ইংরেজি সাহিত্য: ১০০
পলিটিক্যাল সায়েন্স: ৯৯
সোশিওলজি: ১০০
সাইকোলজি: ৯৯
চোখ কপালে তোলার কিছু নেই। উপরে যা পড়লেন, ছাপার ভুল নয়। সবে সিবিএসই এবং আইসিএসই-আইএসসি বোর্ডের ক্লাস টেন আর টুয়েলভের ফল প্রকাশিত হয়েছে। এবং এই হারেই নম্বরের সুনামি বইছে দেশজুড়ে। সিবিএসই-তে ক্লাস টেনে যে ফার্স্ট হয়েছে, সে পেয়েছে ৫০০-র মধ্যে ৪৯৯। আইসিএসই-র যে টপার, সে অবশ্য ওই এক নম্বরের মায়া কাটানোর রাস্তায় হাঁটেনি। ১০০ শতাংশ নম্বর পেয়ে ফার্স্ট। কিছুদিনের মধ্যেই মাধ্যমিক আর উচ্চমাধ্যমিকের ফল বেরোবে। এবং সেখানেও নম্বর কম পড়িবে না, গ্যারান্টি।
মেধাতালিকায় চোখ বোলালে দম আটকে আসে। মাথা ঝিমঝিম করতে শুরু করে। এ কী রে ভাই! ছোটবেলায় জ্বর মাপার কথা মনে পড়ে যায়। থার্মোমিটার দেখাত, ৯৯.২, ৯৮.৮, ৯৯.৬ বা ৯৯.৪। আজকালকার বোর্ড পরীক্ষাগুলোর মার্কশিটের সঙ্গে কী আশ্চর্য মিল! একজন পরীক্ষার্থীর সাফল্যকেও সামান্যতম খাটো না করেও ভাবতে বসতে হয় ব্যাপারস্যাপার দেখে, এ কেমন শিক্ষাব্যবস্থা, এ কেমন মার্কিং সিস্টেম, যেখানে 'হিউম্যানিটিজ' বা কলা বিভাগের বিষয়গুলিতেও মুড়ি-মুড়কির মতো ৯৯/১০০ জ্বলজ্বল করছে মার্কশিটে?
আরও পড়ুন: আইএসসি পরীক্ষায় ভাল ফল, অভিনব পুলিশি সংবর্ধনা পেল রিচা!
অঙ্কে ১০০, মানা যায়। ফিজিক্স-কেমিস্ট্রি-বায়োলজিতে ১০০, তাও মেনে নেওয়া গেল। কিন্তু ইংরেজি সাহিত্য বা সোশিওলজি? তাতেও ফুল মার্কস? কী করে হয়? কী ধরণের প্রশ্ন হয়? আর মার্কিং পদ্ধতিটাই বা কী? মাল্টিপল চয়েস প্রশ্নে কবে কীভাবে মাপা গিয়েছে সাহিত্যবোধ বা রাষ্ট্রবিজ্ঞান অথবা সমাজতত্ত্বের মতো বিষয়ে জ্ঞানের গভীরতা? এ তো 'এ প্লাস বি হোল স্কোয়ার'-এর ফর্মুলা বা পারমুটেশন-কম্বিনেশনের অঙ্ক নয় রে বাবা!
বছর কুড়ি আগেও বাংলা বা ইংরেজি সাহিত্যে লেটার মার্কস পাওয়া ছাত্রছাত্রী হাতে গোনা যেত। এখন সাহিত্যে ৯৮-এর উপর পাওয়া পড়ুয়া দেশজুড়ে হাজার হাজার। গুনে শেষ করতে পারবেন না। মার্কিং পদ্ধতিকে যথাসম্ভব উদার করে সাফল্যের শতকরা হার বাড়ানো যদি বোর্ডগুলোর নীতিগত সিদ্ধান্ত হয়, যদি বিজ্ঞান আর কলা বিভাগের বিষয়গুলির মূল্যায়ন করা হয় একই দাঁড়িপাল্লায়, সে সিদ্ধান্তে কি আদৌ উপকার হচ্ছে ছাত্রছাত্রীদের? না কি বড় ক্ষতি হয়ে যাচ্ছে দীর্ঘকালীন, যা চাপা পড়ে যাচ্ছে নম্বরের ঘূর্ণিঝড়ে?
ক্ষতি তো হচ্ছেই। এভাবে চললে নিজের কাছে নিজের মূল্যায়ন করার ক্ষমতাটাই ক্রমে হারিয়ে যেতে বাধ্য ছাত্রছাত্রীদের। ধরুন, দশ মিটারের রেস হচ্ছে। আমি-আপনি মোটামুটি মানের দৌড়বীর। আমার-আপনার সঙ্গে লড়াই উসেইন বোল্টের। বোল্ট দুটো স্ট্রাইডে দৌড় শেষ করে দেবেন। সময় লাগবে এক সেকেন্ড বা তারও কম। আমি-আপনি শেষ করব পাঁচ-ছ'টা স্টেপে। সময় লাগবে পৌনে দুই থেকে দুই সেকেন্ডের মতো।রেকর্ড বলবে, বোল্টের থেকে খুব বেশি তো পিছিয়ে নেই। মাত্র তো সেকেন্ড-খানেকের তফাৎ। এবং মনে অবধারিত তৈরি হবে নিজের ক্ষমতার ব্যাপারে একটা সম্পূর্ণ ভ্রান্ত ধারণা। এটা মাথা থেকে বেরিয়ে যাবে, দৌড়টা যদি একশো মিটারের হত, আমরা কুড়ি-পঁচিশ মিটার পেরোনোর আগেই বোল্ট ফিনিশিং লাইন ছুঁয়ে ফেলতেন। সময়ের তফাতের কথা তো ছেড়েই দিলাম।
সাম্প্রতিক সময়ে বোর্ডের পরীক্ষাগুলোয় নম্বরের যে হরির লুট চলছে, তার প্রধান কুফল এটাই। সংখ্যাগরিষ্ঠ পড়ুয়াদের মনে একটা ভ্রান্ত ধারণা তৈরি করা।' খুব ভাল', 'ভাল' আর 'মাঝারি'-র মধ্যে তফাতটা মুছে দেওয়া। যারা ৯৮-৯৯ শতাংশ পাচ্ছে, তারা তো নিঃসন্দেহে খুব ভাল। কিন্তু ৯৫ থেকে ৯৮-এর মধ্যে তো হাজার হাজার ছাত্রছাত্রী। ৯০ থেকে ৯৫-এর মধ্যে গোটা দেশে অন্তত হাজার বিশেক।
সাত বা আট, এমনকি নয়ের দশকেও ৯০ শতাংশ বা তার আশেপাশে নম্বর পাওয়া মানে মেধাতালিকায় প্রথম দশে জায়গা বাঁধা ছিল। আর এখন? ৯০ মানে নেহাতই মাঝারি, রাম-শ্যাম-যদু-মধু সবাই পাচ্ছে। ৯৫? বাঃ... দারুণ হয়েছে। ৯৮ প্লাস? ওহ .. ব্রিলিয়ান্ট! ৯০-এর নিচে যারা ৮০ বা ৮৫, তাদের বাবা-মায়েরা মুখ কালো করে ঘুরছেন। যেদিকে তাকাচ্ছেন, ৯০-এর নিচে কেউ কথাই বলছে না। মুখ লুকোনোর জায়গা নেই। দুশ্চিন্তা চেপে বসছে, 'ভদ্রস্থ' কোনও কলেজে পছন্দের বিষয় নিয়ে ভর্তি হতে পারবে তো বাচ্চাটা?
আরও পড়ুন: আইসিএসই এবং আইএসসি-র দশম-দ্বাদশের মেধা তালিকায় কলকাতার জয়জয়কার
এবং ভর্তি প্রক্রিয়ার মুখোমুখি হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই ফল-পরবর্তী উল্লাসে ভাটা পড়ার শুরু। যে ৯১ শতাংশ, সে ভেবেছিল, ৯৫-এর সঙ্গে আর কতই বা তফাত? ভাল কলেজে ফর্ম নেওয়ার লাইনে দাঁড়িয়ে সে যখন আবিষ্কার করছে, ৯৫-এর নিচে নম্বর পেলে প্রিয় বিষয়টার ফর্মই তোলা যাবে না, অনিবার্য উৎপন্ন হচ্ছে হতাশা। ৯৫ পাওয়া যে পড়ুয়া ভেবেছিল, কতটাই বা তফাত ৯৮-এর সঙ্গে, মাত্র তো কয়েক পার্সেন্টেজ, মাত্র তো কয়েকটা নম্বর, সে ফর্ম তোলার লাইনে দাঁড়িয়ে দেখছে এবং বুঝছে, এই কলেজে চান্স পাওয়া দুঃসাধ্য, কারণ ৯৬-৯৮ পাওয়া শয়ে শয়ে ছাত্রছাত্রীও লাইনে অপেক্ষায়। তাহলে ৯৫-ও যথেষ্ট নয়? তবে যে শুনেছি, বাবা-কাকা মাসি-পিসিরা এই সেরা কলেজেই পড়েছেন ৮০ থেকে ৮৫ শতাংশ নম্বর পেয়ে? আমি তো ঢের বেশি পেয়েছি, তাহলে এই অবস্থা কেন? নিজেকে যতটা ভাল ভাবছিলাম মার্কশিট দেখে, আসলে মোটেই ততটা ভাল নই? অসংখ্য কিশোরমনে এই যে ধাক্কাটা লাগছে, কে দায় নেবে তার?
কলেজগুলিকে দোষ দিয়ে লাভ নেই। তাদের আসনসংখ্যা সীমিত, দুম করে কয়েকশো সিট বাড়িয়ে দেওয়া যায় না। ডিমান্ড বেশি, সাপ্লাই কম। ফলে যা হওয়ার,তাই। 'ঠাঁই নাই ঠাঁই নাই' পরিস্থিতি।
দায় নিতে হবে বোর্ডগুলিকেই, বদল ঘটাতে হবে মার্কিং পদ্ধতির। বিজ্ঞান আর কলা বিভাগের মার্কিং সিস্টেমকে আলাদা করতে হবে। মূল্যায়নের মাপকাঠির খোলনলচেই বদলে ফেলতে হবে। প্রয়োজনে হস্তক্ষেপ করা উচিত সরকারেরও। একটা প্রজন্মের লক্ষ লক্ষ ছাত্রছাত্রীকে হতাশায় আছড়ে ফেলার জমি তৈরি করে তাতে বছর বছর নম্বরের নিষ্ফলা চাষ হবে, এ জিনিস আর কতদিন মেনে নেওয়া হবে?
সেই কোন যুগে 'তোতাকাহিনী' লিখেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। অথচ দেখুন, আজও কী ভীষণ প্রাসঙ্গিক!