চল্লিশ লক্ষ মানুষকে রাষ্ট্রহীন করে দেবার প্রক্রিয়ায় একটি মাত্র শব্দ ভারতবাসীর ভোকাবুলারিতে স্থায়ীভাবে লিপিবদ্ধ হয়েছে, এনার্সি। এবার আরও একটি শব্দ ভারতবাসীর রাজনৈতিক অভিধানে চিরস্থায়ী জায়গা করে নিতে চলেছে। সিএবি। সিটিজেনশিপ অ্যামেণ্ডমেন্ট বিল, ২০১৬। বিল লোকসভায় পাশ হয়ে গিয়েছে। এবার রাজ্যসভায় পাশ হলেই বিলটিকে আইনে পর্যবসিত করা যায়। তৃতীয় যে শব্দটি উচ্চারণমাত্র আসামের বঙ্গভাষী নাগরিকবৃন্দের হাড়ে কাঁপুনি ধরছে তা হলো খিলঞ্জীয়া। ও.আই। অরিজিনাল ইনহ্যাবিট্যান্টস।
খিলঞ্জীয়া আর এনার্সি আপাতত আসামে সীমাবদ্ধ হলেও সিএবি কিন্তু সর্বভারতীয় ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। কিন্তু এনার্সি নিয়ে যে তোলপাড় সর্বভারতীয় প্রেক্ষাপটে দৃশ্যমান হয়েছিল, সিএবি নিয়ে যা কিছু প্রতিবাদ তা মূলত আসামে ( তাও ব্রহ্মপুত্র উপত্যকায়) সীমিত। এখানে মূল বিতর্ক যেটা তা হলো, সিএবি এবং এনার্সি অবস্থানগতভাবেই পরষ্পরবিরোধী। দুটি প্রক্রিয়া একসঙ্গে চালু হলে স্বাভাবিকভাবেই সিএবি এনার্সি-কে এবং এনার্সির আধার আসামচুক্তিকে নস্যাৎ করে দেবে। অতএব এনার্সি নিয়ে এতদূর এগোবার পর অসমীয়ারা শঙ্কিত হয়ে পড়ছে যে সিএবি যুগে এনার্সির কী হবে? যা হওয়ার, যা হচ্ছিল, তাই হবে। এনআরসির গুরুত্ব কমে গেলে প্রতিবাদও স্তিমিত হয়ে আসবে। নিরুপদ্রবে এনআরসির কাজ সম্পন্ন করা যাবে।
আরও পড়ুন, এন আর সি: নো-ম্যানস-ল্যান্ডের দিকে পা বাড়িয়ে
সিএবির পশ্চাদপটটি একবার খতিয়ে দেখা যাক। কেন্দ্রীয় সরকারের পক্ষে গৃহ দপ্তর ৭.৯.২০১৫ তারিখে দুটি নোটিফিকেশন জারি করে। অফিশিয়াল গেজেটে ১৯২০ সালের পাসপোর্ট অ্যাক্ট (ভারতে প্রবেশ) এবং ১৯৪৬ সালের ফরেনার্স অ্যাক্টে এই নোটিফিকেশান অনুসারে কেন্দ্রীয় সরকারের গৃহমন্ত্রক ঘোষণা করছে যে, মানবিক বিবেচনার খাতিরে বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের সংখ্যালঘু নাগরিক (অর্থাৎ মুসলিম বাদ দিয়ে অন্য সব ধর্মাবলম্বী, বিশেষত হিন্দুরা) যারা ২০১৪ সালের ৩১শে ডিসেম্বর অথবা তার আগে পাসপোর্ট বা সমজাতীয় বৈধ ভ্রমণপত্র অথবা বৈধ নথি নিয়ে (কিন্তু যার বৈধতা অতিক্রান্ত হয়েছে) ভারতে প্রবেশ করেছে, তারা ১৯২০ সালের পাসপোর্ট অ্যাক্ট (ভারতে প্রবেশ) এবং ১৯৪৬ সালের ফরেনার্স অ্যাক্টের প্রাসঙ্গিক নির্দেশাবলী ও নিয়মাবলীর আওতামুক্ত থাকবেন। প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে ২০১৪ সালের ৩১শে ডিসেম্বর এর পর বাংলাদেশে হিন্দুদের ওপর অত্যাচার কি বন্ধ হয়ে গিয়েছে? যদি না যায় তবে এরপর যে হিন্দুরা এদেশে আশ্রয় চাইবে তাদের ক্ষেত্রে কী হবে? উত্তর আসছে, নেই মামার চেয়ে কানা মামা ভাল। বিজেপির "সাম্প্রদায়িক মানবতাবাদ" এমনই পরিব্যাপ্ত হয়ে উঠছে ভারতবর্ষে।
গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো কেন্দ্রের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে ১৯৭১ সালের ২৪ মার্চের পর এবং ২০১৪ সালের ৩১শে ডিসেম্বরের মধ্যে যে সব হিন্দু বাংলাদেশী আসামে ঢুকেছে, তাদের এখন ফরেনার্স রিজিওনাল রেজিস্ট্রেশন অফিসারের কাছে আসাম তথা এ দেশের অন্যত্র বৈধভাবে বসবাসের আবেদন জানাতে হবে। স্বরাষ্ট্র দপ্তরের সূত্র এও জানিয়েছে এই মুহূর্তে তাঁরা ভারতের নাগরিক নন, এমনকী শরণার্থীও নন। বর্তমানে তাঁদের শুধু ভারতে বৈধভাবে বসবাসের সুযোগ দেওয়া হবে। বাস্তবে হিন্দু বাঙালিদের পরিচিতি নিয়ে কেন্দ্র কোনও মডালিটি প্রস্তুত করেনি। স্বভাবতই কেন্দ্রের এই অবস্থান নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
আরও পড়ুন, হারাতে বসেছে ৬০০টি ভাষা, বরাক উপত্যকার ভাষা শহিদ দিবস উপলক্ষে বিশেষ সাক্ষাৎকার
প্রশ্ন উঠছে এই বিলই যদি আনা হবে তাহলে বিজেপি এনার্সি নিয়ে এত তোড়জোড়, এত গর্জন করলো কেন? সত্যিই যদি এই বিল আইনে পরিণত হয়ে যায়, তাহলে তো এনার্সি নবায়ন সম্পূর্ণত প্রশ্নের মুখে পড়ে যাবে। আসাম চুক্তি স্ক্র্যাপ হয়ে যাবে।
ক্রমিক | প্রসঙ্গ | এনার্সি (নাগরিক পঞ্জী নবায়ন) | সিএবি (নাগরিকত্ব সংশোধনীবিল, ১৬) |
১. | ভিত্তিবর্ষ | ২৪ শে মার্চ ১৯৭১ | ৩১শে ডিসেম্বর ২০১৪ |
২. | লোকসভা নির্বাচনে আসামে বিজেপির আসন সম্ভাবনা। | আসামে এনার্সি প্রক্রিয়ার সুবাদে প্রায় ১২টা লোকসভা আসনে বিজেপির জয় প্রায় নিশ্চিত ছিল। বিশেষত ব্রহ্মপুত্র উপত্যকায়। | বরাক উপত্যকার ২ টি আসন ছাড়া কোন আসন বিজেপির জন্য অনিশ্চিত।
কিন্তু ভারতের অন্যত্রে মেসায়া হিসাবে বিজয় সম্ভাবনা বৃদ্ধি। |
৩. | শরণার্থী এবং অনুপ্রবেশকারী | অনুপ্রবেশকারী চিহ্নিত করে নাগরিকত্ব বঞ্চিত করা হবে। বিতাড়ণ করা হবে। | শরণার্থী চিহ্নিত করে তাদের নাগরিকত্ব দেওয়া হবে। আশ্রয় দেওয়া হবে। |
৪. | প্রক্রিয়ার হালহকিকৎ | প্রক্রিয়া প্রায় শেষের পথে | প্রক্রিয়া এখন বিশ বাঁও জলে। |
৫. | আক্রান্ত কারা? | মূল কোপটা নেমে এসেছে হিন্দু বাঙালীদের ওপর। | হিন্দু বাঙালী উদ্বাস্তুদের সামনে নাগরিকত্বের খুড়োর কল। |
৬. | প্রক্রিয়ায় ধর্মীয় পরিচিতির সুফল কুফল। | হিন্দু মুসলিম নির্বিশেষে বিদেশী অনুপ্রবেশকারী হিসাবে নাগরিকত্বের তালিকাচ্যূত। | মূলত বিদেশী সন্দেহে আক্রান্ত মুসলিমরাই। বাংলাদেশী হিন্দু বাঙালীরা শরণার্থী। |
৭. | অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলির অবস্থান। | প্রক্রিয়ায় মতভেদ থাকলেও প্রতিটি রাজনৈতিক দল এনার্সির সপক্ষে। | বিজেপি ছাড়া প্রতিটি রাজনৈতিক দল সিএবি।র বিপক্ষে |
৮. | কোথায় কোথায় বিরোধিতা। | সর্বভারতীয় ক্ষেত্রেই প্রবল বিরোধিতার সম্মুখীন। | সর্বভারতীয় প্রেক্ষাপটে শুধুমাত্র আসামেই প্রবল বিরোধিতার সম্মুখীন |
৯. | আক্রান্তের মানুষের আনুমানিক সংখ্যা। | এনার্সির বর্তমান পর্যায়ে নাগরিকপঞ্জীর তালিকাচ্যূত প্রায় চল্লিশ লক্ষ। বাড়তেও পারে, সামান্য কমতেও পারে। | হিন্দু শরণার্থীর সংখ্যা দেশভাগের সময় থেকে এখনও পর্যন্ত কত সে বিষয়ে কোনও তথ্য বা সমীক্ষা নেই। |
১০. | সংবিধানসম্মত কি না? | সুপ্রিম কোর্টের তত্বাবধানে কেন্দ্র সরকারের সম্মতিতে। | সংবিধান বিশেষজ্ঞদের মতে এই বিল ধর্মনিরপেক্ষ নয় এবং সমানাধিকার লংঘন করে। |
যে কোনও পাটিগণিত বলবে এবার ভোটে বিজেপির ল্যাণ্ডস্লাইড জয় অবধারিত ছিল। সাম্প্রতিক আসামে পঞ্চায়েত নির্বাচনের ফল তার প্রমাণ। এর মধ্যে নীলাকাশের বজ্রনির্ঘোষের মত বিস্মৃতপ্রায় নোটিফিকেশনকে বিল হিসাবে পাশ করানোর তোড়জোড়। কেন? যেখানে আসামে চোদ্দটি আসনের মধ্যে ১২ টিই নিশ্চিত ছিল সেখানে বাঙালী অধ্যুষিত মাত্র ২টি আসন নিয়ে সন্তুষ্ট থাকার ঝুঁকি কেন নিল বিজেপি? নিল, কারণ দশটি আসনের বিনিময়ে বহু হিন্দু আসন নিশ্চিত করতে চাইছে বিজেপি, হিন্দুদের রক্ষাকর্তা হিসাবে। একাত্তর বছর পর দেশভাগের ক্ষত খুঁচিয়ে তুলে ঘা করা হচ্ছে। মুসলিমদের চিরস্থায়ীভাবে হিন্দুদের শত্রু হিসাবে চিহ্নিত করা হচ্ছে। অন্য দলগুলিও মিনমিন করে টোকেন প্রতিবাদ করছে, কারণ বেশী প্রতিবাদী হয়ে উঠলে হিন্দু ভোট হারানোর ঝুঁকি আছে।
নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল ২০১৬ সম্যকভাবে বুঝতে গেলে ১৯৫৫ সালের নাগরিকত্ব আইন সম্বন্ধে একটু ধারণা থাকা দরকার। নাগরিকত্ব আইন, ১৯৫৫ ভারতীয় নাগরিকত্ব এবং কোন কোন ভিত্তিতে অর্জন করতে পারে তা নিয়ন্ত্রণ করে। একজন ব্যক্তি ভারতীয় নাগরিক হতে পারেন, যদি তিনি ভারতে জন্মগ্রহণ করে থাকেন বা ভারতীয় পিতামাতার সন্তান হয়ে থাকেন বা একটা নির্দিষ্ট সময় ভারতে বসবাস করে থাকেন ইত্যাদি। তবে, অবৈধ অভিবাসীদের ক্ষেত্রে ভারতীয় নাগরিকত্ব পাওয়া নিষিদ্ধ। কে অবৈধ অভিবাসী? যিনি জাল নথি, অথবা একটি অবৈধ পাসপোর্ট এবং একটি ভিসা পারমিট ছাড়াই ভারতে প্রবেশ করেছেন।
আরও পড়ুন, নাগরিকত্ব বিলের প্রতিবাদে মন্তব্য, রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগে আটক আসামের বুদ্ধিজীবীরা
এই প্রেক্ষিতে নতুন করে সংশোধনী আনা হয়েছে নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল, ২০১৬। ইমিগ্রান্টস দের মধ্যে শরণার্থী আর অনুপ্রবেশকারীর বিভাজন সংঘপরিবারের দীর্ঘদিনের ধর্মীয় রাজনীতির উপাদান। বিলের মাধ্যমে তাকেই আইনী বৈধতা দেওয়ার চেষ্টা হচ্ছে, যে বিলের একমাত্র প্যারামিটার হচ্ছে ধর্মীয় নির্যাতন। যে বিশাল সংখ্যক দরিদ্র ও অর্থনৈতিকভাবে নির্যাতিত মুসলিম জনগণ জীবনধারণের আশায় ঢুকে পড়ছে ভারতবর্ষে, এখন থেকে সরকারীভাবে তাদের অনুপ্রবেশকারী ঘোষণা করা হবে। কিন্তু যারা শরণার্থী, তাদের নাগরিকত্বের বিষয়টি সরকারীভাবে বিবেচিত হলো কী? এই বিলে তার উত্তর মেলেনা।
নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল ২০১৬ আফগানিস্তান, বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের কিছু অবৈধ অভিবাসীকে ভারতীয় নাগরিকত্বের জন্য যোগ্য বলে মঞ্জুরি দেয়। অন্য কথায়, এটি ১৯৫৫ সালের নাগরিকত্ব আইন সংশোধন করতে চেয়েছে। নথিভুক্ত শরণার্থীর চারটি দলিলের প্রয়োজন হবে। ১. যে দেশ থেকে তিনি ভারতে আসছেন সে দেশের নাগরিকত্ব প্রমাণ ২. তার ধর্মের প্রমাণ। ৩. কোন তারিখ থেকে তিনি ভারতে বসবাস করছেন। ৪. ধর্মীয় নিপীড়ন বা ধর্মীয় নিপীড়নের ভয় সম্পর্কিত প্রমাণ, নিদেনপক্ষে একটি শপথপত্র।
মনে রাখতে হবে, ২০০৩ সালে অটল বিহারী বাজপেয়ীর বিজেপি সরকার ক্ষমতায় ছিল। তখন নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন (ধারা ৬ ২০০৪) পাস হয় যা ৩/১২/২০০৪ তারিখে বলবৎ হয়। এই আইনবলে জন্মসূত্রে নাগরিকত্ব কার্যত বাতিল হয়ে যায়। এক্ষেত্রে হয় বাবা এবং মা দুজনকেই ভারতীয় হতে হবে বা এক জন ভারতীয় এবং অন্য জন অবৈধ অনুপ্রবেশকারী নয়- এই শর্ত পূরণ করতে হবে। নাগরিকত্ব প্রদানের বিপরীতে এ আইন ভারতে জন্ম নেওয়া অভিবাসীদের সন্তানদের নাগরিকত্ব হরণের নামান্তর। অথচ, নাগরিকত্ব আইনের ধারা ৪ ধারা অনুযায়ী ভারতের বাইরে জন্ম নেওয়া সন্তানদের ক্ষেত্রে যদি বাবা অথবা মা কোনও এক জন যদি ভারতীয় হন, তাহলে ছেলে-মেয়েরা ভারতীয় হবেন। অর্থাৎ ভারতে জন্ম হলে যে নাগরিক হতে পারে না, সে-ই ভারতের বাইরে জন্ম হলে ভারতের নাগরিক হয়ে যায়।
প্রস্তাবিত সংশোধনী দৃষ্টিকটুভাবে সংবিধান বিরোধী, কেননা সংবিধান অনুসারে ধর্মের ভিত্তিতে নাগরিকদের মধ্যে পার্থক্য করা এবং তার ভিত্তিতে নাগরিকত্ব প্রদান অসাংবিধানিক। সংবিধানের ১৪ অনুচ্ছেদ সকল ব্যক্তি, নাগরিক এমনকি বিদেশীরও সমান অধিকার নিশ্চিত করে। ধর্মের ভিত্তিতে জনগণের মধ্যে পার্থক্য সংবিধান লঙ্ঘন করবে। বিল এই প্রতিবেশীদেশগুলিকে ধর্মীয় নিপীড়নের প্রতিষ্ঠান হিসাবে তুলে ধরে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ককে আরও খারাপ করে তুলবে। এতদসত্ত্বেও বিল নিয়ে জেপিসি, লোকসভায় বিল পাশের পর রাজ্যসভায় বিল তোলা হলো না। সম্ভাব্য কারণ দুটি। এক, রাজ্যসভায় বিজেপি সংখ্যালঘু। দুই, আসাম জুড়ে যে প্রবল বিক্ষোভ হবে, ভাষিক পরিচয় যে ধর্মীয় পরিচয়কে ছাপিয়ে যাবে তা বিজেপি আগাম আঁচ করতে পারে নি।
আসামের ক্ষেত্রটি আদতে অনন্য। দীর্ঘদিন ধরে আসামের রাজনীতি ও সমাজনীতি এই বিদেশী সমস্যাকে ঘিরে আলোড়িত হচ্ছে। ১৯৭১-এর ২৪ মার্চকে ভিত্তিবর্ষ ধরে (আসাম চুক্তি যার আধার) বিদেশী বিতাড়ন অসমীয়াদের মগজে প্রোথিত হয়ে গেছে। এই বিল বাংলাদেশি হিন্দুদের অবৈধ অভিবাসী হিসাবে বিবেচনা করবে না। ফলে বিলের বিরুদ্ধে আসাম উত্তাল। তাদের ভয়, বিলটি এনার্সি এবং আসাম চুক্তি দুটিকেই অর্থহীন করে দেবে। আসামের ৩০.৯% মুসলিম। ১২৬টি বিধানসভা আসনের মধ্যে অন্তত ৪০ টি আসনে মুসলিম জনসংখ্যা ৪০ থেকে ৮০ শতাংশ। হাইলাকান্দি, বরপেটা, নগাওঁ, ধুবরী, বঙ্গাইগাঁও, গোয়ালপাড়া, করিমগঞ্জ, দরং, মোরিগাঁও জেলায় মুসলমান সংখ্যাধিক্য। এই মুসলিম জুজু দেখিয়েই মরিয়া বিজেপি হিন্দুভোট সংহত করতে চাইছে। সঙ্গে আসাম চুক্তির ৬এ ধারাকে খিলঞ্জীয়াদের সামনে টোপ হিসাবে খাড়া করছে। মানবতার নামে সাম্প্রদায়িক বিভাজন বিজেপির আপাত কর্মসূচি।
এনার্সি এবং সিএবি পরস্পরবিরোধী। কোনটাকে বাতিল করা হবে অবিলম্বে জানানো হোক। এনার্সিতে নাম বাদ গেল, কিন্তু নাগরিকত্ব বিল সুবাদে নাগরিক হলেন, এই পরস্পর বিরোধী জাতীয় সংকট সৃষ্টির দায় কে নেবে জানানো হোক। অবশ্যই লোকসভা নির্বাচনের আগে। সত্যি যদি বাংলাদেশ থেকে চল্লিশ লক্ষ মানুষ এসে থাকে, যাদের অনেকাংশকে নাগরিকত্ব দিতে কেন্দ্রীয় সরকার বদ্ধপরিকর, তাদের দায়িত্ব একা আসাম কেন বইবে? সারা ভারত দায়িত্ব নিক। লাভের গুড় আমি খাবো, আর আসামবাসী পিঁপড়ের কামড় খাবে, সে কেমন কথা?
বলা হচ্ছে যে নাগরিকত্ব দেওয়া হবে শরণার্থীরদের শনাক্ত করার তারিখ থেকে ছয় বছর পর। প্রশ্ন হলো, এই ছয় বছর সময়কাল জুড়ে এইসব মানুষদের স্ট্যাটাস কী হবে? বর্তমান আইন অনুযায়ী তাঁরা এই অন্তর্বতী সময়ে বিদেশী হিসাবেই চিহ্নিত থাকবেন এবং এঁদের দীর্ঘ মেয়াদী ভিসা ও ওয়ার্ক পারমিট দেওয়া হবে। এই সময়ে কিন্তু নাগরিকদের প্রদত্ত সব অধিকার থেকে বঞ্চিত থাকবেন , শুধু মাত্র কিছু সীমিত সুযোগ সুবিধা পাবেন। শুধু তাই নয়, তাঁরা আসামের বাইরে কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া যেতে পারবেন না। এনার্সি প্রক্রিয়ায় শরণার্থী, অনুপ্রবেশকারী এবং খিলঞ্জীয়া নামে তিনটি ভাষিক ও ধর্মীয় বিভাজন করে একের বিরুদ্ধে অন্যকে লড়তে উৎসাহিত করে আসছে। এবার বিজেপির সাম্প্রদায়িক মানবতার ফলে ভারতের অন্য রাজ্যগুলিও প্রলুব্ধ হচ্ছে। ফলে দেশব্যাপী এক দীর্ঘস্থায়ী গৃহযুদ্ধের সূচনাকাল উপস্থিত।