/indian-express-bangla/media/post_attachments/wp-content/uploads/2019/01/FEAT34-1.jpg)
মেঘালয় সরকার "স্বেচ্ছায়" ও "সক্রিয়ভাবে কয়লা খনির মালিকদের" অবৈধভাবে কয়লা খাদান ও চালানে সাহায্য করেছে, "সুপ্রিম কোর্ট ও জাতীয় পরিবেশ আদালতের নির্দেশ খোলাখুলিভাবে উপেক্ষা করে"। এই মর্মে ২২ জন সমাজকর্মীর তৈরি একটি নাগরিক রিপোর্ট (সিটিজেনস রিপোর্ট) গত ৭ জানুয়ারি জমা পড়েছে দেশের শীর্ষ আদালতের কাছে।
'কীভাবে এবং কেন জাতীয় পরিবেশ আদালত এবং মহামান্য সুপ্রিম কোর্টের আদেশ সত্ত্বেও মেঘালয়ে চলছে অনিয়ন্ত্রিত ও অবৈধ কয়লা খাদান' শীর্ষক রিপোর্টের দ্বিতীয় কিস্তি এটি। উল্লেখ্য, গত ১৩ ডিসেম্বর থেকে অন্তত ১৫ জন খনি শ্রমিক পূর্ব জৈন্তিয়া পাহাড়ের একটি খনিতে আটকে আছেন, যে ঘটনার অব্যবহিত আগেই, ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে, সুপ্রিম কোর্টে জমা করা হয় এই রিপোর্টের প্রথম কিস্তি। শ্রমিকদের উদ্ধার করার কাজ এখনও চলছে, যদিও তাঁদের একজনেরও বেঁচে থাকার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে।
আরও পড়ুন: সময় ফুরিয়ে আসছে মেঘালয়ে আটকে পড়া খনি শ্রমিকদের
রিপোর্টের প্রথম কিস্তিতে অন্তত এক ডজন রাজনীতিকের নাম করে বলা হয়েছিল, যে হয় তাঁরা নিজেরাই অবৈধ কয়লা খনির মালিক, নাহয় তাঁদের পরিবার পরিজন অবৈধভাবে কয়লা খননের জন্য দায়ী।
মেঘালয়ের অধিকাংশ খনিতেই কুখ্যাত 'র্যাট হোল', অর্থাৎ 'ইঁদুরের গর্ত' প্রক্রিয়া অনুসরণে কয়লা খনন করা হয়, যে প্রক্রিয়া ২০১৪ সালে নিষিদ্ধ করে জাতীয় পরিবেশ আদালত। রিপোর্টের ৩৮০ পাতার দ্বিতীয় কিস্তিতে তুলে ধরা হয়েছে এই নিষেধাজ্ঞা অমান্য করার নানা প্রক্রিয়া। এই বক্তব্যের সমর্থনে তথ্যপ্রমাণ হিসেবে বিশ্লেষণ করা হয়েছে অসংখ্য প্রকাশিত নথির, যেগুলির মধ্যে রয়েছে ভারতের কম্পট্রোলার অ্যান্ড অডিটর জেনারেলের (সিএজি) রিপোর্ট, সুপ্রিম কোর্ট ও পরিবেশ আদালতের নির্দেশ, সরকারি নথি, এবং কয়লার পরিমাণের আনুমানিক হিসাব। এর দ্বারা প্রমাণ করার চেষ্টা হয়েছে রাষ্ট্রযন্ত্র ও কয়লা খনি গোষ্ঠীর মধ্যে গোপন আঁতাতের অস্তিত্ব।
মেঘালয়ের মুখ্য সচিব টি সেরিং ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসকে জানান, "মেঘালয় সরকার অত্যন্ত কঠোরভাবে অবৈধ কয়লা খননের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নিয়েছে। আমরা অবৈধ খনন এবং অবৈধ চালান, দুইয়ের বিরুদ্ধেই অসংখ্য মামলা দায়ের করেছি। বড়ো পরিমাণে যন্ত্রপাতি বাজেয়াপ্ত করেছি। সমস্যাটা হচ্ছে, রাজ্যের বিভিন্ন জেলায় প্রত্যন্ত অঞ্চলে বহু খনি রয়েছে, যেগুলি মাঝেমাঝে আমাদের পক্ষে খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। হয়ত সেসব জায়গায় কিছু ব্যক্তি খনির মালিকদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে অবৈধভাবে কয়লা খনন করছেন।"
নাগরিক রিপোর্টে প্রশ্ন তোলা হয়েছে, ৮ অক্টোবর, ২০১৪ থেকে ৫ ডিসেম্বর, ২০১৮-এর মধ্যে সরকারি হিসাব অনুযায়ী ২০১৪-র নিষেধাজ্ঞার পূর্ববর্তী সময় খনন করা কয়লার পরিমাণ সংশোধন করে বাড়িয়ে দেওয়া হয়। এই সংশোধিত পরিমাণ (যা নিষেধাজ্ঞা জারির আগেই খনন করা হয়েছিল কিন্তু চালান করা হয় নি বলে সরকারের দাবি) মাথায় রেখে পরিবেশ আদালত এবং সুপ্রিম কোর্ট ন'বার এই কয়লা বৈধভাবে চালান করার সময়সীমা বাড়িয়েছে। বর্তমান সময়সীমা হলো ৩১ জানুয়ারি।
রিপোর্টে বলা হয়েছে, "উপরোক্ত বিশ্লেষণের মাধ্যমে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে, মেঘালয় সরকার এই গোটা ঘটনায় নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করে নি। বরং সক্রিয়ভাবে খনির মালিকদের খনন করা কয়লার আনুমানিক পরিমাণ বাড়ানোর উপায় করে দিয়েছে, যাতে নতুন করে কয়লা খনন করে তা থেকে লাভ করা যায়। সরকারের উচিত ছিল তার নিজেরই কমিটি দ্বারা জারি করা গাইডলাইন কঠোরভাবে লাগু করে কয়লা চালানের সময়সীমা বাড়ানোর বিরোধিতা করা। এবং এটা নিশ্চিত করা, যে আগেই খনন করা কয়লার পরিমাণ (যা পরিবেশ আদালতের এক কমিটির যাচাই করা হিসাব অনুযায়ী ৭৭,০৪,৭৯১.৭৩ মেট্রিক টন) কোনোভাবেই বাড়ানো না হয়।"
আরও পড়ুন: মেঘালয়ের খনি শ্রমিক উদ্ধারে দ্রুত পদক্ষেপ: জনস্বার্থ মামলা গৃহীত সুপ্রিম কোর্টে
রিপোর্টে আরও উল্লেখ করা হয়েছে, "সুপ্রিম কোর্ট ও পরিবেশ আদালতের আদেশের এই প্রকাশ্য অবমাননা মেঘালয় সরকারের খোলাখুলি যোগসাজশের প্রেক্ষিতে আরও ভয়ানক আকার ধারণ করে। পরিবেশ আদালতের নির্দেশ কার্যকরী করা দূরের কথা, সরকার নিজেদের সাধ্যের বাইরে গিয়ে মুষ্টিমেয় কিছু কয়লা খনির মালিকদের সুবিধা করে দিয়েছে।"
উপর্যুপরি চালানের সময়সীমা বাড়ানোর ক্ষেত্রে রিপোর্টের বক্তব্য, "সরকারের সক্রিয় সাহায্যে ও পরিবেশ আদালতের কাছে ইচ্ছাকৃত ভুল তথ্য পেশ করার ফলে কয়লা খনির মালিক ও কয়লা চালানকারীরা বারবার কয়লা চালানের সময়সীমা বাড়াতে পেরেছে। নিষেধাজ্ঞার পর অতিবাহিত ৫৭ মাস ১৫ দিনের মধ্যে কয়লা চালানের জন্য সময় পাওয়া গেছে ৩২ মাস, এক সপ্তাহ, পাঁচ দিন।"
২০১৩ ও ২০১৪ সালের সিএজি রিপোর্ট উদ্ধৃত করে নাগরিক রিপোর্টে বলা হয়েছে, সিএজি রিপোর্টগুলি থেকেই বোঝা যায় "মেঘালয়ে বেআইনি এবং অপরাধমূলক কয়লা খননে সক্রিয় সরকারি সাহায্যের ফলে কতটা ক্ষতি হয়েছে, যার ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সরকারি খাজনা।"
২০১৪ সালের সিএজি রিপোর্ট উদ্ধৃত করে নাগরিক রিপোর্ট বলছে, "গত পাঁচ বছরে (চলতি বছরের রিপোর্ট সহ) আমরা ২৮ টি অনুচ্ছেদে উল্লেখ করেছি যে কর অনাদায়, ত্রুটিপূর্ণ ছাড়, আয়ের পরিমাণ গোপন করা, করের হারের ভুল প্রয়োগ, হিসেবে ভুল ইত্যাদির কারণে আনুমানিক ক্ষতির পরিমাণ ৯৫৯.২৬ কোটি টাকা।"
নাগরিক রিপোর্টে স্বাক্ষর করা ২২ জনের একজন হলেন অ্যাঞ্জেলা রাঙ্গাড, যাঁর বক্তব্য, "রিপোর্টের দ্বিতীয় কিস্তিতে আমাদের নজর ছিল রাজ্যের খনি মালিক গোষ্ঠী কীভাবে পরিবেশ ও অন্যান্য আদালতকে বিভ্রান্ত করছে, তার ওপর। চালান করার সময়সীমা বাড়ানোর সুযোগ নিয়ে অবৈধভাবে খনন চালিয়ে যাওয়া হয়েছে। অন্যদিকে, যতই ওরা রাজ্য সরকারের আয় বা মানুষের জীবিকার কথা বলুক, বিপুল হারে চুরি হয়েছে, কারণ খননের ওপর তো নিয়ম মেনে করই বসানো হয় নি। সরাসরি লুট চলেছে।"
সুপ্রিম কোর্টে মামলার আগামী শুনানির তারিখ ১৫ জানুয়ারি।