নভেল করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব এবং তৎপরবর্তী ২১ দিনের লকডাউনের জেরে ভারতের অর্থনীতি কার্যত অচল হয়ে পড়ার ফলে যে পরিযায়ী শ্রমিকদের, বিশেষ করে মৌসুমি শ্রমিকদের, কী ভয়াবহ পরিস্থিতিতে পড়তে হয়েছে, তা ধরা পড়েছে ৩,১৯৬ জন শ্রমিককে নিয়ে করা এক সাম্প্রতিক সমীক্ষায়। এঁদের মধ্যে অধিকাংশই এই অচলাবস্থার জন্য প্রস্তুত ছিলেন না, বলাই বাহুল্য, এবং সমীক্ষার ফলাফল বলছে, লকডাউনের জেরে গত এক সপ্তাহ থেকে তিন সপ্তাহের মধ্যে কাজ খুইয়েছেন ৯২.৫ শতাংশ শ্রমিক।
উত্তর এবং মধ্য ভারতের শ্রমিকদের সঙ্গে ফোনে কথা বলে এই সমীক্ষা প্রস্তুত করেছে জন সাহস নামের একটি এনজিও, এবং সমীক্ষায় প্রকাশ পেয়েছে কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য: এক, "৪২ শতাংশ শ্রমিক বলেছেন যে তাঁদের কাছে একদিনের মতো বাড়তি খাবারও মজুত নেই, গোটা লকডাউন পর্ব তো দূরের কথা"। এছাড়াও ৬৬ শতাংশ শ্রমিক বলেছেন যে ২১ দিনের বেশি সময় ধরে লকডাউন চললে এক সপ্তাহের বেশি সংসারের খরচ চালাতে পারবেন না তাঁরা।
আরও পড়ুন: ‘করোনায় হটস্পট নয় এমন এলাকা খোলার প্রস্তুতি নিন’, কেন্দ্রীয় মন্ত্রীদের বার্তা মোদীর
দুই, এক-তৃতীয়াংশ উত্তরদাতা বলেছেন তাঁরা "লকডাউনের ফলে এখনও তাঁদের গন্তব্য শহরে আটকে রয়েছেন, এবং হাতে জল, খাবার, আর টাকা হয় নেই, নাহয় খুবই সামান্য"। ওদিকে প্রায় অর্ধেক শ্রমিক ইতিমধ্যে নিজেদের গ্রামে পৌঁছে গেলেও সেখানে রোজগার এবং খাদ্যসামগ্রী না পাওয়ার ফলে অন্যরকম চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হচ্ছেন।
তিন, "৩১ শতাংশ শ্রমিক" স্বীকার করেছেন যে "তাঁদের ঋণ রয়েছে, যা কাজ না করতে পারলে শোধ করতেও পারবেন না তাঁরা"। এই ঋণের সিংহভাগ এসেছে মহাজনদের কাছ থেকে, ব্যাঙ্ক থেকে যতজন ঋণ নিয়েছেন, তার প্রায় তিনগুণ। অদূর ভবিষ্যতে ঋণ শোধ করতে না পারার ভয় পাচ্ছেন ৭৯ শতাংশ মজদুর, এবং "একটি আশঙ্কাজনক তথ্য হলো যে প্রায় ৫০ শতাংশ শ্রমিক যাঁরা ঋণ নিয়েছেন, তাঁরা ভয় পাচ্ছেন যে ঋণ শোধ করতে না পারলে তাঁদেরকে কোনও ধরনের হিংসার সম্মুখীন হতে হবে"।
গত ২৪ মার্চ কেন্দ্রীয় শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রকের তরফে জারি করা একটি নির্দেশিকায় রাজ্য এবং কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলগুলির সরকারকে বলা হয়, ডিরেক্ট বেনিফিট ট্র্যান্সফার (DBT)-এর মাধ্যমে বিভিন্ন লেবার ওয়েলফেয়ার বোর্ড দ্বারা বিল্ডিং অ্যান্ড আদার কন্সট্রাকশন ওয়ার্কার্স সেস অ্যাক্ট-এর আওতায় সংগৃহীত শুল্ক তহবিল থেকে নির্মাণ শ্রমিকদের অ্যাকাউন্টে অর্থ জমা করতে। কিন্তু সমীক্ষায় দেখা গেছে, "৯৪ শতাংশ শ্রমিকদের বিল্ডিং অ্যান্ড কন্সট্রাকশন ওয়ার্কার্স পরিচয়পত্রই নেই, যার ফলে ৩২ হাজার কোটি টাকার বিল্ডিং অ্যান্ড আদার কন্সট্রাকশন ওয়ার্কার্স তহবিলের জোরে রাষ্ট্রের ঘোষিত কোনোরকম সুবিধেই তাঁরা পাবেন না"।
আরও পড়ুন: ভারতের গ্রামের আসল চেহারা দেখাল ‘পঞ্চায়েত’ ওয়েব সিরিজ
সমীক্ষায় দেখা যাচ্ছে, এই মুহূর্তে পরিযায়ী শ্রমিকরা চান প্রথমত খাদ্য, এবং তারপর মাসে মাসে আর্থিক সহায়তার প্রতিশ্রুতি। প্রায় ৮৩ শতাংশের এই আশঙ্কা যে অচলাবস্থার শেষে তাঁরা কাজ পাবেন না, এবং ৮০ শতাংশ মনে করেন যে ২১ দিনের লকডাউনের ফলে তাঁদের পরিবারকে অনাহারে থাকতে হবে।
সমীক্ষায় এও প্রকাশ পেয়েছে যে ৫৫ শতাংশ শ্রমিকের দৈনিক আয় ছিল ২০০ থেকে ৪০০ টাকা, যা দিয়ে গড়ে চার-সদস্যের পরিবারের খরচ চলত, এবং আরও ৩৯ শতাংশের দৈনিক আয় ৪০০ থেকে ৬০০ টাকা। এর অর্থ হলো এই শ্রমিকদের অধিকাংশই ন্যূনতম মজুরির চেয়ে কম টাকা আয় করেন, কারণ দিল্লিতে দক্ষ, আধা-দক্ষ, এবং অদক্ষ শ্রমিকের যথাবিহিত দৈনিক মজুরি হচ্ছে যথাক্রমে ৬৯২, ৬২৯ এবং ৫৭১ টাকা।
আরও পড়ুন: করোনা আতঙ্কের জেরে ভারতের নানা জায়গায় আক্রান্ত স্বাস্থ্যকর্মীরা
ভারতের মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদনের (গ্রোস ডোমেস্টিক প্রোডাক্ট বা জিডিপি) প্রায় নয় শতাংশ আসে নির্মাণ ক্ষেত্র থেকে, এবং এই ক্ষেত্রেই নিযুক্ত হন সর্বাধিক পরিযায়ী দিনমজুর, প্রায় ৫.৫ কোটি। প্রতি বছর নির্মাণ স্থান এবং কারখানায় কাজ খুঁজতে গ্রামাঞ্চল থেকে শহরমুখী হন প্রায় ৯০ লক্ষ শ্রমিক।
২০১১ সালের জনগণনা অনুযায়ী, ভারতে এই ধরনের "অভ্যন্তরীণ অভিবাসীদের" সংখ্যা দেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় ৩৭ শতাংশ, অর্থাৎ প্রায় ৪৫ কোটি মানুষ। ২০০১ সালে এই সংখ্যা ছিল ৩০.৯ কোটি, অর্থাৎ এক দশকের ব্যবধানে বৃদ্ধির হার ৪৫ শতাংশ।
রাষ্ট্রসংঘের মানবাধিকার বিভাগের হাই কমিশনার মিশেল বাশেলে এক বিবৃতিতে বলেছেন যে তিনি অস্থায়ী পরিযায়ী শ্রমিকদের দুর্দশা দেখে ব্যথিত বোধ করছেন, কারণ এঁদের অনেকেই শহরে নিজেদের কর্মস্থল ছেড়ে মাত্র কয়েক ঘণ্টার নোটিশে বেরিয়ে যেতে বাধ্য হন, খাবারের অথবা বাড়িভাড়ার টাকা না দিতে পেরে। "ভারতে জারি হওয়া লকডাউন সে দেশের জনসংখ্যার এবং ঘনবসতির নিরিখে একটি বিপুল চ্যালেঞ্জ, এবং আমরা সকলেই আশা করব যে ভাইরাসের প্রসার আটকানো যাবে," বলেন বাশেলে। তিনি আরও বলেন যে COVID-19 এর মোকাবিলায় নেওয়া পদক্ষেপের যাতে "বৈষম্যমূলক প্রয়োগ না হয়, এবং বর্তমানের অসাম্য এবং দুর্বলতা যাতে আরও বেড়ে না যায়", তা নিশ্চিত করা জরুরি।
জন সাহস এই সমীক্ষা পরিচালনা করে ২৭ থেকে ২৯ মার্চ, ২০২০