Advertisment

ভয়াবহ দুর্দশা, এখনও সরকারি রেশন পান নি ৯৬ শতাংশ শ্রমিক, বলছে রিপোর্ট

"লকডাউনের দু'সপ্তাহ পার হওয়ার পর সরকারি রেশন পেয়েছিলেন স্রেফ এক শতাংশ শ্রমিক, এবং তিন সপ্তাহ পেরোনোর পরও মাত্র চার শতাংশ পেয়েছেন এই রেশন।" 

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
india lockdown relief for poor

লকডাউন আংশিক শিথিল হতে শুরু দিন গুজরানের কাজ। ছবি: শশী ঘোষ, ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা

Coronavirus (COVID-19): আগামী ৩ মে পর্যন্ত চলবে দেশব্যাপী লকডাউন, এই প্রেক্ষিতেই ভারতের বিভিন্ন শহরে আটকে পড়া পরিযায়ী শ্রমিকদের ভয়াবহ আর্থিক দুর্দশা এবং ব্যাপক অনাহারের ছবি তুলে ধরেছে একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন দ্বারা পরিচালিত এক সমীক্ষা।

Advertisment

COVID-19 এর মোকাবিলায় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী প্রথমবার লকডাউন ঘোষণা করার দু'দিন পর, অর্থাৎ ২৭ মার্চ থেকেই সাহায্যের আবেদন পেতে শুরু করেন একদল শিক্ষাবিদ এবং খাদ্য অধিকার কর্মী। আবেদন আসে মহারাষ্ট্র, কর্ণাটক, উত্তরপ্রদেশ, পাঞ্জাব, দিল্লি, এবং হরিয়ানায় আটকে পড়া অসহায় শ্রমিকদের কাছ থেকে। বেঙ্গালুরুর আজিম প্রেমজি ইউনিভার্সিটির সহকারী অধ্যাপক রাজেন্দ্র নারায়ণন বলছেন, "প্রথমে আমরা সরাসরি কিছু টাকা ট্রান্সফার করে সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করি, কিন্তু শিগগিরই বুঝতে পারি বঞ্চনার মাত্রাটা ঠিক কতটা বিপুল।"

চলতি মাসের ১৩ তারিখ পর্যন্ত স্ট্র্যান্ডেড ওয়ার্কার্স অ্যাকশন নেটওয়ার্ক (Stranded Workers Action Network বা SWAN)-এর ৭৩ জন কর্মীর সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন আটকে পড়া শ্রমিকদের ৬৪০টি দল - যাদের মধ্যে রয়েছেন দেশজুড়ে আটকে পড়া ১১,১৫৯ জন শ্রমিক। ওই কর্মীরা সরাসরি ৩.৮ লক্ষ টাকা অর্থসাহায্য করা ছাড়াও শ্রমিকদের যোগাযোগ করিয়ে দিয়েছেন কিছু স্থানীয় সংগঠনের সঙ্গে, এবং সরকারি সুবিধা পাওয়ার ব্যবস্থাও করেছেন। "এখানে কোনও গবেষণার কথা ভাবি নি আমরা প্রথমে, কিন্তু যে তথ্য আমরা সংগ্রহ করেছি, তা লকডাউনের আবহে পরিযায়ী শ্রমিকদের অভিজ্ঞতাটা কিছুটা হলেও বুঝতে সাহায্য করবে আমাদের," বলছেন নারায়ণন।

সংশ্লিষ্ট শ্রমিকদের সিংহভাগই হয় শহরে থেকে যাওয়াই মনস্থ করেছেন, নাহয় দীর্ঘ পথ পায়ে হেঁটে বাড়ি ফিরতে পারেন নি। ১৩ এপ্রিল পর্যন্ত যাঁরা সাহায্য চেয়ে SWAN-এর স্বেচ্ছাসেবীদের ফোন করেছেন, তাঁদের মধ্যে ৪৪ শতাংশ মরিয়া হয়ে খাবার অথবা টাকা চেয়েছেন। লকডাউনের দ্বিতীয় সপ্তাহের শেষে এই হার ছিল ৩৬ শতাংশ।

SWAN-এর রিপোর্টে বলা হয়েছে, সবরকম প্রচেষ্টা এবং প্রতিশ্রুতি সত্ত্বেও পরিযায়ী শ্রমিকদের সাহায্য করতে গিয়ে কার্যত হোঁচট খাচ্ছে কেন্দ্র এবং রাজ্য সরকারগুলি। উদাহরণস্বরূপ, ৯৬ শতাংশের কাছে সরকারি রেশন পৌঁছয় নি, এবং ৭০ শতাংশ পান নি রান্না করা খাবার। সমীক্ষার আওতায় অধিকাংশ শ্রমিকই (৩,৯৯২ জন) মহারাষ্ট্রে আটকে আছেন, এবং এঁদের মধ্যে এক শতাংশেরও কম সংখ্যকের কাছে পৌঁছেছে সরকারি রেশন। প্রায় ৯০ শতাংশ আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন যে আগামী দু'দিনের মধ্যে তাঁদের সঞ্চিত রসদ ফুরিয়ে যাবে।

আরও পড়ুন: “গরীবদেরকে বাঁচিয়ে রাখা মোদী সরকারের অগ্রাধিকারের মধ্যে পড়ছে না”, বিস্ফোরক চিদাম্বরম

যে মুম্বই শহরে মঙ্গলবার রেল স্টেশনে জমায়েত হন অসংখ্য অস্থির শ্রমিক, সেই মুম্বইতেই সবচেয়ে কঠিন হচ্ছে খাবার এবং রেশনের যোগান দেওয়া। SWAN-এর রিপোর্ট অনুযায়ী, "অ্যান্টপ হিল-এর মতো জায়গায় আমরা ৩০০ জনের বেশি পরিযায়ী শ্রমিকের সঙ্গে যোগাযোগ করেছি। এঁরা রান্না করা খাবার যোগাড় করতে হিমসিম খাচ্ছেন, এবং প্যাকেটের খাবার খেয়ে শিশুদের অসুস্থ হয়ে পড়ার একাধিক রিপোর্ট রয়েছে। সবরকম হেল্পলাইনে ফোন করেও কোনও লাভ হয় নি। তালোজা-পানভেল এলাকায় আটকে পড়েছেন প্রায় ৬০০ জন, যাঁদের মধ্যে মহিলারাও রয়েছেন, একেবারে ছোট শিশুরাও রয়েছে, যাদের বয়স স্রেফ কয়েক সপ্তাহ। ওই এলাকায় যেসব সংগঠন কাজ করছে, তাদের এত সংখ্যক মানুষকে সাহায্য করার ক্ষমতা নেই। অতি দ্রুত সরকারি হস্তক্ষেপের প্রয়োজন।"

রিপোর্টে আরও বলা হয়েছে যে ক্ষুধা এবং দুর্দশার হার পরিত্রাণের তুলনায় অনেকটাই বেশি, যদিও পরিস্থিতি ক্রমাগত পরিবর্তনশীল। "যেসব মানুষ কোনও সরকারি রেশন পান নি, তাঁদের হার ৮ এপ্রিলে ছিল ৯৯ শতাংশ, যা ১৩ এপ্রিলে দাঁড়ায় ৯৬ শতাংশে। অর্থাৎ লকডাউনের দু'সপ্তাহ পার হওয়ার পর সরকারি রেশন পেয়েছিলেন স্রেফ এক শতাংশ শ্রমিক, এবং তিন সপ্তাহ পেরোনোর পরও মাত্র চার শতাংশ পেয়েছেন এই রেশন।"

india lockdown relief for poor দিল্লিতে যমুনা নদীর পাড়ে গৃহহারা পরিযায়ী শ্রমিকদের জমায়েত। ছবি: তাশি তোবগিয়াল, ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস

নারায়ণন বলছেন, বর্তমান পরিস্থিতি এটাই প্রমাণ করে যে অধিকাংশ প্রশাসনই এতদিন পরিযায়ী শ্রমিকদের প্রতি কোনোরকম নজরই দেয় নি। তাঁর কথায়, "আন্তঃরাজ্য পরিযায়ী শ্রমিক আইন ১৯৭৯ (Interstate Migrant Worker Act (1979) অথবা স্ট্রিট ভেন্ডরস অ্যাক্ট ২০১৪-র মতো বিভিন্ন আইনের আওতায় সরকার পরিযায়ী শ্রমিক সংক্রান্ত তথ্য নথিভুক্ত করতে বাধ্য, কিন্তু বাস্তবে তাঁদের কার্যকলাপ প্রশাসনের নজর এড়িয়ে গিয়েছে। যে কারণে এখন শ্রমিকদের সাহায্য করাটা এতটা কঠিন হয়ে পড়ছে রাজ্যগুলির পক্ষে।"

SWAN-এর রিপোর্ট আরও বলছে, কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের নির্দেশিকা জারি হওয়া সত্ত্বেও লকডাউন চলাকালীন তাঁদের নিয়োগকর্তাদের কাছ থেকে বেতন পান নি ৮৯ শতাংশ শ্রমিক। অধিকাংশই যে সংস্থা বা বিল্ডারের জন্য কাজ করছিলেন, তাদের নামই জানেন না। জানেন স্রেফ ঠিকাদারদের নাম, যাঁদের অধিকাংশই ফোন সুইচ অফ করে রেখেছেন। রিপোর্টে বলা হয়েছে, "বিভিন্ন সরকার যদি পরিযায়ী শ্রমিকরা কোন কোন ক্ষেত্রে কাজ করছেন, কাদের জন্য ক'জন কাজ করছেন, সে সম্পর্কে আরও সঠিক তথ্য রাখত, তবে এই খাদ্য সমস্যা অনেকাংশেই এড়ানো যেত। আরও কার্যকরী ভাবে রেশন পৌঁছে দেওয়া যেত।"

টাকা এবং খাবারের মধ্যে কোনও একটা বেছে নেওয়ার ক্ষেত্রেও সতর্ক করে দিচ্ছেন নারায়ণন। "ভারতের মাননীয় প্রধান বিচারপতি জানতে চেয়েছেন শ্রমিকদের যখন খাবার দেওয়া হচ্ছে, তখন টাকা দেওয়ার কী প্রয়োজন। কিন্তু অনেক ছোট ছোট দলে আটকে পড়া শ্রমিকের কাছেই টাকাটা প্রায় লাইফলাইন বলা চলে, যখন ওষুধ কেনার দরকার হয়, বা ফোন রিচার্জ করতে হয়, কারণ ফোন ছাড়া সাহায্য চাওয়ার কোনও উপায় নেই। হাতে ৩০০ টাকাও নেই, এই পরিস্থিতি তাঁদের পক্ষে ভয়াবহ।"

নারায়ণন বলছেন যে এই পরিস্থিতিতে সুরাট বা মুম্বইয়ের মতো শহরে রাগ এবং হতাশা নিয়েই বাড়ি যাওয়ার দাবি তুলে পথে নামছেন পরিযায়ী শ্রমিকরা। "হাতে টাকা নেই। ন্যূনতম চাহিদাটুকুও মিটছে না। রেশন পাওয়া একরকম অসম্ভব। কবে বাড়ি যেতে পারবেন তা নিয়ে প্রবল অনিশ্চয়তা রয়েছে। কাজ না থাকলেও পরিবারের সঙ্গে থাকতে চাইছেন তাঁরা, কারণ যেখানে এই মুহূর্তে রয়েছেন, সেখানে তাঁদের না আছে কোনও সামাজিক পরিচয়, না আছে ক্ষমতা। রাগ, হতাশা, এবং জোর করে আটকে রাখার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ, সব মিলেমিশে গেছে। তাঁদের দুঃখের কথা বা অনুরোধ শোনার মতো কেউ নেই," বলছেন নারায়ণন।

এই ঘোর দুর্দশা কাটাতে SWAN কয়েকটি পরামর্শ দিয়েছে - ১) আগামী তিনমাসের জন্য গণবণ্টন ব্যবস্থার মাধ্যমে দ্বিগুণ রেশন দেওয়া হোক সকলকেই; ২) প্রতি ১ লক্ষ মানুষ পিছু ৭০টি 'ফিডিং সেন্টার' খোলা হোক, যেখানে অন্তত দু'বেলা রান্না করা খাবার পাওয়া যাবে; ৩) আপৎকালীন ভিত্তিতে আগামী দু'মাস সাত হাজার টাকা করে দেওয়া হোক প্রত্যেক দরিদ্র গৃহস্থালি/পরিযায়ী শ্রমিককে (বায়োমেট্রিক শনাক্তকরণ ছাড়াই); ৪) মাসে ২৫ দিনের ন্যূনতম বেতন 'জন ধন' অ্যাকাউন্টে জমা করা হোক।

রিপোর্টের বক্তব্য, "আক্ষরিক অর্থেই সার্বজনীন রেশন এবং সরাসরি অর্থ দান না করা হলে অত্যন্ত আশঙ্কাজনক হারে দারিদ্র এবং চরম হতাশার সম্মুখীন হতে চলেছে ভারত।"

ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা এখন টেলিগ্রামে, পড়তে থাকুন

coronavirus Lockdown
Advertisment