শুভাশিষ মুখোপাধ্যায়
মনোজ মিত্র। একজন বিশিষ্ট নাট্যকার ও অভিনেতা। বলা ভাল একজন গুণী অভিনেতা। মনোজ মিত্র শুধু একজন পশ্চিমবঙ্গের শ্রেষ্ঠ নাট্যাকর নন, ভারতবর্ষের অন্যতম শ্রেষ্ঠ নাট্যব্যক্তিত্ব। আন্তর্জানিত ক্ষেত্রেও উনি একজন বিশিষ্ট শিল্পী ও নাট্যকার। বিভিন্ন ধারার বাংলা নাটক আমাদের সমৃদ্ধ করেছে। মনোজ মিত্র যে শুধু কমেডি নাটক লিখেছেন তা তো নয়। সাইকোলজিক্যাল প্লে, ফিলোজফিক্যাল প্লে, হিস্টোরিক্যাল প্লে, সোশ্যাল প্লে এবং বিশেষ করে ওনার পলিটিক্যাল স্যাটার অনবদ্য। জাস্ট ভাবা যায় না। এতগুলো বিষয় নিয়ে যে নাটক লিখেছেন তা বাংলার নাট্যজগৎকে সমৃদ্ধ করেছে। সেই সঙ্গে আমরাও সমৃদ্ধ হয়েছি। পশ্চিমবঙ্গের বহু নাট্যদল তাঁর নাটক মঞ্চস্থ করেছে। আমি নিজে মনোজ দার নাটকে কাজ করেছি। দুর্ভাগ্য যে ওনার সঙ্গে এক মঞ্চে অভিনয় করতে পারিনি। অনেক সিনেমায় একসঙ্গে কাজ করেছি।
মনোজ দার নাটক ভারতের বিভিন্ন জায়গার নাট্যদল অনুবাদ করে নাটক করেছে। গর্বের বিষয়, বিদেশের বহু নাট্যদল মনোজ দার নাটক মঞ্চস্থ করেছে। একজন নাট্যকারের কাছে এটা বিরাট প্রাপ্তি। মনোজ দা মানুষ হিসেবে অসাধারণ। তাঁর সঙ্গে যখনই দেখা হয়েছে আমার কুশল সংবাদ নিয়েছেন। আমি সবসময় পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করতাম। উনি বরাবরই আস্তে কথা বলতেন। আমি কোনও দিন মনোজ দা-কে লাউড কিছু করতে দেখিনি।তা সে সাধারণ কথাবার্তা হোক বা অভিয়ের ক্ষেত্রে। ভীষণ মার্জিত, যা বিরল।
মনোজ মিত্র একজন শিক্ষক। তাঁর থেকে আমি অনেক কিছু শিখেছি। নাটক লেখা শিখেছি, অভিনয় করা শিখেছি। শুধু নাট্যাভিয়ন নয়, চলচ্চিত্রের অভিনয়ও শিখেছি। উনি পড়াতেন। তাই শিক্ষক হিসেবেও সমাদৃত। একজন বড়মাপের নাট্যশিক্ষক। মনোজ দার চলে যাওয়াটা খুবই দুঃখজনক। তবে আমার সবসময়ই মনে হয়, একজন শিল্পী, ক্রিয়েটিভ মানুষের মৃত্যু তখনই হয় যখন শারীরিকভাবে আর কাজটা করতে পারেন না।
সাহিত্যিক, কবি, অভিনেতা, নাট্যকার প্রত্যেকের ক্ষেত্রেই এটা আমার মনে হয়। যেদিন থেকে কলম বা কণ্ঠ বন্ধ হয়ে যায় তখনই তাঁর মৃত্যু হয়। এটা আমার একান্ত ব্যক্তিগত মত। সেই যন্ত্রনা যে কতটা কষ্টকর সেটা সেই মানুষটাই বোঝে। আশেপাশের কেউ বুঝতে পারেন না বলেই আমার বিশ্বাস। এমনও কিছু ঘটে তিনি চাইছেন প্রতিবাদ করতে, একজন লেখক যখন প্রতিবাদ করতে যান তখন সেটা তাঁর লেখণীর মাধ্যমে বেড়িয়ে আসে। যখন তিনি দেখেন লেখা আর বেরচ্ছে না, অথচ প্রতিবাদের জন্য ছটফট করছে সেই যন্ত্রণাটা সাঙ্ঘাতিক। আমার ধারণা প্রতিটি শিল্পীর ক্ষেত্রেই এই একই ঘটনা ঘটে।
মনোজ দার সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত সম্পর্ক বহুদিনের। অনেক মজার ঘটনাও আছে। অনেক বছর আগে আমরা একটা ছবি করেছিলাম। জীবযন্তু নিয়ে ছবিটা তৈরি হয়েছিল। সার্কাসের মালিক সেই ছবির প্রোডিউসর ছিলেন। অনেকে ছিলেন সেই সিনেমায়। সার্কাসের টেন্টে শ্যুটিং হচ্ছিল। সেই সময় বিখ্যাত অলিম্পিক সার্কাস। তারাই প্রোডিউসর ছিলেন।
একটা বাঘের রিংয়ের ভিতরে রিং মাস্টার, বাঘ, পরিচালক ক্যামেরা নিয়ে এবং বাইরে ফেন্সিং করে দেওয়া। সেই ফেন্সিংয়ের বাইরে আমরা কয়েকজন দাঁড়িয়ে দেখছিলাম কী হচ্ছে। আনন্দ মুখোপাধ্যায় নামে একজন অভিনেতা ছিলেন। তিনি ভিতরে। শট দেবেন। মনোজ দা তখন রবি-দাকে বললেন, চলো গিয়ে দেখি। ওদিকে রবি দা মনোজ দা-কে সাবধান করছেন আর বলছেন বেশি কাছে যেও না।
দুজনে সামনে গেলেন। আমরা দাঁড়িয়ে দেখছি। বাঘ আসছে। সে তো রীতিমতো হুংকার দিচ্ছে। তা শুনেই মনোজ দা আর রবি দা ছিটকে বেরিয়ে গেলেন। আমরা তখন হাসব না কী করব বুঝতেই পারছিলাম না। সে এক বিচিত্র অভিজ্ঞতা। মনোজ দার সঙ্গে আরো একটি ছবি করতে গিয়েছিলাম পাহাড়ে। আউটডোর শ্যুটিংয়ের একটি দৃশ্য ছিল হাসপাতালে ইসিজি করাবেন। সেই সময় তো অনেক তার দেওয়া হয় বুকে। মনোজ দা-কেও তাই করেছে। শট শুরুর সময় তার ছিঁড়ে লাফিয়ে ওঠে।
সেদিন ওনাকে রাগতে দেখেছিলাম। কারণ উনি কারেন্ট খেয়েছেন। চিৎকার করে বললেন, ইয়ার্কি হচ্ছে? গায়ে কারেন্ট দিচ্ছ? মনোজ দার সঙ্গে গোয়াতেও আউটডোর শ্যুটিংয়ে গিয়েছিলাম। সেখানে রাতের আড্ডাটা দারুণ ছিল। তিন মূর্তিতে মনোজ দা, রঞ্জিত দা আর দীপঙ্কর দে ছিলেন। অবসরগ্রহণের পরও যে নতুন করে শুরু করা যায় সেই প্রেক্ষাপটেই ছবি তৈরি করেছিল রাজা সেন। অসাধারণ ছবি।
আরও পড়ুন: 'বড় সুযোগ হারালে', চন্দন সেনের মা-কে কেন বলেছিলেন মনোজ মিত্র?
সেখানেও বিচিত্র অভিজ্ঞতা হয়েছিল। ইদানিং মনোজ দার সঙ্গে দেখা হত গড়িয়া হাট বাজারে। উনি কিন্তু, বাজার করতেন না। গড়িয়াহাট বাজারের উপরে একটি রিহার্সাল রুম ছিল। মনোজ দা যখনই আসতেন বা বেরতেন আমার সঙ্গে দেখা হয়ে যেত। ওখানে দাঁড়িয়ে কথা হত। মনোজ দার চলে যাওয়াটা খুবই কষ্টের। আজ সেই পুরনো দিনগুলোকর কথা খুব মনে পড়ছে। ওনার পরিবারের প্রতি আমার সমবেদনা রইল। আর মনোজ দার আত্মার শান্তি কামনা করি। যেখানেই থাকুক ভাল থাকুক।