২০০৯ সালে আফগানিস্তানের রাষ্ট্রপতি হামিদ কারজাই একটি প্রস্তাবিত শরিয়া বিলে স্বাক্ষর করেন যেখানে বলা হয়েছিল, স্বামী স্ত্রীকে শারীরিক সম্পর্কের জন্য, স্ত্রীর ইচ্ছার বিরুদ্ধে বলপ্রয়োগ করতে পারেন। সেই সময় নানা মহল থেকে হামিদ কারজাইয়ের বিরুদ্ধে জনমত গড়ে উঠেছিল। সম্প্রতি সুপ্রিম কোর্টের প্রাক্তন প্রধান বিচারপতি দীপক মিশ্র বলেছেন, ভারতে দাম্পত্য ধর্ষণকে অপরাধ হিসাবে গণ্য করা অনুচিত। বৈবাহিক ধর্ষণ-সংক্রান্ত কোনও আইন আনার প্রয়োজন নেই বলে তিনি ব্যক্তিগতভাবে মনে করেন। তাঁর মতে, এমন আইন বলবৎ হলে ভারতে চরম নৈরাজ্য ঘনিয়ে আসবে, পরিবার ভেঙে পড়বে।
ইতিপূর্বে মানেকা গান্ধী সহ অনেকেই বৈবাহিক ধর্ষণের বিরুদ্ধে আইন আনার বিরোধিতা করেছেন। গত বছর গুজরাত হাইকোর্টের বিচারপতি জে পি পার্দিওয়ালা রায় দিয়েছিলেন, স্বামী বলপূর্বক রমণ করলে ভারতীয় দণ্ডবিধির ৩৭৫ নম্বর ধারায় ধর্ষণ সংক্রান্ত সংজ্ঞায় তা গ্রাহ্য হবে না। তবে ওরাল ও অস্বাভাবিক যৌনতা নিষ্ঠুরতার আওতায় পড়ে বলে আদালত জানিয়েছিল। কিন্তু জোর করে যৌনতায় বাধ্য করলে বড়জোর শ্লীলতাহানির অভিযোগ আনা যেতে পারে।
আরও পড়ুন, কোনও মেয়ে একা থাকে মানেই ‘ছেলে’ ডেকে ‘ফুর্তি’ করে না: রূপা
২০১৪ সালের একটি সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে, সমীক্ষার আওতাধীন প্রায় ৬০ শতাংশ ভারতীয় পুরুষ জানিয়েছেন যে তাঁরা বলপ্রয়োগ করে বেশি যৌনসুখ পান। এই ধর্ষকামী ‘স্বামী’ নামক পুরুষটির বিরুদ্ধে থানায় অভিযোগ করতে গেলে পুলিশ মুচকি হাসে, স্বামী আবার ধর্ষণ করতে পারে নাকি! স্ত্রীর ইচ্ছার বিরুদ্ধে রমণ, সে তো তার জন্মগত অধিকার। মজার কথা, কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী ওই সময় বলেছিলেন, ভারতের মতো দেশে বিবাহের সঙ্গে ধর্মীয় সংস্কার নিবিড়ভাবে যুক্ত। স্বামী যদি স্ত্রীকে ধর্ষণ করেন তবে তা ভারতীয় সংস্কৃতি ও রীতিনীতির প্রেক্ষিতে অবৈধ নয়।
মনে রাখতে হবে, ভারতীয় আইন ব্যবস্থা ও সংস্কৃতি, দুটি এক কথা নয়। প্রথা বা রীতিনীতির সঙ্গে আইনের বিস্তর তফাৎ আছে। এমনকি অনৈতিকতা ও অপরাধের মধ্যেও দুস্তর ব্যবধান। তবু অস্বীকার করার উপায় নেই যে, ভারতীয় আইনের বেশির ভাগই এসেছে ভারতীয় ধর্মশাস্ত্র থেকে। ধর্মশাস্ত্র বা সংহিতা, যাকে আমরা স্মৃতিশাস্ত্র বলে থাকি, তা হল বেদ বা শ্রুতি-অনুসারী। দেওয়ানি বা ফৌজদারি, উভয় আইনের বেশির ভাগটাই এই সব ধর্মশাস্ত্র থেকে উদ্ভূত; তবে বিভিন্ন ধর্মের দেওয়ানি বিধি আলাদা; কিন্তু ফৌজদারি আইন ভারতীয় নাগরিকদের ক্ষেত্রে এক ও অভিন্ন বলেই ধরা হয় - দু-একটি ক্ষেত্রে সামান্য ব্যতিক্রম বাদ দিয়ে।
আরও পড়ুন, ‘মিটু’ প্রসঙ্গে আর একবার মুখ খুললেন প্রিয়াঙ্কা
‘বৈবাহিক ধর্ষণ’ নামক বিষয়টি দেওয়ানি না ফৌজদারি আদালতের আওতায় পড়বে? বিবাহ নামক প্রতিষ্ঠান হল সাধারণভাবে দেওয়ানি আদালতের বিষয়, কিন্তু গার্হস্থ্য হিংসা ও ধর্ষণের মতো বিষয় হল ফৌজদারি অপরাধ। ভারতীয় সংস্কৃতিতে দাম্পত্য ধর্ষণ গৃহীত ও অনুমোদিত, এই বাক্যটি রীতিমতো বিতর্কের বিষয়। এমনকি সেমিটিক ধর্ম ও পুরাণসমূহেও বৈবাহিক ধর্ষণকে অপরাধ হিসাবে ব্যাখ্যা করা হয়। ‘বীরত্বপূর্ণ ধর্ষণ’ রোমের পুরাণে থাকলেও এই দেশে দেবগুরু বৃহস্পতির কিংবা দেবরাজ ইন্দ্রের ধর্ষণকে শাস্ত্র অবৈধ ঘোষণা করেছে এবং শাস্তির নিদান দিয়েছে। কিন্তু এই সব উদাহরণ তো ধর্ষণের, বৈবাহিক ধর্ষণের নয়। ধর্ষণের পূর্বে "বিবাহ' শব্দটি বলাৎকারকে বৈধ করে তুলছে, এমনই বিবাহের দাপট। কিন্তু সত্যিই কি তাই?
দাম্পত্য বলাৎকার নিয়ে 'মনুসংহিতার' তৃতীয় অধ্যায়ের ৪৫ নম্বর শ্লোকে আছে - "ঋতুকালাভিগামী স্যাৎ স্বদারনিরতঃ সদা।/পর্ববর্জং ব্রজেচ্চৈনাং তদ্ ব্রতো রতিকাম্যয়া।" এর অর্থ হলো, ঋতুকালে নিজ পত্নীতে গমন করবে। কামনিরসনের জন্য পর্ব বা পার্বণে কিংবা কোনও শুভানুষ্ঠানে এটি বর্জ্য।
আপাতদৃষ্টিতে এখানে দাম্পত্য ধর্ষণ নিয়ে কোনও নিষেধাজ্ঞা নজরে না পড়লেও কুল্লুকভট্টের টীকা ও ব্যাখ্যা পড়লে বোঝা যায়, আচার্য মনু বৈবাহিক ধর্ষণকে বৈধ বলেন নি। সংহিতায় বলা হচ্ছে, পত্নীর ইচ্ছাবশত ঋতুকালেই হোক বা ঋতুভিন্নকালে, পর্বদিনগুলি বাদ দিয়ে অন্য দিনে স্ত্রীগমন করা চলবে, শুধুমাত্র রমণেচ্ছার বশীভূত হয়ে তা করা চলবে না। এখানে পত্নীর ইচ্ছা বিষয়টি খুব গুরুত্বপূর্ণ।
অনেকে অবশ্য বৃহদারণ্যক উপনিষদের একটি শ্লোক (৬/৪/৭)-কে দাম্পত্য ধর্ষণের সপক্ষে তুলে ধরার চেষ্টা করেন - সে (স্ত্রী) সম্মত না হলে, তাকে ক্রয় করো (উপহারসামগ্রী দিয়ে) এবং যদি সে তার পরেও অনমনীয় থাকে, তবে তাকে লাঠি দিয়ে বা হাত দিয়ে আঘাত করো এবং এগিয়ে যাও এই মন্ত্র উচ্চারণ করে, ‘আমি তোমার মর্যাদাহানি করি’ ইত্যাদি; তবেই তার শিক্ষা হবে।
আরও পড়ুন, আবার বিস্ফোরক তনুশ্রী, অভিযোগের তির এবার অজয়ের দিকে
উপনিষদ যেহেতু শ্রুতি, তাই 'মনুসংহিতা' নামক স্মৃতিশাস্ত্রের তুলনায় তার মান্যতা অনেক বেশি। কিন্তু মনে রাখতে হবে, উপনিষদ তথা বেদের শ্লোকগুলির অর্থ গূঢ় ও বহুরৈখিক, সব সময় তাকে আক্ষরিক অর্থে বুঝলে চলবে না। কেউ কেউ বলেন, বৃহদারণ্যক উপনিষদের এই শ্লোকটি আসলে কৃষিকেন্দ্রিক। এখানে স্বামী বলতে প্রযতি এবং স্ত্রী বলতে প্রকৃতিকে বোঝানো হয়েছে। জমির কর্ষণ ও ফসল উৎপাদন হল এর উপপাদ্য। যদি আমরা পুরাণের দিকে নজর দিই, তাহলে দেখতে পাব, বিষ্ণুপুরাণে অনিচ্ছুক স্ত্রীর সঙ্গে স্বামীর যৌনসংসর্গকে অনুচিত বলা হয়েছে। স্পষ্ট ভাষায় সেখানে উক্ত হয়েছে - স্বামী অস্নাতা, অসুস্থ, ঋতুমতী, অনিচ্ছুক (নানিষ্টাং), রাগান্বিত, গর্ভবতী, অকামী স্ত্রীকে রমণের প্রস্তাবই দেবেন না। রমণ বা সঙ্গম অনেক পরের ব্যাপার।
ফলে যাঁরা ভারতীয় সংস্কৃতির দোহাই দিয়ে বলছেন যে বৈবাহিক ধর্ষণকে অপরাধ বলা যাবে না, তাঁদের বৌদ্ধিক, যৌক্তিক ও মানবিক বৃত্তি নিয়ে তীব্র সন্দেহ করা উচিত ও প্রতিবাদে রাস্তায় নামা দরকার। মনে রাখতে হবে, পৃথিবীর বহু দেশেই বৈবাহিক বলাৎকার নিষিদ্ধ। সেই ১৯২২ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন দাম্পত্য ধর্ষণকে অপরাধের তকমা দিয়েছিল।
ইসলাম ধর্মে কোরাণের দ্বিতীয় সুরা বাকারার ২২৩ আয়াতের কথা বলে অনেকে দাম্পত্য বলাৎকারকে বৈধ বলতে চান। সেখানে বলা হয়েছে, “তোমাদের স্ত্রীরা হল তোমাদের শস্যক্ষেত্র। তোমরা যেভাবে ইচ্ছা তাঁদের ব্যবহার করো…" কিন্তু এই আয়াতের ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে বিভিন্ন উলেমার বিভিন্ন মত রয়েছে। এখানে ‘যেভাবে ইচ্ছা’ বলতে সঙ্গমের ভঙ্গী ইত্যাদির কথা বলা হয়েছে বলে অনেকে মনে করেন। দারুল ইফতাও ফতোয়া জারি করে জানিয়েছে যে বৈবাহিক ধর্ষণ ইসলামে অননুমোদিত। মুসলমানপ্রধান দেশ তুরস্ক, মালয়েশিয়ায় বৈবাহিক বলাৎকার অপরাধ।
আরও পড়ুন, নির্বাচনী ইস্তেহারে যেসব নাগরিক অধিকারের কথা নেই
অনেকে বাইবেলের উদ্ধৃতি দিয়ে দাম্পত্য বলাৎকারকে বৈধতা দিতে চান, কিন্তু ক্যাথলিক ও প্রোটেস্টান্ট ধর্মগুরুরা সেই সব শ্লোকের ভিন্ন ব্যাখ্যা দিয়ে বৈবাহিক ধর্ষণকে অপরাধ বলতে চেয়েছেন। আমেরিকার ৫০-টি রাজ্যে তা ফৌজদারি অপরাধ। এমনকি হিন্দু দেশ নেপালও ২০০৬ সালে একে অপরাধ হিসাবে ঘোষণা করে।
‘কামসূত্র’ এই দেশের একটি প্রাচীন গ্রন্থ। মহর্ষি বাৎস্যায়ন তার লেখক। তিনি ওই গ্রন্থে বলছেন, যৌনতার একটি উদ্দেশ্য কখনও সখনও সন্তান-উৎপাদন হতে পারে, কিন্তু সেটাই একমাত্র লক্ষ্য নয়। স্ত্রীলোক পশুদের থেকে আলাদা কারণ সে সন্তানধারণের উপযুক্ত সময় ছাড়াও রমণে প্রবৃত্ত হয়। পুরুষের মতো নারীও আনন্দের জন্যই যৌনতা চায়। যদি কোনও স্ত্রীলোক বোঝেন যে তাঁর স্বামী সন্তোষজনক যৌনসঙ্গী নন, তিনি সেই যৌনসঙ্গীকে ত্যাগ করতে পারেন। বিধবারাও যৌনতৃপ্তির জন্য সঙ্গী খুঁজতে পারেন। প্রাচীন এই গ্রন্থটি নিঃসন্দেহে বৈপ্লবিক।
শাস্ত্রে নারীকে ও নারীর ব্যক্তিত্বকে বিভিন্নভাবে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। রমণীর নানা মাত্রা প্রাচীন গ্রন্থসমূহে বিদ্যমান। স্ত্রীলোক সেখানে শুধু ভোগ্যপণ্য, তার ইচ্ছা বা অনিচ্ছের মূল্য নেই; পুরুষের বাসনা হলেই ইচ্ছার বিরুদ্ধে নারী-শরীরের দখল নেওয়া যায়, এই ধারণা একদেশদর্শী ও বিভ্রান্তিকর। ভারতীয় ভাবাবেগ ও সংস্কৃতির কথায় মাথায় রেখে দাম্পত্য বলাৎকারকে অপরাধ ঘোষণা করা যাবে না, এই কথা যাঁরা বলছেন, তাঁরা না পড়েছেন ভারতীয় শাস্ত্র, না মানেন প্রাকৃতিক ন্যায়ের বিধান, না বিশ্বাস করেন নারী-পুরুষের সমান অধিকারে, না স্বীকার করেন ব্যক্তির শরীরী অধিকার।
( ঔপন্যাসিক, প্রবন্ধকার শামিম আহমেদ বেলুড় রামকৃষ্ণ মিশন বিদ্যামন্দিরে দর্শনের বিভাগীয় প্রধান। মতামত ব্যক্তিগত।)