প্রথায় আছে মা-দুর্গার মূর্তি গড়তে পতিতালয়ের মাটি আনতে হয়, তবে পতিতাবৃত্তিতে জড়িয়ে পড়া মহিলারা কখনই সমাজের মূল স্রোতে ফিরে যাওয়ার সুযোগ পান না। শিলচর শহরের নাগাপট্টি সংলগ্ন পতিতালয়ে প্রায় ২০০ যৌনকর্মী এনআরসি থেকে বঞ্চিত হলেন, কারণ তারা পরিবারের লিগ্যাসির অংশ নন। যৌনকর্মীদের সঙ্গে পরিবার কোনও নথি বা লিগেসি ভাগ করবে না, তাই তাঁরা এনআরসিছুট। হয়তো আগামীতে ফরেনার্স ট্রাইব্যুনালে যাওয়ার মতোও পর্যাপ্ত নথি তারা দেখাতে পারবেন না, ফলে শেষমেশ ঠাঁই হতে পারে গোয়ালপাড়ার বিদেশি আটক শিবিরে।
৩১ অগাস্ট এনআরসির চূড়ান্ত তালিকা প্রকাশের প্রক্রিয়াটি শুরু হয়। গতবছর চূড়ান্ত খসড়া থেকে বাদ যাওয়া ৪০ লক্ষ নামের থেকে প্রায় ২১ লক্ষ নাম মূল তালিকায় স্থান পায় সেদিন। ১৪ সেপ্টেম্বর অনলাইনে এনআরসির সম্পূর্ণ তালিকাটি প্রকাশ করা হয় এবং সারা রাজ্যের প্রত্যেক ব্যক্তি যাদের নাম তালিকাভুক্ত হয়েছে তারা এগুলো দেখতে পারেন। তবে এই তালিকায় নিজেদের নাম খুঁজে পাওয়ার কোনো রাস্তা ছিল না শিলচর শহরের পতিতালয়ে বাস করা মহিলাদের। এটি উত্তর পূর্ব ভারতের অন্যতম বড় পতিতালয়। এখান থেকে প্রায় প্রত্যেক বছর দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের পুলিশ হারিয়ে যাওয়া মহিলাদের খুঁজে পায় এবং তাঁদের উদ্ধার করে। এবছর জুলাই মাসে দিল্লির দুই বার-ডান্সারকে এখান থেকে উদ্ধার করা হয়েছিল। দিল্লির একটি সামাজিক সংস্থার অভিযোগের উপর ভিত্তি করে পুলিশ খোঁজ চালায় এবং তাঁদের উদ্ধার করে নিয়ে যায়।
আরও পড়ুন: ‘আদালতেই প্রমাণ দিতে হলে এত খরচ করে এনআরসির কী প্রয়োজন?’, প্রশ্ন বিজেপি সাংসদের
তবে এখানে অনেকেই আছেন যাদের খোঁজ করতে কেউ আসে না। এখানে মহিলারা একটি ছোট্ট কামড়ায় পতিতাবৃত্তি করে কাটিয়ে দেন সারা জীবন। পরিবার বা সমাজ তাদের আর গ্রহণ করবে না, এমনকি পতিতাবৃত্তি ছাড়া তাঁদের আর কোন রোজগারেরও সম্ভাবনা নেই। তাদের সামাজিক স্বীকৃতি বা মানুষ হিসাবে সাধারণ অধিকার কোনটাই নেই। কিছু কিছু সামাজিক সংগঠন যারা মহিলাদের সুরক্ষার উপর জোর দেয়, তারা পতিতালয়ে মহিলাদের জন্য স্বাস্থ্য পরীক্ষা শিবির আয়োজন করে। পাশাপাশি ডিস্ট্রিক্ট লিগ্যাল সার্ভিস অথরিটি (ডিএলএসএ), কাছাড় জেলা শাখার তরফেও তাদের সাহায্যের জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়া হয়। ডিএলএসএ-এর সদস্য তথা সমাজসেবী তুহিনা শর্মা ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলার প্রতিনিধিকে জানান, এখানে যারা আসেন তাদের বেশির ভাগই মানব পাচারের শিকার। ভারতবর্ষে বিভিন্ন এলাকা থেকে পাচার হয়ে এখানে এসে আটকা পড়েছেন।
কেউ কেউ আবার নেপাল, ভুটান বা বাংলাদেশ ইত্যাদি এলাকা থেকে পাচার হয়ে এখানে এসেছে। স্বভাবতই তাদের সঙ্গে কোন নিজস্ব নথিপত্র থাকবে এটা ভাবা যায় না। ডিএলএসএ-এর পক্ষ থেকে তাদের নাম ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করানোর জন্য একটি প্রচেষ্টা ২০১৭ সালে নেওয়া হয়েছিল। ডিএলএসএ-এর তৎকালীন সম্পাদিকা সুজাতা দত্তের এব্যাপারে একটি বড়সড় পদক্ষেপ নেওয় হয়েছিলে। তবে প্রক্রিয়াটি এখনও সম্পন্ন হয়নি এবং এরই মধ্যে চলে এসেছে এনআরসি। এনআরসি তে তাদের নাম থাকবে না এটা আগে থেকেই ধারণা করা হয়েছিল, কারণ তাদের কাছে পর্যাপ্ত নথি নেই। দেশের অন্যান্য এলাকায় যৌনকর্মীদের বিশেষ পরিচয় পত্র দেওয়ার পাশাপাশি ভোটার তালিকায় তাদের নাম ওঠানো ব্যবস্থা রয়েছে।
আরও পড়ুন: রাজীব কুমারের খোঁজে নবান্নে সিবিআই, অবস্থান জানতে চেয়ে চিঠি
কলকাতার সোনাগাছি এলাকায় যারা কাজ করেন তাদের ভোটার আইডি কার্ড আধার কার্ড ইত্যাদি তো রয়েছেই পাশাপাশি নিজেদের ইউনিয়ন রয়েছে। নিজেদের কথাগুলো সরকারের কাছে তুলে ধরার মতো একটি মাধ্যম অবশ্যই প্রত্যেক ব্যক্তির থাকা উচিত। যারা এনআরসিছুট, তাদের সঙ্গে কি ব্যবহার করা হবে এটা আমরা জানি না। সাধারণ মানুষ, যাদের নাম চূড়ান্ত তালিকায় নেই, তারা ফরেনার্স ট্রাইব্যুনালে গিয়ে মামলা করে নিজেদের নাম অন্তর্ভুক্ত করানো কথাই ভাবছেন। তবে এই পতিতালয়ে বাস করা মহিলারা এই কাজটিও হয়তো করতে পারবেন না, কারণ তাদের বেশিরভাগের কাছেই পর্যাপ্ত নথি নেই। তবে কি শেষমেষ তাদের ঠাঁই হবে কোনও ডিটেনশন ক্যাম্পে বা সরকারি কারাগারে? এটা ভবিষ্যতই বলে দিতে পারে।
পতিতালয় যেমন একদিকে মানবপাচারের অপরাধীদের জন্য সুযোগ করে দেয়, তেমনি এইচআইভির মতো মারণ রোগের সংক্রমণও এসব এলাকা থেকে ঘটে। শহরের বিভিন্ন সামাজিক সংস্থা এবং জেলা প্রশাসন এই মহিলাদের স্বাস্থ্য পরীক্ষার জন্য বিভিন্ন কাজ করে। সামাজিক সংস্থাগুলোর উদ্যোগে এইচআইভি টেস্ট সহ বিভিন্ন পরীক্ষা বিনামূল্যে করানোর ব্যবস্থা করা হয়। শিলচর শহরের সামাজিক সংস্থা আশ্বাস এই এলাকায় একটি স্বাস্থ্য শিবির করিয়েছে। সংস্থার সদস্যরা জানান, মহিলারা প্রায়ই অসুরক্ষিত যৌন সংসর্গে আসেন এবং তাদের মধ্যে মারণ রোগ ছড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা অনেক বেশি। তারা সংক্রমিত হলে তাদের থেকে সমাজের আরও বিভিন্ন ব্যক্তির মধ্যে এটি ছড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনাও রয়েছে। পাশাপাশি রয়েছে এই মহিলাদের গর্ভবতী হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা। আমরা গত বছর একটি আটমাসের শিশুকে এখানে দেখেছি। শিশুটির এখানে জন্ম হয়েছে এবং বলাই বাহুল্য এটি অসুরক্ষিত যৌন সম্পর্কের ফলে হয়েছে। আমরা মহিলাদের কনডোম ব্যবহার সহ গর্ভনিরোধক পদ্ধতিগুলোর ব্যাপারে প্রশিক্ষণ দিয়েছি। এই সবগুলো কাজ হচ্ছে আমরা তাদের কাছাকাছি পৌঁছতে পারছি বলেই। এবার যখন তারা এনআরসি থেকে বাদ পড়বেন তাদের সঙ্গে সরকার কি করবে এটা আমরা জানিনা। তবে তারা যদি শেষ পর্যন্ত ডিটেনশন ক্যাম্পেই ঠাঁই পান তবে পরিস্থিতি পুরোটাই বদলে যাবে।
আরও পড়ুন: এখনও ‘চূড়ান্ত’ নয় নাগরিকপঞ্জীর তালিকা, থাকছে নাম বাদ যাওয়ার আশঙ্কা
একবার যারা পতিতাবৃত্তিতে জড়িয়ে পড়েন তাদের সমাজ আর গ্রহণ করেনা। শিলচর পতিতালয়ে কাজ করা মহিলারা নিজের নাম লুকিয়ে, মুখ ঢেকে সাংবাদিকদের সঙ্গে নিজেদের অনুভূতির কথা তুলে ধরেন। তারা বলেন, আমরা প্রায় সবাই অনিচ্ছাকৃতভাবে এই এলাকার বাসিন্দা হয়েছি। জীবনে অনেক কিছু দেখতে হয়েছে তারপরও নিজের শরীর বেঁচে পেট চালাচ্ছি। আমাদের সুরক্ষা নিয়ে কেউ ভাববেনা এটা আমরা জানি অতীতে অনেকবার এখানে অপহৃত মেয়েদের খোঁজার নামে আমাদের মারধর করা হয়েছে। এগুলো সহ্য করা ছাড়া কোন উপায় সাধারণত আমাদের থাকেনা। আমাদের মধ্যে কেউ কেউ চায় এই কাজটি ছেড়ে বাইরে বেরিয়ে যেতে, কিন্তু সমাজ আমাদের গ্রহণ করেনা। এমনকি ঘরে বাসন মাজা বা কাপড় ধোয়ার জন্যও আমাদের কেউ ডাকে না, কারণ আমরা অস্পৃশ্য। পতিতালয়টি যেখানে রয়েছে এটি সরকারি জমি হলেও এর কোন সঠিক মালিকানা নেই। কে এগুলো চালায় এবং কারা পাচার হওয়া মহিলাদের এনে এখানে ছেড়ে দেয়? এগুলো উত্তর পুলিশের কাছেও নেই। অতীতে বেশ কয়েকবার পতিতালয়টি এখান থেকে উঠিয়ে দেওয়ার জন্য উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। জেলা প্রশাসন সহ বিভিন্ন সামাজিক সংস্থা চেষ্টা করেও এগুলো বন্ধ করে দিতে পারেনি। কাছাড়ের প্রাক্তন জেলাশাসক এস লক্ষণন পতিতালয়টিকে শিলচরের কলঙ্ক বলেও আখ্যা দিয়েছিলেন। কিন্তু কোন ভাবেই এটি বন্ধ করে দেওয়া সম্ভব হয়নি। যখন আসামে এনআরসির প্রক্রিয়াটি শুরু হয়, এখানে দীর্ঘদিন ধরে থাকা যৌনকর্মীরা এতে নাম উঠানোর জন্য চেষ্টা করেছিলেন, তবে নথির অভাবে সেটা হয়নি। এনআরসি সম্পন্ন হওয়ার পর সরকার এই মহিলাদের জন্য কি আদেশ ধার্য করে এটা ভবিষ্যতে বলে দিতে পারে।
আগামী মাসে দুর্গাপূজা মেতে উঠবে সারা উপত্যকা। পতিতালয়ের মাটি দিয়ে মায়ের মূর্তি গড়লেও কোনও সাধারন প্যান্ডেলে পতিতাদের ঢোকার অনুমতি নেই। পূজার তিনদিন তারা প্রসাদ পাবেন না, মায়ের আসার আনন্দটাও কারো সঙ্গে ভাগ করে নিতে পারবেননা। শিলচর শহরের প্রেমতলা সংলগ্ন নাগাপট্টির এই পতিতালয়ে মহিলারা নিজেরাই একটি ছোট্ট মন্দির বানিয়েছে। তারা এই মন্দিরে নিজের মত করে মায়ের পুজো করবেন এবং নিজেদের সামলে নেবেন। মন্দিরটির মাধ্যমে এলাকার যৌনকর্মীরা নিজেদের ধর্মীয় আস্থা বজায় রেখে চলেছেন।