ভিএইচপির অভিযোগে বরখাস্ত প্রধানশিক্ষক, প্রতিবাদে 'ক্লাস বয়কট' খুদে পড়ুয়াদের

ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসকে রাজ্যের বুনিয়াদি শিক্ষা মন্ত্রী সতীশচন্দ্র দ্বিবেদী জানিয়েছেন যে তিনি এডুকেশন ডিরেক্টরেটের কাছ থেকে রিপোর্ট তলব করেছেন, এবং আলির বরখাস্তের নির্দেশ শীঘ্রই প্রত্যাহার করা হবে।

ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসকে রাজ্যের বুনিয়াদি শিক্ষা মন্ত্রী সতীশচন্দ্র দ্বিবেদী জানিয়েছেন যে তিনি এডুকেশন ডিরেক্টরেটের কাছ থেকে রিপোর্ট তলব করেছেন, এবং আলির বরখাস্তের নির্দেশ শীঘ্রই প্রত্যাহার করা হবে।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
headmaster furqan ali vhp

বহিষ্কৃত প্রধান শিক্ষক ফরকান আলি।

শুক্রবার, সকাল ৯.১০, উত্তরপ্রদেশের পিলিভিট জেলার ঘিয়াসপুর অঞ্চলে সরকারি প্রথমিক বিদ্যালয়ে আঁকাবাঁকা লাইন করে দাঁড়িয়ে স্লোগান দিচ্ছে আন্দাজ ৩০ জন খুদে পড়ুয়া। "দেশ কি রকশা কৌন করেগা? হাম করেঙ্গে (দেশকে কে রক্ষা করবে? আমরা করব)", বা "ক্যায়সে করেঙ্গে? তন সে করেঙ্গে, মন সে করেঙ্গে, ধন সে করেঙ্গে" (কীভাবে করব? শরীর দিয়ে, মন দিয়ে, ধন দিয়ে)," বলছে তারা।

Advertisment

মিনিট দশেক চলে স্লোগান দেওয়া, যার পর বিসালপুর ব্লকের ওই স্কুল চত্বর থেকে গটগট করে হেঁটে বেরিয়ে যায় প্রত্যেকটি পড়ুয়া। তাদের কারোর পরনেই নেই ইউনিফর্ম। কোথায় যাচ্ছে জানতে চাইলে পঞ্চম শ্রেণীর এক পড়ুয়া বলে, "যেদিন আমাদের হেডমাস্টারকে ফেরত আনা হবে, সেদিনই ফেরত আসব আমরাও। কোনও টিচার ওঁর বিকল্প হতে পারেন না, ওঁর সঙ্গে যা ঘটেছে তা ভুল এবং অন্যায়।"

গত ১৪ অক্টোবর পিলিভিট জেলা প্রশাসনের হাতে বরখাস্ত হন স্কুলের প্রধান শিক্ষক ফরকান আলি (৪৫)। ঘটনার মূলে ছিল স্থানীয় বিশ্ব হিন্দু পরিষদ (ভিএইচপি) সদস্যদের অভিযোগ, যে তিনি সকালের অ্যাসেম্বলিতে বাচ্চাদের দিয়ে এমন এক ধর্মীয় প্রার্থনা করাচ্ছেন, যা সচরাচর মাদ্রাসায় শোনা যায়।

আরও পড়ুন: প্রার্থনায় ইকবালের কবিতায় আপত্তি, ভিএইচপির অভিযোগে বহিষ্কৃত প্রধান শিক্ষক

Advertisment

কিন্তু সপ্তাহের গোড়ার দিকেই বিসালপুরের ব্লক এডুকেশন অফিসার (বিইও) উপেন্দ্র কুমার তদন্ত করে জেনেছেন যে ছাত্ররা যে কবিতাটি বলছিল, তা হলো 'সারে জাহাঁ সে আচ্ছা'র রচয়িতা কবি মহম্মদ ইকবালের ১৯০২ সালে লেখা কবিতা, 'লব পে আতি হ্যায় দুয়া'।

ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসকে রাজ্যের বুনিয়াদি শিক্ষা মন্ত্রী সতীশচন্দ্র দ্বিবেদী জানিয়েছেন যে তিনি এডুকেশন ডিরেক্টরেটের কাছ থেকে রিপোর্ট তলব করেছেন, এবং আলির বরখাস্তের নির্দেশ শীঘ্রই প্রত্যাহার করা হবে। তাঁর কথায়, "প্রথমে শোনা গেছিল যে তিনি অন্য একটি প্রার্থনা করাচ্ছেন, কিন্তু পরে জানা যায়, তিনি ইকবালের একটি দেশভক্তি বিষয়ক কবিতা আবৃত্তি করাচ্ছেন। জেলা প্রশাসন তড়িঘড়ি পদক্ষেপ নিয়েছে। সব তথ্য যাচাই না করে বরখাস্ত করা উচিত হয় নি।" দ্বিবেদী আরও বলেন, "আমরা সমস্ত স্কুলকে বিজ্ঞপ্তি দিয়ে জানিয়ে দেব যেন শিক্ষাদপ্তরের সুপারিশ করা প্রার্থনাই সকালের অ্যাসেম্বলিতে বলানো হয়।"

বুনিয়াদি শিক্ষা দপ্তরের উপ-সচিব অশোক কুমার বলেছেন যে ঘটনাটির তদন্ত করা হচ্ছে। "জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছিল। এখন আমরা ব্যাপারটা খতিয়ে দেখছি, শিগগিরি রিপোর্ট পেশ করব। জেলা ভিএইচপি নেতা অম্বরীশ মিশ্র কোনোরকম প্রতিক্রিয়া দিতে রাজি হন নি।

আরও পড়ুন: ‘মমতা হেরে যাবেন বলে ভয় পেয়েছেন’, কটাক্ষ মুকুলের

এদিকে স্কুলের প্রতিবাদী পড়ুয়াদের নেতৃত্ব দিচ্ছে পঞ্চম শ্রেণীর এক খুদে। তার বক্তব্য, "আমাদের উর্দু বইতে এই কবিতাটা পড়ে আমাদের ভালো লাগে, এবং হেড স্যারের কাছে এটা আবৃত্তি করার অনুমতি চাই। হিন্দু, মুসলিম, সবাই ওঁর কাছে অনুমতি চাই। আমাদের উনি কখনও না করেন না। তো এই কবিতাটা আমরা প্রতি দ্বিতীয় দিন বলি।" দলের আরেক সদস্য তথা চতুর্থ শ্রেণীর এক পড়ুয়া বলে, "আমরা 'লব পে আতি হ্যায় দুয়া' বলি, আর 'ওহ শক্তি হামে দো দয়ানিধি' বলি। স্যারকে যদি আমাদের কবিতাটা বলার অনুমতি দেওয়ার জন্য সরিয়ে দেওয়া হয়, তাহলে সেটা আমাদের সিলেবাসে রাখার জন্য তো সরকারকে দোষ দেওয়া উচিত। তার মানে কি সরকারকেও সরিয়ে দেওয়া উচিত?"

তার কথার মাঝখানেই ফের বলে ওঠে পঞ্চম শ্রেণীর ছাত্রটি, "মোদীজি তো নিজেই বলেছেন যে হিন্দু-মুসলমান এক। আমরা যদি 'ওহ শক্তি হামে দো দয়ানিধি' বলতে পারি, তাহলে 'লব পে আতি হ্যায় দুয়া' কেন নয়? আদৌ তারা ইকবালের কবিতাটির অর্থ জানে কিনা, জিজ্ঞেস করায় ওই ছাত্র বলে, "একতা নিয়ে কবিতা।" বাকিরা সম্মতিসূচক ঘাড় নাড়ে।

ফারকান আলির পরিবর্তে যিনি নিযুক্ত হয়েছে, সেই রেহান হুসেন চিশতী বলছেন, "বরখাস্তের ব্যাপারটা নিয়ে খুশি নয় ছাত্ররা। স্কুলে উপস্থিতির হারও কমে গেছে। বৃহস্পতিবার মাত্র পাঁচজন ছাত্র স্কুলে এসেছিল। আলি থাকাকালীন প্রতিদিন অন্তত ১৫০ জন আসত।" উপেন্দ্র কুমার সেকথা স্বীকার করে নিয়ে বলেছেন, আলির প্রতি আনুগত্যই স্কুলে পড়ুয়াদের কমতে থাকা উপস্থিতির কারণ। "আগামী কিছুদিনের মধ্যে এই হার বাড়বে বলে আশা করছি," বলেন তিনি।

কৃষ্ণা দেবী (৪৫) স্কুলের চতুর্থ শ্রেণীতে পাঠরত তাঁর ১৩ বছরের পুত্র সম্পর্কে জানাচ্ছেন, "উনি কেন বরখাস্ত হলেন, তা বাচ্চাদের জানানো হয় নি। আমার ছেলে হেডমাস্টার মশাইকে খুব ভালবাসে। উনি চলে যাওয়ার পর থেকে তো প্রায় খাওয়াদাওয়া বন্ধ করে বসে আছে।"

আরও পড়ুন: ‘নাগরিকত্ব পাওয়ার অধিকার নেই বহিরাগতদের’, এনআরসি বিতর্কে ঘি ঢাললেন সুরেশ যোশী

কাঠমিস্ত্রি রাজেশ কুমার (৩৮) তাঁর তিন ছেলেকেই এই স্কুলে পাঠান, দ্বিতীয় এবং পঞ্চম শ্রেণীতে। তাঁর কথায়, "তিনজনেই সবসময় হেডস্যারের প্রশংসা করে। বলে উনি নাকি নিজের পকেট থেকে স্কুলের জন্য টাকা দেন।"

বিইও উপেন্দ্র কুমারও বলেছেন যে আলি নিয়মিত নিজের পকেট থেকেই স্কুলের পরিকাঠামোর খরচ যোগাতেন। "প্রায় ৬৫ হাজার টাকা দামের একটা প্রোজেক্টর কিনে ছোট একটা ক্লাসরুম চালু করেন উনি। নিয়মিত নিজের মাইনের টাকা থেকে স্কুলের উন্নয়নের জন্য খরচ করেন। শিক্ষা দপ্তর যদি কোনও কাজের জন্য পাঁচ হাজার টাকা বরাদ্দ করে, আর খরচ হয় সাত হাজার, উনি বাড়তি দু'হাজার নিজে থেকেই দিয়ে দেন।"

আলি নিজে এ ব্যাপারে কী বলছেন? তাঁর দাবি, যখন ২০১১ সালে স্কুলে যোগ দেন তিনি, তখন ছাত্রসংখ্যা ছিল ৭১। "আমি একেকটা ইট জুড়ে এই স্কুল তৈরি করেছি। যখন আসি, তখন বাচ্চাদের ভালো করে বসার জায়গাও ছিল না। এখন স্মার্ট ক্লাস রয়েছে। আমি ছাত্রদের ভালবাসি বলেই নিয়মিত পকেটের টাকা খরচ করি..." বলেন আলি, যিনি সাত ভাইবোনের একজন। চতুর্থ শ্রেণীতে মাকে হারান তিনি, এবং তাঁর বাবা পেশায় ছিলেন সবজি বিক্রেতা। "আমার পক্ষে সহজ ছিল না পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়া। আমার বড় হয়ে ওঠার দিনগুলোতে অবস্থা খুব ভালো ছিল না আমাদের।"

yogi adityanath uttar pradesh