সব মিলিয়ে ১১০ তম, এই দশকে ১১ তম। এই হলো চাঁদের মিশনের তালিকায় চন্দ্রযানের অবস্থান। এর আগের ১০৯ টি মিশনের ৯০ টিই চাঁদে পাঠানো হয় ১৯৫৮ এবং ১৯৭৬ এর মধ্যে। এরপর দীর্ঘদিন একেবারে বন্ধ হয়ে যায় চাঁদ ঘুরে দেখার হিড়িক। ১৯৯০-এর দশকে ফের ধীরে ধীরে শুরু হয় চাঁদের মিশন, কিন্তু চন্দ্র অভিযানের গাড়ি ফের গড়গড়িয়ে চলতে শুরু করেছে স্রেফ গত দশ বছরে। এটা না বললেই নয় যে, ২০০৮ সালে চন্দ্রযান-১ চাঁদের মাটিতে জল আবিষ্কার করায় বিশ্বজুড়ে বিজ্ঞানীরা ফের আগ্রহী হয়ে পড়েছেন চাঁদ প্রসঙ্গে।
চন্দ্র অভিযান কয় প্রকার হতে পারে
ফ্লাইবাই - এর কোনও সঠিক বাংলা প্রতিশব্দ নেই। অল্প কথায় বলতে গেলে, এই ধরনের মিশনে মহাকাশযান চাঁদের কাছাকাছি গেলেও চাঁদকে ঘিরে কক্ষপথে ঘোরে না। হয় এইসব মহাকাশযান তৈরিই হয়েছিল দূর থেকে চাঁদকে পরীক্ষা করার জন্য, নাহয় তাদের লক্ষ্য ছিল সৌরজগতের অন্য কোনও অধিবাসী বা স্রেফ সৌরজগতের গভীরে প্রবেশ করা। পথে চাঁদ পড়ে গেল, এই যা। ফ্লাইবাই মিশনের প্রথমদিকের কিছু উদাহরণ হলো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পাইওনিয়ার ৩ (১৯৫৮) এবং ৪ (১৯৫৯), এবং তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের লুনা ৩ (১৯৫৯)।
আরও পড়ুন: চাঁদের প্রথম ছবি তুলে পাঠাল চন্দ্রযান-২, উচ্ছ্বসিত ইসরো
অরবিটার - নাম শুনেই বোঝা যাচ্ছে, এই ধরনের মহাকাশযান চাঁদের চারপাশে 'অরবিট', অর্থাৎ কক্ষপথ, ধরে ঘোরে। এদের লক্ষ্য হলো চাঁদের ভূপৃষ্ঠ এবং পরিবেশের দীর্ঘমেয়াদী পরীক্ষা-নিরীক্ষা। চন্দ্রযান-১ ছিল অরবিটার, যেমন ছিল নানা দেশের পাঠানো আরও ৪৬ টি মিশন। সাধারণভাবে অরবিটারই হচ্ছে মহাকাশের নানা গ্রহ-উপগ্রহ এবং অন্যান্য বস্তুকে কাছ থেকে দেখার সবচেয়ে প্রচলিত মাধ্যম। আজ পর্যন্ত মানুষ চাঁদ এবং মঙ্গলগ্রহ ছাড়া অন্য কোথাও মহাকাশযান নামাতে পারে নি। বাকি প্রত্যেকটি মহাকাশ অভিযানই হয় অরবিটার ছিল, নাহয় ফ্লাইবাই।
ইম্প্যাক্ট মিশন - এগুলি অরবিটার মিশনেরই কিঞ্চিৎ সম্প্রসারণ। মূল মহাকাশযান চাঁদের চারপাশেই আবর্তিত হতে থাকে, কিন্তু সেটির থেকে এক বা একাধিক যন্ত্রপাতিকে অনিয়ন্ত্রিত ভাবে চাঁদের মাটিতে ল্যান্ড করানো হয়। অবতরণের সঙ্গে সঙ্গেই গতির তীব্রতায় এই যন্ত্রপাতিগুলি ধ্বংস হয়ে যায় ঠিকই, কিন্তু যেটুকু সময় কাজ করে, সেই সময়ের মধ্যেই বেশ কিছু তথ্য সরবরাহ করতে সক্ষম হয় তারা। চন্দ্রযান-১ এ বাহিত একটি যন্ত্র, যার নাম ছিল মুন ইমপ্যাক্ট প্রোব (MIP), সেটি এভাবেই চাঁদের মাটিতে আছড়ে পড়ে। ইসরো দাবি করে যে MIP-র পাঠানো তথ্য থেকে পাওয়া যায় চাঁদে জলের অস্তিত্বের আরও অকাট্য প্রমাণ, যদিও ক্রমাঙ্কন বা 'ক্যালিব্রেশন'-এ ত্রুটি থাকার ফলে এই তথ্য প্রকাশ করা যায় নি।
আরও পড়ুন: মহাকাশ থেকে পৃথিবীর ছবি ক্যামেরাবন্দি করেছে চন্দ্রযান, দেখুন সেই ছবি
ল্যান্ডার - এই ধরনের মিশনে একটি মহাকাশযান চাঁদের মাটিতে ধীর গতিতে অবতরণ করে। বলাই বাহুল্য, এগুলি অরবিটার মিশনের চেয়ে আরও জটিল। এতটাই, যে প্রথম ১১ টি ল্যান্ডার মিশনই অসফল হয়। প্রথমবার ৩১ জানুয়ারি, ১৯৬৬ সালে সফলভাবে চাঁদে অবতরণ করে তৎকালীন সোভিয়েত রাশিয়ার মহাকাশযান লুনা ৯। চাঁদের ভূপৃষ্ঠের প্রথম ছবিও দুনিয়াকে পাঠায় এই লুনা ৯।
রোভার - এগুলি ল্যান্ডার মিশনের সম্প্রসারণ। যে কোনও ল্যান্ডার যথেষ্ট ভারী, এবং অনড়, অতএব অবতরণের পর সেটি এদিক ওদিক যেতে অক্ষম। ল্যান্ডারের যন্ত্রপাতি তার সংলগ্ন এলাকা থেকে তথ্য সংগ্রহ করতে পারে, চালাতে পারে পরীক্ষা-নিরীক্ষাও, কিন্তু চাঁদের মাটিতে নামতে পারে না বা ল্যান্ডার ছেড়ে যেতে পারে না। এখানেই রোভারের প্রয়োজনীয়তা। রোভারে চাকা বসানো থাকে, যাতে ল্যান্ডিংয়ের পর সেটি ল্যান্ডারের থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে যত্রতত্র বিচরণ করতে পারে, এবং গুরুত্বপূর্ণ তথ্য সংগ্রহ করতে পারে। চন্দ্রযান-২ এর ল্যান্ডারের নাম 'বিক্রম', রোভারের নাম 'প্রজ্ঞান'। এবছরের শুরুর দিকে চাঁদে পৌঁছয় একটি চিনা ল্যান্ডার এবং রোভার মিশন, যেগুলি এখনও সক্রিয় রয়েছে।
মনুষ্যবাহী (ম্যানড) মিশন - এই ধরনের মিশনে চাঁদের মাটিতে পা রাখতে সক্ষম হয় মানুষ। এ পর্যন্ত এই কৃতিত্ব অর্জন করেছে স্রেফ মার্কিন মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসা (NASA)। আজ অবধি দুজন করে মহাকাশচারীর মোট ছ'টি দল ১৯৬৯ থেকে ১৯৭২ সালের মধ্যে চাঁদের বুকে পদার্পণ করেছে। তার পর থেকে চাঁদের মাটিতে মানুষ নামানোর আর কোনও প্রচেষ্টা হয় নি। কিন্তু নাসা সম্প্রতি ঘোষণা করেছে যে ২০২৪-এর মধ্যে আরও একটি মনুষ্যবাহী মিশন চাঁদে পাঠাতে চলেছে তারা।