টালিগঞ্জ যদি বাংলা সিনেমার পীঠস্থান হয়, তবে চিৎপুর যাত্রার। যাত্রাপাড়া বলতে একডাকে সবাই চেনে চিৎপুরকে। যেখানে উত্তর কলকাতার স্বভাবসিদ্ধ চেহারার ছাপ মিলবে সহজেই, সেই ঘিঞ্জি রাস্তা, ট্রামলাইন, বাস-ট্যাক্সি-অটো-ভ্যানের উপদ্রব সামলে রাস্তার দু’পাশে রংবেরঙের পোস্টার সাজানো। তারই মধ্যে যাত্রাপালার পসরা সাজিয়ে বসে বিভিন্ন যাত্রাপালার দল। তিলোত্তমা কলকাতায় এ যেন এক টুকরো রঙিন ক্যানভাস। আজ সেই রং সামান্য ফিকে হয়ে আসছে বটে, তবে তারই নিজের বিনোদনী সত্তাকে বাঁচিয়ে কোনওরকমে টিকে রয়েছে আজকের যাত্রাপাড়া।
যাত্রার ‘ভিলেন’ মেগা সিরিয়াল
একটা সময়ে যখন সিনেমা ছিল না, টেলিভিশন ছিল দূর অস্ত, স্মার্টফোন যখন কল্পবিজ্ঞানের স্বপ্নকথা, সে সময়ে একঘেঁয়ে জীবনে বিনোদনের রসদ জোগানোর একমাত্র মাধ্যম ছিল তিন দিক খোলা মঞ্চ। একসময়ে রমরমিয়ে চলা এই বিনোদনের জনপ্রিয়তা হারানোর জন্য টেলিভিশনকেই দায়ী করছেন যাত্রাপাড়ার অনেকে। যাত্রাপাড়ার জনপ্রিয়তা নিয়ে নানা মুনির নানা মত। কোনও দলের ম্যানেজারের মতে যাত্রাপাড়ার জনপ্রিয়তা তলানিতে ঠেকেছে, আবার কেউ কেউ বলছেন “বাজে কথা, যাত্রা ছিল, আছে, থাকবে।’’ কারও মতে, “হ্যাঁ, কিছুটা জনপ্রিয়তা কমেইছে, তবে এখনও লোকে যাত্রা দেখে”। তবে একটা ব্যাপারে সকলেই একমত। যাত্রার বাজার কেড়ে নিয়েছে মেগা সিরিয়াল। যাত্রা প্রযোজক দিলীপ দাসের মতে, “এখন মহিলারা প্রায় সকলেই সিরিয়াল দেখেন। তাছাড়া বিনোদনের অনেক মাধ্যম চলে এসেছে আজকের প্রজন্মের কাছে। তাই কিছুটা জনপ্রিয়তা কমেছে যাত্রার।” মেগা সিরিয়ালের জন্য যাত্রার জনপ্রিয়তা যে কমেছে, সে কথা মেনে নিয়েছেন অভিনেতা চিরঞ্জিতও। তিনি বললেন, “এখন মাঠে সেভাবে ভিড় হয় না, তার একটা কারণ টেলিভিশন এসে গেছে, ধৈর্য্য ধরে আর কেউ যাত্রা দেখতে চান না।” এ ব্যাপারে চিরঞ্জিতের সুরে সুর মিলিয়েছেন অভিষেক চট্টোপাধ্যায় ও শতাব্দী রায়ও। তাঁদের মতে, “গ্রামের মানুষের কাছেও আজ বিনোদনের অনেক মাধ্যম চলে এসেছে যা যাত্রার জনপ্রিয়তা কেড়ে নিয়েছে অনেকটাই।” যাত্রাপাড়ার বিভিন্ন দলের ম্যানেজারের মতে, “এখন সিরিয়ালেই দর্শকরা বিভিন্ন ধরনের কাহিনী দেখে ফেলছেন, যাত্রাতেও সেই একই ধাঁচের কাহিনী দেখার জন্য মাঠে যেতে চাইছেন না দর্শকরা।”
আরও পড়ুন, ‘‘আমরা ছ্যাবলামো করি না’’, বললেন যাত্রাপাড়ার সুচিত্রা সেন, সহমত চিৎপুরের উত্তম কুমার
ছকে বাঁধা পথেই হাঁটছে যাত্রাপালা?
সময় যতটা পাল্টেছে, যতটা পাল্টেছে জনরুচি, যাত্রাপাড়া কি তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে নিজেদের পাল্টাতে পেরেছে? এ প্রশ্ন এখন চিৎপুরের আনাচকানাচ থেকেই উঠতে শুরু করেছে। যাত্রা মানেই একটা চড়া মেকআপ, উঁচু তারে বাঁধা মেলোড্রামা, অতি উচ্চকিত সংলাপ আর মেকআপ। একই ছন্দে বাঁধা যাত্রাপালার নামগুলোও। এই টিপিক্যাল ফর্ম্যাটের জন্যই কি ইঁদুর দৌড় থেকে ছিটকে গেছে বাংলার আদি সংস্কৃতি? যাত্রাপাড়ার অনেক ম্যানেজারের মতে, “নতুন কিছু ভাবার মতো সময় কারও নেই। তাছাড়া এ সব নিয়ে কারও কোনও ইচ্ছেও নেই।” আবার অনেকের মতে, “এটা যাত্রার ঘরানা, নিজস্ব ঘরানা ছেড়ে বেরোনোর কোনও মানে হয় না।” যাত্রাপাড়ার অন্যতম চিত্রনাট্যকার মেঘদূত গঙ্গোপাধ্যায়ের মতে, “একটা সময়ে যাত্রা চড়া ধাঁচের ছিল, কিন্তু এখন আর চড়া হয় না। তবে এজন্য যাত্রার পরিকাঠামোও একটা ফ্যাক্টর। যাত্রার দর্শকসংখ্যা কমপক্ষে ১০ হাজার, সব দর্শক যাতে সংলাপ শুনতে পান, সেজন্য উচ্চগ্রামে কথা বলা হয়। তবে ভাল স্ক্রিপ্টের খুব অভাব। যাত্রাতেও দক্ষিণী ছবির কপি-পেস্ট চলছে।” অভিনেতা চিরঞ্জিতের মতে, ‘যাত্রার পুরনো ফর্ম্যাট আর দেখতে চান না মানুষ।’ অভিনেত্রী শতাব্দী রায়ের দাবি, তাঁর যাত্রাপালায় সেই টিপিক্যাল ফর্ম্যাট থাকে না। প্রযোজক দিলীপ দাসের পাল্টা যুক্তি, “সিনেমাতেও ‘বাবা কেন চাকর’, ‘তোমার রক্তে আমার সোহাগ’-এর মতো নাম রাখা হয়েছে। সবসময়ে যে এরকম চড়া নাম ব্যবহার করেছি তা নয়।” চিত্রনাট্যকার মেঘদূত গঙ্গোপাধ্যায়ের মতে, “যাঁরা যাত্রাপালার নাম নিয়ে মজা-ঠাট্টা করেন, তাঁরা বাংলার সংস্কৃতি সম্পর্কে জানেন না, তাঁদের মধ্যে শিক্ষা-সংস্কৃতি নেই, থাকলে এভাবে হেয় করত না।” দেবশ্রী রায় বা পাপিয়া অধিকারীরা যাত্রাকে ছোট করার সংস্কৃতির বিরুদ্ধে মুখ খুললেন, টালিগঞ্জের স্বপন সাহা-অঞ্জন চৌধুরীদের কাজের কথা মনে করিয়ে বললেন, সেসব সিনেমা যাত্রার তুলনায় সববিভাগেই অনেক বেশি চড়া।
আরও পড়ুন, প্রসেনজিৎ-ঋতুপর্ণা কি এবার গিনেস বুকে?
‘লক্ষ্মী’ নেই চিৎপুরে!
যাত্রাপাড়ায় গেলে অনেক হতাশ মুখের সাক্ষী হতে পারেন। নিয়মমাফিক রংবেরঙের পোস্টার সাজিয়ে বসে আছেন বিভিন্ন দলের ম্যানেজাররা। কিন্তু দিনের শেষে পকেট ভরছে কই? অধিকাংশ ম্যানেজারের বক্তব্য, লোকসানে চলছে চিৎপুর। কোনওরকমে টিকিয়ে রাখা হয়েছে যাত্রাপাড়াকে। এমনকী এখন টিকিট বিক্রি করে যাত্রা শো খুব কম হয়। অধিকাংশ যাত্রাই আজকাল ফ্রি-তে হচ্ছে, যা আর্থিক দিক থেকে অনেকটা পিছিয়ে দিয়েছে বাংলার এই আদি লোকসংস্কৃতিকে। পশ্চিমবঙ্গ যাত্রা সম্মেলনের সম্পাদক তথা যাত্রা অ্যাকাডেমির গভর্নিং বডির সদস্য কনক ভট্টাচার্য জানালেন যাত্রাদলের সংখ্যা ৩৩ থেকে বেড়ে হয়েছে ৬০। লাভজনক না হলে দলের সংখ্যা বাড়ত কিনা তা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন তিনি। যাত্রাপাড়ার কর্মী ইউনিয়নের সম্পাদক হারাধন রায়ের মতে, গত ৪-৫ বছরের তুলনায় যাত্রাবাজারের উন্নতি হচ্ছে। বর্তমান সরকার যাত্রার উন্নতিতে বহু উদ্যোগ নিয়েছে বলে দাবি করেন তিনি।
আরও পড়ুন, প্রথমদিনেই প্রশংসার ঝড় সোশ্যাল মিডিয়ায়, সেলেব থেকে আমজনতার কেমন লাগল ‘হামি’?
ফিল্মস্টার বনাম যাত্রাস্টার
ফিল্মস্টারদের ভিড়ে কি যাত্রাপাড়া তার নিজস্ব স্টারদের হারাচ্ছে? রুমা দাশগুপ্ত, স্বপন কুমার, শ্যামল চক্রবর্তী, অনল-কাকলির পর আর যাত্রাস্টার কেউ নেই। যাত্রার স্ক্রিপ্ট লেখক-পরিচালক মেঘদূত গঙ্গোপাধ্যায়ের মতে, “যাত্রাশিল্পীদের একটা শূন্যতা রয়েছে, তাই অন্য মাধ্যম থেকে শিল্পীদের আনতে হয়। লাভের ব্যাপারটা তো থাকেই। তবে ফিল্মস্টার না থাকলে যাত্রা চলবে না, সেটা মনে করি না।’’ কয়েকজন ম্যানেজারের মতে, “ফিল্মস্টাররা যাত্রা করলে চাহিদা বাড়ে ঠিকই কিন্তু ওঁরা কি আদৌ যাত্রা করেন? সব শেষ করে দিচ্ছেন।” ফিল্মস্টাররা যাত্রা করায় মান পড়েছে এই দাবি উড়িয়ে দিয়েছেন চিরঞ্জিত, অভিষেক, শতাব্দীরা। অভিনেত্রী রচনা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতে ফিল্মস্টার থাকলে, যাত্রায় টিকিটের চাহিদা কিছুটা বাড়ে। কারও মতে, “ফিল্মস্টারদের নিয়ে যাত্রা বেশিদিন চলবে না।” অনেকের মতে, “যাত্রায় ভাল আর্টিস্ট নেই, কোনও ওয়ার্কশপ হয় না। ভাল চিত্রনাট্যকার নেই.” তবে কনক ভট্টাচার্যের দাবি, “এখন ওয়ার্কশপ হচ্ছে. নতুন নতুন ছেলেমেয়ে আসছে।” অন্যদিকে একজন ফিল্মস্টার যাত্রা করলে তাঁদের যে সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হয়, একজন যাত্রাশিল্পীর ক্ষেত্রে তা নৈব নৈব চ।
ঘুরে দাঁড়াবে যাত্রাপাড়া?
যাত্রাপাড়ার ভবিষ্যত নিয়ে দ্বিমত থাকলেও, একটা ব্যাপারে সবাই একমত যে যাত্রার মৃত্যু হবে না কখনও। সরকারি ভাবে অনেক উদ্যোগ নেওয়া শুরু হয়েছে ঠিকই। কিন্তু অনেকেই মানছেন যে, যাত্রাপাড়ার পরিকাঠামো যতক্ষণ না উন্নত হচ্ছে, যতক্ষণ না গুণগত মান বাড়ছে, ততক্ষণ ঘুরে দাঁড়ানো মুশকিল। প্রায় ৫০০ বছরের পুরনো বাংলার এই লোকসংস্কৃতিকে ছন্দে ফেরাতে শুধু যাত্রার কারিগরদের মানসিকতার বদল ঘটাতে হবে তা নয়, একইসঙ্গে দর্শকদের মানসিকতার বদলও জরুরি, একথাও হাড়ে হাড়ে বুঝেছে চিৎপুরের যাত্রাপাড়া।