Advertisment

একটি আত্মহত্যার পর...

বহু ক্ষেত্রে লঘু অপরাধে গুরুদন্ড প্রাপ্তি হয়। বিশেষত আত্মহত্যার মধ্যে প্রেমের মশলা থাকলে তো কথাই নেই। যে মারা যায়, তার বিপরীতে থাকা ছেলে বা মেয়ে কাঠগড়ায় প্রথমেই।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
teenage suicide west bengal

প্রতীকী ছবি

উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা ২০১৯-এর ঠিক আগের ঘটনা। খবরে দেখলাম, উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার্থী একটি মেয়ে আত্মহত্যা করেছে। প্রেমিকের প্রতারণার শিকার সে। সেই দুঃখ এতটাই কাতর করে দেয় তাকে, যে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার মতো এত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ও গৌণ হয়ে যায় মেয়েটির কাছে। সংবাদ সূত্রে এও জানা যায়, পুলিশ প্রেমিক প্রবরকে গ্রেফতার করেছে। এইসব খবরের এর চেয়ে বেশি আপডেট থাকে না। বিশেষত এখন লোকসভা নির্বাচনের মতো চরম গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু সামনে। টিভি চ্যানেলগুলোর মুখ সেইদিকেই। ফলে সেই মেয়েটির আত্মহত্যার প্রাথমিক কারণ, অর্থাৎ সেই প্রেমে প্রতারিত হওয়া ও প্রেমিকের গ্রেফতারের খবরের বাইরে আর কিছু জানা যায় না।

Advertisment

প্রশ্নটা কিন্তু মনে থেকেই যায়, সত্যিই কি ছেলেটি অপরাধী? তাদের দুজনের মধ্যের সমস্যাটা আদতে কী? মেয়েটির সামনে কি বিকল্প কোনও পথ ছিল না? আত্মহত্যা করে সে নিজে তো আর কিছু পেল না। কিন্তু তার পরিবার? যে যন্ত্রণা, হয়রানির শিকার হলো তারা, তার পরিমাপ কে করবে?

এগুলো নিছক এক আত্মহত্যা-পরবর্তী গতানুগতিক বক্তব্য ভাববেন না দয়া করে। প্রেমে প্রত্যাখ্যান, প্রেমে প্রতারণা এবং প্রেমের আরও অনেক খিচুড়ি মার্কা কান্ডকারখানা দেখে মাঝে মাঝে দুঃখ নয়, অবাকই লাগে আমার। সব থেকে বড় কথা, ঘটনার জন্য যাকে অপরাধের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হলো, তারও তো কিছু বলার থাকতে পারে। সেটা কি শুনি আমরা?

আরও পড়ুন: বয়স কুড়ি পেরোনোর আগেই ঠিক করে নিন ডায়েট

এই প্রসঙ্গে আমার কলেজ জীবনের একটা ঘটনা মনে পড়ছে। সেটা সাতের দশকের শুরু। থার্ড ইয়ারের একটি ছেলে, আমরা ফার্স্ট ইয়ার তো বটেই, পুরো কলেজের ছেলেমেয়ে তার ভক্ত । খুব হাসিখুশি, হুল্লোড়বাজ, পরোপকারী। সেই ছেলেটি, ধরুন তার নাম পার্থ, আমরা পার্থদা বলে ডাকি। সেই পার্থদার সঙ্গে জয়াদির প্রেম। বেশ সুন্দরী। তবে জয়াদি একেবারে উল্টো স্বভাবের, খুবই অন্তর্মুখী। তাতে কী? ওদের এককথায় সাত জন্মের প্রেম, ছাড়াছাড়ির প্রশ্ন নেই।

একদিন কলেজে গিয়ে হঠাৎ শুনি, জয়াদি আত্মহত্যা করেছে। মাথায় বাজ পড়ে। সবারই বয়স কম। ব্যাপারটা নিতেই পারছি না। খুব কষ্ট সবার মনে। এই মন জিনিসটা কতটা জটিল, তখনই বুঝলাম। আমাদের সবার হিরো পার্থদা রাতারাতি ভিলেন হয়ে গেল কলেজে। নিশ্চয়ই পার্থদাই কিছু...! পুলিশ কী করল, তদন্তে কী জানা গেল, সুইসাইড নোট ছিল কিনা, এসব বোঝার মতো বিশেষজ্ঞ তখনও হয়ে উঠতে পারি নি আমরা। মিডিয়া বলতে শুধুই সংবাদপত্র। সেখানেও পাড়ার কোন মেয়ে বিষ খেল বা গলায় দড়ি দিল, তা নিয়ে তেমন শোরগোল হতো না। বড় জোর চার লাইনের খবর। কিন্তু সেও তো পরের দিন সকালে। আর তার ফলো আপ? সেসব দেখা বা বোঝার ভাবনাই বা আমাদের মাথায় কোথায় তখন? কিন্তু ওই মন, সে তো পার্থদাকে অপরাধী সাব্যস্ত করে ফেলেছে। অতএব ত্যাগ করো, একঘরে করে দাও মানুষটাকে।

আরও পড়ুন: “আমাদের মতো মানুষরা সিগন্যালে দাঁড়িয়ে ভিক্ষে করতে চান না”

এমন দাঁড়াল অবস্থা, যে পড়াশোনা শেষ করার জন্য বেচারা পার্থদাকে ট্রান্সফার নিতে হলো অন্য কলেজে। তারপর অনেকগুলো বছর কেটে গেছে। কলেজ জীবনের কথা স্মৃতি থেকে প্রায় অবলুপ্ত। ভুলে গেছি পার্থদা-জয়াদি বৃত্তান্তও। হঠাৎই কলকাতার বাইরে অনেক দূরের এক ছোট শহরে বেড়াতে গিয়ে দেখা পার্থদার সঙ্গে। দেখা ও স্মৃতি রোমন্থন। তার মধ্যেই উঠে আসে জয়াদির কথা। জানতে পারি, জয়াদির অভিমানটা ছিল পুরোপুরি তার অভিভাবকদের ওপর। তাঁদের পার্থদাকে পছন্দ নয়। সেই নিয়েই অশান্তি। ধিকি ধিকি সেই অশান্তিই ওই চরম ভুল পথে নিয়ে যায় জয়াদিকে। অর্থাৎ পার্থদা একদম নির্দোষ। আর আমরা তাকে কী না কী ভেবেছি!

তাহলে এমনও হয়? সব আত্মহত্যার পিছনেই দুটো গল্প থাকতে পারে। একটা, যা সত্যি, সেটা আবার সব সময় সামনে না-ও আসতে পারে। আর একটা হলো, আমাদের মনগড়া। সত্যিটা বাইরে না এলে সেই মনগড়া কাহিনি পল্লবিত হয়ে আশপাশের মানুষদের মধ্যে ছড়িয়ে যায়। অনেক সময় তদন্তকারীরাও এর দ্বারা প্রভাবিত হয়ে পড়েন। বিচারের বাণী নীরবে নিভৃতে কাঁদে। উদোর পিন্ডি বুধোর ঘাড়ে যায়। বহু ক্ষেত্রে লঘু অপরাধে গুরুদন্ড প্রাপ্তি হয়। বিশেষত আত্মহত্যার মধ্যে প্রেমের মশলা থাকলে তো কথাই নেই। যে মারা যায়, তার বিপরীতে থাকা ছেলে বা মেয়ে কাঠগড়ায় প্রথমেই।

আত্মহত্যা বিষয়টা দুখদায়ক নিঃসন্দেহে। এটা কোনও অবস্থাতেই কাম্য নয়। মজার কথা হলো, এরও অনেক ব্যাখ্যা, বিশ্লেষণ আছে। কেউ কেউ ঘটনা কানে আসা মাত্র নিজেই শোকসাগরে  নিমজ্জিত হবে। শোকের বাতাবরণটা দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হোক, এটাই চাইবে তারা। কারণ, ওই দুঃখবিলাস। একদল গবেষণায় বসে যাবে। বিশেষজ্ঞের মতামত দেবে। এমন কাটাছেঁড়া করবে যে মৃত মানুষটিও ভাবতে বাধ্য হবে, কেন আত্মহত্যা করলাম! ভাগ্যের দোহাইও দেবে কেউ কেউ। বলবে, এটুকুই আয়ু ছিল।

আরও পড়ুন: ঘুম আয় রে…

কিন্তু কেউ কিছু শিখবে না। কেউ ভাববে না, এই আত্মহত্যাটা কি আটকানো যেত? চারপাশের মানুষের অনুভূতি সম্পর্কে উদাসীন থাকবে। কোনও ঘটনা, ভালো বা মন্দ, হঠাৎ ঘটে না। তার কিছু চিহ্ন ও প্রক্রিয়া থাকে। কিন্তু আমরা সেটা দেখেও দেখি না।

মনোবিদদের মতে, আত্মহত্যা একটা মানসিক রোগ। সব রোগের মতোই সময়ে চিকিৎসা করালে, সেটা সেরে যায়। মানসিক গঠনটাও একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। অভিভাবকদের দায়িত্ব এক্ষেত্রে অনেক বেশি। শুরু থেকেই একটি শিশুর মনের গঠন এমন হওয়া দরকার যে জীবনের সব ক্ষেত্রে কঠিনতা, অপ্রাপ্তি, অসামঞ্জস্য ইত্যাদি নেতিবাচক দিক যেন সহজে গ্রহণ করতে পারে। জীবনে এগুলো থাকবে, থাকবেই। মানসিক প্রস্তুতি না থাকলে, তখনই মনে হবে, আর পারছি না। আর এই না পারাই বেছে নিতে বাধ্য করবে সেই তাৎক্ষণিক সমাধান, অর্থাৎ আত্মহত্যার পথ। অথচ, এটাই যদি একমাত্র পথ হতো, তাহলে সবাই আত্মহত্যা করতো।

এতকিছুর পরও যদি অঘটন ঘটে, সে ক্ষেত্রেও কাউকে কাঠগড়ায় দাঁড় করাবার আগে দুবার ভাবুন। মনে রাখুন, অপরাধীর শাস্তি না পাওয়ার থেকে অনেক খারাপ কোনও নিরপরাধের শাস্তি পাওয়া। আর এটা আমার কথা নয়, ভারতীয় সংবিধান বলে।

abetment of suicide
Advertisment