প্রধানমন্ত্রীর আর্থিক উপদেষ্টা পরিষদ নতুন করে সাজানো হয়েছে। বাদ পড়েছেন রথীন রায় এবং আংশিক সময়ের সদস্য শমিকা রবি। পরিষদের সভাপতি হিসেবে ২০১৭ সাল থেকে যিনি কার্যভার সামলাচ্ছিলেন, সেই বিবেক দেবরায়ই কাজ চালিয়ে যাবেন। প্রধানমন্ত্রীর আর্থিক উপদেষ্টা পরিষদ কী, তারা কী ভূমিকা পালন করে, এবং কীভাবে এর বদল ঘটেছে, তা দেখে নেওয়া যাক।
প্রধানমন্ত্রী আর্থিক উপদেষ্টা পরিষদের ভিত্তি
কাউন্সিলের ওয়েবসাইট (বর্তমানে আর্কাইভ করে দেওয়া হয়েছে) বলছে, এ পরিষদ তৈরি হয়েছিল যাতে সরকারকে বিভিন্ন আর্থিক বিষয়ে সরকারের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টি করতে পারে একটি ক্ষমতাসম্পন্ন বোর্ড। আর্থিক বা অন্যান্য বিভিন্ন বিষয়ে বিশ্লেষণ করে প্রধানমন্ত্রীকে সে বিষয়ে অবহিত করা এবং পরামর্শ দেওয়া, ম্যাক্রোইকোনমিক বিষয়ের গুরুত্বপূর্ণ দিকগুলি নিয়ে প্রধানমন্ত্রীকে অবহতি করা।
আরও পড়ুন, গো-হত্যা ছাড়া কি আর কোনও উপায় নেই?
পরিষদের গঠন
এই কাউন্সিল কাজ শুরু করে সাড়ে তিন দশকেরও বেশি আগে, কঠোর আর্থিক পরিস্থিতির মধ্যে। প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ১৯৮০ সালে ক্ষমতায় ফেরার পর ব্যাপক অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েন। আন্তর্জাতিক স্তরে তেল পরিস্থিতি এবং খরা পরিস্থিতির জেরে জাতীয় আয়ে ব্যাপক নেমে গিয়েছিল। এই পরিস্থিতি অর্থমন্ত্রী এম বেঙ্কটরমণ প্রধানমন্ত্রীকে আর্থিক স্থিতি ও বৃদ্ধির দিকে নজর দেওযার ব্যাপারে জোর দিতে বলেন। ইন্দিরা গান্ধী তখন নিয়ে আসেন সুখময় চক্রবর্তীকে, যিনি দিল্লি স্কুল অফ ইকনমিক্সে অমর্ত্য সেন ও মনমোহন সিংয়ের সঙ্গে পড়াশোনা করেছেন এবং ১৯৭০-এর মাঝামাঝি যিনি পরিকল্পনা কমিশনের পলিসি প্রসপেক্টিভ ডিভিশনের শীর্ষস্থানে ছিলেন।
পরিষদের শুরুর দিক
একদম শুরুর দিকে কাউন্সিলের সদস্যদের মধ্যে ছিলেন বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ কে এন রাজ, সি রঙ্গরাজন (যিনি পরে রিজার্ভ ব্যাঙ্কের গভর্নর হন), বিজয় কেলকর, যিনি ১৯৮২-৮৩ সালে পরিষদের প্রথম সচিব হন। ইন্দিরা গান্ধীর মৃত্যুর পর রাজীব গান্ধীর সময়েও দায়িত্ব পালন করে গিয়েছেন সুখময় চক্রবর্তী। ১৯৮৬-৮৭ সালে, যখন সরকার লিবারাল অর্থনীতি একটু একটু করে শুরু করছে, বাজার খুলে দিচ্ছে, সে সময়ে কাউন্সিলের পক্ষ থেকে প্রধানমন্ত্রীকে আসন্ন বিপদ ও আর্থিক অসাম্যের বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীকে জানানো হয়। পুরনো দিনের লোকেরা বলেন, রাজীব গান্ধী এ কথা শুনেছিলেন এবং তাঁর অর্থমন্ত্রী ভিপি সিং ঘোষণা করেছিলেন ১৯৮৫ সালে তৈরি তৎকালীন রিজার্ভ ব্যাঙ্ক গভর্নর মনমোহন সিংয়ের নেতৃত্বদায়ী কমিটির আর্থিক ব্যবস্থা নিয়ে যে রিপোর্ট দিয়েছে তা খতিয়ে দেখা হবে এবং বাজেট ঘাটতির সংজ্ঞা পরিবর্তন করা হবে।
৯-এর দশক
চন্দ্রশেখরের প্রধানমন্ত্রিত্বকালে অল্প কিছুদিনের জন্য এই কাউন্সিলের নেতৃত্ব দেন স্বয়ং মনমোহন সিং। এর পর ১৯৯১ সালে সংকট সামলাতে তিনি প্রধানমন্ত্রী উপদেষ্টা হন। ভিপি সিংয়ের আমলে এবং চন্দ্রশেখর সরকারের আমলের কিছু সময়েও অর্থসচিবের দায়িত্বে ছিলেন যে বিমল জালান, তিনি কাউন্সিলের প্রধান হন। পিভি নরসীমা রাওয়ের প্রধানমন্ত্রিত্বের সময়ে অর্থমন্ত্রী হন মনমোহন সিং। সেসময়ে কাউন্সিলের অল্প কয়েকটি বৈঠক হয়েছিল। প্রধানমন্ত্রীকে বিষয়গুলি জানানো হলেও তার রেকর্ড সংরক্ষিত হয়নি।
আরও পড়ুন, ভারতের ধনীদের সম্পদ কমল কেন?
বাজপেয়ী আমল
১৯৯৮ সালে অটল বিহারী বাজপেয়ী যখন দ্বিতীয়বার প্রধানমন্ত্রী হন তখন বিষয়টি আমূল বদলে যায়। এশিয় সংকটের সময়ে ফের বিপাকে পড়ে অর্থনীতি, আর্থিক উপদেষ্টা কমিটি কলেবরে বাড়ে, নেতৃত্বে রাখা হয় খোদ প্রধানমন্ত্রীকে। ১২ সদস্যের বাণিজ্য ও শিল্প পরিষদ নিযুক্ত হয়। বাজপেয়ীর আর্থিক কাউন্সিলে ছিলেন হেভিওয়েটরা। তাঁদের মধ্যে প্রাক্তন রিজার্ভ ব্যাঙ্কের গভর্নর আই জি প্যাটেল, ইন্দিরার সময়কালের পিএমও সচিব পি এন ধর, বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ অর্জুন সেনগুপ্ত, অমরেশ বাগচি, অশোক দেশাই, মন্টেক সিং আলুওয়ালিয়া, কিরীট পারেখ, এবং জিভি রামকৃষ্ণ। কাউন্সিলে ছিলেন বাজপেয়ীর প্রধানসচিব ব্রজেশ মিশ্র, এবং প্রধানমন্ত্রীর দফতরের সেক্রেটারি এন কে সিংও। কাউন্সিলের বৈঠক অনুষ্ঠিত হয় ২০০২ সালে। বাজপেয়ী সে সময়ে ৮ শতাংশ বৃদ্ধির আর্থিক লক্ষ্যের কথা ঘোষণা করেন - ছিল প্রতি বছর ১০ লক্ষ কর্ম সংস্থান, ভরতুকি ও খরচ ঢেলে সাজানো, আর্থিক সংস্কারে জোর, এবং নীতিপ্রয়োগ উন্নততর করার পরিকল্পনা। এই সময় জুড়ে আর্থিক নীতি তৈরির ব্যাপারে মুখ্য ভূমিকা নিয়েছিল অর্থমন্ত্রক।
মনমোহনের সময়কাল
২০০৪ সালে প্রধানমন্ত্রী হবার পর মনমোহন সিং বুঝতে পেরেছিলেন যে তাঁর পক্ষে বিভিন্ন আর্থিক বিষয়ে নজর দেওয়া সম্ভব নয়। সে সময়ে তিনি আর্থিক কাউন্সিলের মাথায় বসান রিজার্ভ ব্যাঙ্কে তাঁর প্রাক্তন সহকর্মী রঙ্গরাজনকে। এ সময়ে কাউন্সিল কলেবরে ছিল অনেক সংগঠিত, সদস্য সংখ্যা ছিল ৬-এরও কম। রঙ্গরাজনকে ক্যাবিনেট পর্যায়ের মন্ত্রীর মর্যাদা দেওয়া হয়। প্রথমে পি চিদাম্বরম ও পরে প্রণব মুখোপাধ্যায়ের নেতৃত্বাধীন অর্থমন্ত্র, মন্টেক সিং আলুওয়ালিয়ার নেতৃত্বাধীন পরিকল্পনা কমিশন নিয়ে কাউন্সিল প্রধানমন্ত্রীকে স্বাধীন পরামর্শ দিতে থাকে। ২০০৪-১৪, এই দশ বছরে কাউন্সিল অর্থনীতি নিয়ে নিজেরাই পর্যালোচনা করতে থাকে, বিভিন্ন বিষয়ে রিপোর্ট প্রকাশ করা ছাড়াও। মনমোহন সিংয়ের আমলে সুরেশ তেণ্ডুলকর, সৌমিত্র চৌধুরী, সুমন বেরি, দিলীপ নাচানে, পুলিন নায়েক, জিকে চাড্ডা এবং সতীশ ঝায়ের মত অর্থনীতিবিদরা কাউন্সিলে ছিলেন। এর মধ্যে ২০০৮-০৯ সালে কাউন্সিলের নেতৃত্বে ছিলেন তেণ্ডুলকর। কাউন্সিলের তিন দশকের ইতিহাসে মনমোহন সিংয়ের আমলেই তা ছিল সবচেয়ে প্রভাবশালী। তার কারণ, অর্থনীতিবিদ প্রধানমন্ত্রী কাউন্সিলের প্রধানের উপর আস্থা ও বিশ্বাস রেখেছিলেন।
আরও পড়ুন, টমাস কুকের ব্যবসা কেন গুটিয়ে গেল, কী হবে তাদের ভারতীয় সংস্থার?
২০১৭ সালে পুনরুজ্জীবন
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর নয়া সরকারের প্রাথমিক সিদ্ধান্তগুলির মধ্যে অন্যতম পরিকল্পনা কমিশন তুলে দেওয়া। রাজ্যগুলিকে বরাদ্দ দেওযার ব্যাপারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করত এই কমিশন। মোদী সরকার পরিকল্পনা কমিশন তুলে দিয়ে নীতি আয়োগ স্থাপন করেছে। আর্থিক পরিষদকেও নতুন করে সাজানো হয়নি। প্রথম মোদী সরকার তৈরির ৪০ মাস পর বিবেক দেবরায়কে এই কাউন্সিলের চেয়ারম্যান করা হয়। তিনি নীতি আয়োগেরও সদস্য। নতুন আর্থিক কাউন্সিলের সদস্য ছিলেন অর্থনীতিবিদ সুরজিৎ ভল্লা, রথীন রায়, এবং অসীমা গোয়েল। সেক্রেটারি ছিলেন প্রাক্তন অর্থসচিব রতন ওয়াটল।
Read the Full Story in English