মহারাষ্ট্রের পুণেতে অবস্থিত ন্যাশনাল ইন্সটিটিউট অফ ভাইরোলজি (NIV) দেশের দুটি বেসরকারি সংস্থাকে করোনাভাইরাস 'টেস্টিং কিট' তৈরি করার অনুমোদন দিয়েছে। সংস্থা দুটি হলো জার্মানির অ্যালটোনা ডায়াগনস্টিকস (Altona Diagnostics) এবং পুণের সংস্থা মাইল্যাব ডিসকভারি সল্যুশনস (Mylab Discovery Solutions)।
আজ থেকে দুদিন আগে বেসরকারি ভাবে COVID-19 পরীক্ষার ক্ষেত্রে কিছু নতুন নির্দেশিকা জারি করে ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অফ মেডিক্যাল রিসার্চ (ICMR), যার ফলে বেসরকারি ল্যাবে শুধুমাত্র ইউএস ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (USFDA) অথবা ইউরোপীয় সিই (European CE) অনুমোদিত 'টেস্টিং কিট'ই ব্যবহার করা যাবে। এছাড়াও নির্দেশিকার আওতা কিছুটা প্রসারিত করে NIV-র অনুমতি সাপেক্ষে ভারত বা ভারতের বাইরে তৈরি কিট ব্যবহার করারও অনুমতি দেওয়া হয়।
তবে সোমবার ICMR এও জানায় যে কোনও টেস্টিং কিট যদি USFDA অথবা European CE অনুমোদিত নাও হয়, তবু সেগুলি ব্যবহারের ক্ষেত্রে ন্যাশনাল ইন্সটিটিউট অফ ভাইরোলজির অনুমতি যাতে দ্রুত পাওয়া যায়, সেই ব্যবস্থা করছে তারা। এর আগে শুধুমাত্র USFDA অথবা European CE-র অনুমোদনপ্রাপ্ত কিট ব্যবহার করার বাধ্যবাধকতা নিয়ে সমালোচনা আসে একাধিক মহল থেকে।
আরও পড়ুন: দোহাই, যে ভুল ইটালি-ফ্রান্স-জার্মানি করেছে তা যেন ভারত না করে: অনাবাসীদের আর্তি
ICMR-এর ডিরেক্টর জেনারেল ডাঃ বলরাম ভার্গব সোমবার বলেন, "আমরা প্রাইভেট ল্যাবের ক্ষেত্রে নির্দেশিকা জারি করেছি; নথিভুক্ত হয়েছে ১২টি ল্যাবরেটরি চেইন, যাদের মোট নমুনা সংগ্রহ কেন্দ্রের সংখ্যা প্রায় ১৫ হাজার। NIV পুণের অনুমতি পাওয়ার পর দুটি টেস্টিং কিট ব্যবহারের অনুমতি দেওয়া হয়েছে। FDA-র অনুমোদন বাধ্যতামূলক নয়। ICMR-এর অনুমোদনই যথেষ্ট।"
ভারতে বর্তমানে ১০ লক্ষ মানুষ পিছু স্রেফ ৬.৮ জনের করোনা পরীক্ষা হচ্ছে। দেশে COVID-19 পরীক্ষার হার পৃথিবীতে সর্বনিম্নের তালিকায় পড়ে। স্বাস্থ্য আধিকারিকদের মাথাব্যথার সবচেয়ে বড় কারণ হলো সীমিত সংখ্যক পরীক্ষা কেন্দ্র এবং ব্যয়বহুল টেস্টিং কিট। ভারতে তৈরি টেস্টিং কিট-এর পাল্লা ভারী হলো পুণের সংস্থাটির কিট কর্তৃপক্ষের অনুমোদন পাওয়ায়। অনুমোদনের জন্য জমা পড়েছিল মোট ন'টি কিট।
আরও পড়ুন: হাইড্রক্সিক্লোরোকুইন খেলে কোভিড ১৯ সারবে, কে বলল?
মাইল্যাব ডিসকভারি সল্যুশনসের তৈরি কিট অনুমোদন পাওয়ায় আনন্দ জ্ঞাপন করেছেন বায়টেকনলজির কেন্দ্রীয় সচিব ডাঃ রেণু স্বরূপ। ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসকে তিনি জানান, "এটি আমাদের কাছে অত্যন্ত খুশির খবর। সংস্থার এমডি জানিয়েছেন, তাঁরা সপ্তাহে এক লক্ষ কিট উৎপাদন করতে সক্ষম, যা খুবই ভালো খবর।"
ICMR-এর পদক্ষেপের ফলে ভারতে তৈরি কিট-এর উৎপাদন বাড়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এছাড়াও উপকৃত হবে সেইসব সংস্থা, যারা চিনে তৈরি কিট আমদানি করার প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। এক সূত্রের কথায়, গত সপ্তাহে বেসরকারি সংস্থা দ্বারা করোনা পরীক্ষা অনুমোদিত হওয়ার পর বিমান চলাচলে নিষেধাজ্ঞার কারণে বেসরকারি ল্যাবগুলির পক্ষে USFDA-অনুমোদিত কিট যোগাড় করা একরকম অসম্ভব হয়ে পড়ে।
ওই সূত্র জানিয়েছে, "একাধিক সংস্থা সরকারকে এই অসুবিধের কথা জানায়। কিছুদিন টালবাহানার পর নিয়ম শিথিল করার পক্ষে রায় দেয় সরকার, এবং আন্তর্জাতিক মানের ভারতীয় কিট-এর ব্যবহার অনুমোদিত হয়।" আরেক সূত্রের দাবি, সরকারকে একথাও জানানো হয় যে পুণের NIV ইতিমধ্যেই COVID-19 পরীক্ষায় ব্যবহার করেছে 'রিসার্চ ইউজ ওনলি' কিট, যা USFDA অনুমোদিত নয়।
করোনা পরীক্ষাকে পরিভাষায় বলা হয় 'RT PCR test'। এক্ষেত্রে সন্দেহভাজন রোগীর বিবর্ধিত (amplified) ডিএনএ একটি পজিটিভ কন্ট্রোল এবং একটি নেগেটিভ কন্ট্রোলের তুলনায় বিচার করা হয়। নেগেটিভ কন্ট্রোল অর্থে সেইসব নমুনা, যেগুলিতে করোনাভাইরাসের চিহ্ন মেলে নি। সোমবার জারি করা নতুন নির্দেশিকা অনুযায়ী, ICMR জানিয়েছে যে ভারতে বাণিজ্যিক ব্যবহারের জন্য শুধুমাত্র সেইসব কিট অনুমোদন পাবে, যেগুলি 'ট্রু পজিটিভ' এবং 'ট্রু নেগেটিভ' নমুনার মধ্যে ১০০ শতাংশ সামঞ্জস্য দেখাতে পারছে। অর্থাৎ SARS-CoV-2 বংশাণুসমগ্র বা genome, যা COVID-19 ভাইরাসের সৃষ্টি করে, তার সঙ্গে ১০০ শতাংশ সাদৃশ্য থাকতে হবে সংশ্লিষ্ট নমুনার। এই সাদৃশ্য শুধুমাত্র অভিন্ন নমুনাতেই পাওয়া সম্ভব।
আরও পড়ুন: করোনাভাইরাস বাতাসেও ছড়াতে পারে, বলছে গবেষণা
USFDA অথবা European CE-র অনুমাদন পায় নি যে ন'টি কিট, সেগুলির পরীক্ষা হওয়ার পর 'ট্রু পজিটিভ' এবং 'ট্রু নেগেটিভ' নমুনার মধ্যে ১০০ শতাংশ সামঞ্জস্য দেখাতে পারে শুধুমাত্র অ্যালটোনা ডায়াগনস্টিকস-এর RealStar SARS-CoV-2 RT-PCR কিট এবং মাইল্যাবস-এর Patho Detect কিট, ফলে সেগুলি এবার বাণিজ্যিকভাবে ব্যবহৃত হতে পারে। যেসব কিট অনুমোদন পায় নি, তাদের মধ্যে রয়েছে আইআইটি দিল্লির QRT-PCR, যা 'ট্রু পজিটিভ' নমুনার ক্ষেত্রে ৯৮ শতাংশ সামঞ্জস্য দেখালেও 'ট্রু নেগেটিভ' নমুনায় দেখাতে পেরেছে মাত্র ১০ শতাংশ।
অ্যালটোনা ডায়াগনস্টিকস-এর দক্ষিণ এশিয়ার জেনারেল ম্যানেজার তরুণ জৈন ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসকে জানান, "আমরাই প্রথম সংস্থা যারা ২০০২ সালে SARS কিট তৈরি করি। আমরা H1N1, ইবোলা (Ebola), এবং জিকা (Zika) ভাইরাসেরও কিট বানাই। প্রথমে আমরা NIV পুণেকে শুধুমাত্র 'রিসার্চ ওনলি' কিট সরবরাহ করি। ভারতে আমাদের করোনাভাইরাস কিট স্বীকৃতি পাওয়ার আগেই তা নিয়ে জার্মানি এবং ব্রিটেনের দুটি পত্রিকায় প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়।"
তাঁর সংস্থার তৈরি 'রিসার্চ ওনলি' কিট NIV সরকারি ল্যাবে ব্যবহার করেছে কিনা জানতে চাইলে জৈন বলেন, "হ্যাঁ এবং না। আমরা ICMR-এর সঙ্গে আলোচনা করছি। তারা আমাদের কাছ থেকে আরও বেশি পরিমাণে কিট আমদানি করবে। কিন্তু পরিস্থিতির বিচারে আমাদের ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং জার্মানির প্রতিও কিছু দায়বদ্ধতা রয়েছে। আমরা সবরকম ভাবে চেষ্টা করছি উৎপাদন ক্ষমতা বাড়ানোর।"
আরও পড়ুন: করোনা সংক্রমণ ঠেকাতে কীভাবে কতবার ঘর সাফ করবেন?
এখনও কোনও বেসরকারি ল্যাব থেকে কোনোরকম অগ্রিম অর্ডার নেওয়া শুরু করেনি এই জার্মান সংস্থা। জৈন বলেন, "আমরা এখনও প্রাইভেট অর্ডার নিচ্ছি না, যেহেতু এখনও আমদানি লাইসেন্স পাই নি। আমাদের হিসেব অনুযায়ী, প্রতিদিন দুই থেকে আট হাজার পরীক্ষা করতে পারবে বেসরকারি ল্যাবগুলি। এই সংখ্যা বাড়তে পারে এক্সপোনেনশিয়াল (গুণোত্তর) হারে। এখনও সবরকম সম্ভাবনা খতিয়ে দেখছি আমরা। এই মুহূর্তে বলতে পারছি না ঠিক কত সংখ্যক কিট আমরা আমদানি করতে পারব।"
এতদিন পর্যন্ত করোনাভাইরাস রোগী নিশ্চিত করতে জার্মানি থেকে আমদানি করা কিট-এর ওপরেই ভরসা করছিল ভারত সরকার, কিন্তু বিমান চলাচলের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি হওয়ার ফলে আর তা করা যাচ্ছে না।
মাইল্যাব-এর তৈরি টেস্টিং কিট-এর দাম বর্তমান দামের এক-চতুর্থাংশ হবে বলে জানানো হয়েছে। সংস্থার এক সূত্র জানিয়েছে, মাইল্যাব-এর কিট আড়াই ঘণ্টার মধ্যে সংক্রমণ ধরতে পারে, যেখানে বর্তমানে সময় লাগছে সাত ঘণ্টা। অর্থাৎ একই সময়ের মধ্যে একটি মেশিনে দ্বিগুণ পরীক্ষা করা যাবে।