, ঠান্ডা হয়ে গেল। কেউ হয়তো রসগোল্লা ভালবাসে, তার জন্য আলাদা করে তুলে রেখে দেওয়া, সবটাই করে।''
প্রোডাকশন বয়-রা হলেন ফিল্ম ও টেলিভিশন ইন্ডাস্ট্রির ফ্রিলান্সার বা স্বাধীন পেশাদার। এঁদের নিজস্ব গিল্ড রয়েছে। শুধুমাত্র গিল্ডের কার্ড রয়েছে যাঁদের তাঁরাই কাজ করতে পারেন সিরিয়াল বা সিনেমার শুটিংয়ে। কোনও নতুন প্রযোজনা শুরু হলে, প্রোডাকশন ম্যানেজাররা ফেডারেশনের কাছে একটি তালিকা দেন যে এই বিশেষ ইউনিটে কোন কোন প্রোডাকশন বয়-কে তাঁরা রাখতে চান। আবার ফেডারেশনও অনেক সময় নির্বাচিত তালিকা পাঠায়। আবার অনেক সময় কোনও বিশেষ প্রযোজনা সংস্থায় প্রায় নিয়মিত কর্মচারী হিসেবেই কাজ করেন এঁরা, বিশেষ করে যে হাউসগুলি নিয়মিত টেলিধারাবাহিক প্রযোজনা করে।
আরও পড়ুন: ‘প্রত্যেকদিনই মাদার্স ডে’, একগুচ্ছ বিরল ছবি শেয়ার করলেন অমিতাভ
শ্রুতির আহমেদদার ভাল নাম নুর ইসলাম। ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা-কে জানালেন যে তিনি প্রায় ৯ বছর এই কাজ করছেন। তাঁর আরও দুই পার্টনার আছেন যাঁদের নামও উল্লেখ করেছেন শ্রুতি। 'প্রেমের কাহিনি', 'গোয়েন্দা গিন্নি', 'রাগে অনুরাগে' ইউনিটে ছিলেন 'ত্রিনয়নী'-র আগে। ''এগুলো তো আমাদের দায়িত্ব, এটাই আমাদের কাজ। যেমন 'গোয়েন্দা গিন্নি'-র সময় ইন্দ্রাণী হালদারের বাড়ি থেকে খাবার আসত কিন্তু উনি বেগুনের ভর্তা খেতে ভালবাসেন। আমরা করে দিতাম। আমাদের 'ত্রিনয়নী'-র হিরো গৌরব, ও মিলের খাবার খায় না। আমি চিকেন আর মাটনটা খুব ভাল বানাই। গৌরবকে আমি চিকেন রান্না করে দিই'', বলেন আহমেদদা অর্থাৎ নুর ইসলাম।
ঊষসী রায় ও তিয়াসা রায়ও জানালেন তাঁদের শুটিংয়ের মায়েদের কথা। 'কৃষ্ণকলি'-নায়িকা তিয়াসা জল খেতে ভুলে যান তাই ফ্লোরের প্রোডাকশন বয় গোপালদাকে তাঁর বলাই থাকে। গোপালদাও ঠিক শটের ফাঁকে ফাঁকে জলের বোতলটা নায়িকার হাতে দিয়ে দেন। ''আমাদের খাবার দেয় অজিতদা। প্রত্যেকদিনই জেনে নেয় কী খাব না খাব। কোনওদিন হয়তো বলতে ভুলে গেলাম, পর পর সিন করছি। আমি যা খেতে ভালবাসি, নিজে থেকেই সে সব খাবার এনে রেখে দেয়'', বলেন তিয়াসা, ''আর কী অদ্ভুত মনে রাখে। আমি ম্যাগিতে ঠিক কতটা ঝাল-নুন খাই, কখনও ভোলে না।''
অভিনেত্রী ঊষসী রায় আবার এমন একজনের কথা বললেন যিনি শুধু খাবার-দাবারের যত্ন নেন তা নয়, একটি শুটিংয়ে নায়িকার পায়ে চোট লেগেছিল। প্রত্যন্ত অঞ্চলে আউটডোরে থেকেও কিন্তু তিনি ঠিক মাসল স্প্রে, অ্যাঙ্কল ক্যাপ জোগাড় করে এনেছিলেন। ইউনিটের সবাই আরকে বলতে নাকি অজ্ঞান। গল্প শোনালেন অভিনেত্রী-- ''আমি পর পর দুটো সিরিয়াল একই হাউসে করেছি। দুবারই পার্থদাকে পেয়েছিলাম। পার্থদা, ছোটুদা, ভুট্টোদা সবাই এমনই ছিল, যা যা লাগে, বলার আগেই চলে আসত। কিন্তু আলাদা করে আরকে-র কথা বলতে চাই। আসল নামটা আমি জানি না, সবাই আরকে বলে ডাকে। আউটডোরে যখন যেটা লেগেছে, একদম মায়ের মতোই ঠিক এনে দিয়েছে। অত রিমোট একটা জায়গায় সব সময় সব কিছু পাওয়া যায় না। কিন্তু কীভাবে যে এনে দিত, জানি না। ওখানে শুটিং করতে গিয়েই পায়ে চোট লেগে মাসল পেন হয়েছিল। আরকে ঠিক কোথা থেকে রাত্তিরে ভলিনি স্প্রে কিনে, অ্যাঙ্কল ক্যাপ কিনে আমার ঘরে দিয়ে গেল।''
আরও পড়ুন: ফেসবুকে ভুয়ো প্রোফাইল, জর্জরিত অপরাজিতা
আসল নাম মাখন মাইতি। ইন্ডাস্ট্রিতে আসার পরেই কীভাবে যেন আরকে নামটা ডাকনাম হয়ে গিয়েছে। কেটারিংয়ের কাজ করতেন, সেখান থেকেই যোগাযোগের মাধ্যমে প্রোডাকশন বয় হিসেবে কাজ শুরু করেন ৪ বছর আগে। জি বাংলার বহু ফিকশন ও নন-ফিকশন ইউনিটে কাজ করেছেন। সময়-সুযোগ হলে সর্ষে-ইলিশ রেঁধে খাওয়াতে ভালবাসেন। অভিনেত্রী ঊষসী রায় তাঁর সম্পর্কে অনেক সুখ্যাতি করেছেন জেনে ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা-কে আরকে বলেন, ''আসলে এটা আমার কাজ আর আমি কখনও না বলতে শিখিনি। আমাদের কাজে এটাই শুরুতে বলে দেওয়া হয়, যা চাওয়া হবে, সেটা জোগাড় করতে হবে। তবে আমি টাইমও দিয়ে দিই। যেমন ঊষসী ম্যাডামকে ওই আউটডোরে বলেছিলাম যা চাইবেন, রাত বারোটা পর্যন্ত আমি এনে দিতে পারব।'' আরকে কিন্তু তাঁর কথা রেখেছিলেন।
শুটিংয়ে প্রোডাকশন বয়-দের হয়তো এটাই কাজ কিন্তু এটা এমন একটা কাজ যা যত্ন ছাড়া সম্ভব নয়। ঠিক সময়ে যে যা চাইছেন তা হয়তো যান্ত্রিকভাবে মনে রাখেন ওঁরা। কিন্তু বেড়ে দেওয়া খাবার পড়ে থাকলে বকাবকি করা অথবা নায়িকার পায়ে ব্যথা বলে মাঝরাত্তিরে প্রত্যন্ত অঞ্চলে ভলিনি জোগাড় করে দেওয়ার মধ্যে শুধুই যান্ত্রিকতা থাকে না। অনেকটা অন্তর থেকে যত্নও থাকে। আর এভাবে যত্ন তো ঘরে ঘরে মায়েরা বা মায়ের মতো যাঁরা তাঁরাই করে থাকেন। তাই বিনোদন জগতের এই মানুষগুলির কথা মনে করতেই হয় একবার মাতৃদিবসে।
ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা এখন টেলিগ্রামে, পড়তে থাকুন