১৬
পাহাড়ি এক ঝোরার নিচে চব্বিশ–পঁচিশ বছরের এক সুন্দরী।
সে কি স্নান করছে? বোঝা যাচ্ছে না। মনে হচ্ছে, স্নান করছে না, ভিজছে। ভিজছে এবং হাসছে। বোঝাই যাচ্ছে, এই কনকনে পাহাড়ি ঠাণ্ডায় ভিজে সে খুবই আনন্দ পাচ্ছে। মেয়েটির চোখ মুখ তেমন স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে না, কিন্তু খুবই সুন্দর লাগছে। এটা একটা আশ্চর্য ঘটনা। মানু্ষের সৌন্দর্য বুঝতে সবসময় তার চোখ মুখ দেখতে হয় না। এই কন্যাকে দেখে কেউ যদি ভাবে, পাহাড়ি ঝোরা এবং মেয়েটি বন্ধু। এখন তারা কোনো বিষয় নিয়ে একই সঙ্গে হাসাহাসি করছে।
মেয়েটি পরে আছে নীল জিনস, সাদা শার্ট। সে একটা পাথর থেকে আরেকটা পাথরে নাচে ভঙ্গিতে লাফাচ্ছেও।
আরও পড়ুন, সন্মাত্রানন্দের সিরিজ ধুলামাটির বাউলের প্রকাশিত পর্বগুলি
পাহাড়ি পথের বাঁকে, ঘন সবুজ গাছের আড়ালে কোনো উচ্ছ্বল তরুণীর স্নান দৃশ্য অবশ্যই আকর্ষণীয়। আর স্নান যদি জিনস্ এবং শার্ট পরা অবস্থায় হয় তাহলে তো অতি আকর্ষণীয়। সেই সঙ্গে মজারও বটে।
এই মজার দৃশ্য প্রথম চোখে পড়েছিল মুকুরের। পাশে ছিল সুনন্দ। ওরা ওই মেয়ের থেকে বেশ খানিকটা ওপরে। অন্তত ফুট তিরিশ তো বটেই। ঝোরাটা সেখান থেকে খাদে ঝাঁপিয়ে পড়ছে সেই মাথায়। তার মানে মেয়েটা হয় নিচ থেকে উঠেছে, নয়তো এখান থেকে পাহাড় বেয়ে নিচে নেমেছে। মুকুররা অবশ্য গাড়ি রেখে দুজনে বেশ হেঁটে ওপরে উঠেছে। ঝোরা দেখতেই এসেছে। ঝোরায় জল যে অনেক, এমন নয়। তারপরেও পাহাড়ে ধাক্কা খেতে খেতে, নিচে লাফিয়ে পড়ছে। ওপর থেকে ছবির মতো লাগছে। নিশ্চয় বর্ষায় জল বাড়ে। গাছপালা, কুয়াশা আর পাহাড়ের মধ্যে দিয়ে আসায় রহস্যময় লাগছে। একধরনের আদিম সৌন্দর্য। বসবার জায়গা টায়গা এখানে কিছু নেই। বসতে হলে পাথরে বসতে হবে। এটা কোনোও ট্যুরিস্ট স্পট নয়। লোকজন খুব একটা আসে না। ড্রাইভারের কাছে শুনে গাড়ি নিয়ে উঠে এসেছে।
‘ওখানে কী আছে?’
‘কিছু নেই মেমসাব।’
সুনন্দ বলেছিল, ‘কিছু নেই তো যাব কেন?’
ড্রাইভার বলেছিল, ‘আমি তো যেতে বলিনি সাব। মেমসাব জানতে চাইলেন তো বললাম।’
মুকুর বলল, ‘এই যে বললে, একটা ঝোরা রয়েছে।’
ড্রাইভার বলল, ‘পাহাড়ি জায়গায় অমন ঝোরা অনেক থাকে।’
মুকুর বলল, ‘এই ঝোরার নাম কী?’
ড্রাইভার বলল, ‘এই ঝোরার নাম কোনো নেই। কেউ ওখানে যায় না, তাই ঝোরার নামও লাগে না।’
সুনন্দ মুখ ভেটকে বলল, ‘ভালই হয়েছে। অত ওপরে আর যেতে হবে না। এই জায়গাটাতেই তো কিছু নেই। ফালতু আসা হল। তিনটে দিন গচ্চা গেল।’
মুকুর এই কথায় গা করেনি। এবার শুরু থেকেই সুনন্দ আসতে চাইছিল না। তার নাকি অফিসে কাজ। পুনের সাইটে যাওয়ার ছিল। বেড়ানোরে মতো সময় তার হাতে নেই। মুকুর একরকম জোর করেই নিয়ে এসেছে। মুকুরকে বেশি ‘না’ বলতে পারে না সুনন্দ, তাই মুখ গোমড়া করে চলে এসেছে। বাগডোগরা এয়ারপোর্ট থেকে দু’ঘন্টার একটু বেশি লেগেছিল। পথে কফি আর মোমো খাওয়া হয়েছে। কালিঝোরা থেকে আরও তেরো কিলোমিটার মতো উঠতে হল। সব মিলিয়ে পাঁচ হাজার ফুট ওপরে। খুব ঠান্ডা। ট্যুরিস্ট গাইডে এই জায়গার নাম চট করে পাওয়া যাবে না। পাহাড়ি একটুকরো গ্রাম। নামটাও অদ্ভুত। অহলদার। ম্যাগাজিনে মুকুর খুঁজে পেয়েছে।
পাইন, ফার্মে ঘেরা নির্জন রঙিন গ্রাম একটা। একদিকে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে রয়েছে কাঞ্চনজঙ্ঘা। এমুড়ো থেকে ওমুড়ো পর্যন্ত দেখ যায়। পাহাড়ের কোনো কোনো ভিউ পয়েন্ট থাকে যেখান থেকে হাত বাড়ালেই ছোঁয়া যায়। এতো কাছে রূপোয় মোড়া পাহাড়চূড়ো এর আগে দেখেনি মুকুর। ছোটো ছোটো রঙিন ঘরবাড়ি। গ্রাম থেকে একটু সরে গেলে খান কয়েক কাঠের বাড়ি। এটাই গেস্টহাউস। আসলে হোম স্টে। অহলাদারে এটি ছিল একমাত্র থাকবার জাযগায়। ভোরবেলা কাঞ্চনজঙ্ঘার ঘুম ভাঙে রাজকীয় ভঙ্গিতে। সোনালি আলোয় আড়মোড়া ভাঙে গ্রাম। দ্বিতীয় দিন ঘুরতে বেরিয়ে নামহীন ঝোরার কাছে চলে এসেছিল। বেশ ঠান্ডা। পাথরের ওপর বসে মুকুর নিচের দিকে তাকিয়ে ঝোরা দেখছিল আর তখনই ঝোরা কন্যাকে দেখতে পায়। সুনন্দ পাশে বসেছিল। মুকুর তার কোট ধরে টান দেয়।
আরও পড়ুন, দেবেশ রায়ের স্মৃতিকথন মনে পড়ে কী পড়ে না
‘ওমা! দ্যাখো দ্যাখো। একটা মেয়ে কেমন জলে ভিজছে!’
সুনন্দর এমনিতেই মেজাজ কিঞ্চিৎ খটমট হয়ে আছে। বউয়ের ডাকে অনিচ্ছে সত্ত্বেও সে নিচে মুখ ফেরায়।
‘এই ঠান্ডায় জলে ভিজছে! লোকাল?’
সুনন্দ বিরক্ত মুখে বলে, ‘তাই হবে। না হলেও কিছু এসে যায় না। হয় পাগল, নয়তো মাতাল।’
‘নিউমোনিয়া হবে তো।’
সুনন্দ বলল, ‘হোক, তোমার কী? চল উঠি।’
মুকুর বলল, ‘আর একটু থাকি।’
সুনন্দ বলে, ‘পাগলামি দেখবে!’
মুকুর হেসে বলল, ‘সে পাগল বলো আর যাই বলো বেশ মজা লাগছে কিন্তু। ইস্ আমিও যদি ঝরনার তলায় অমন নাচতে পারতাম।’
সুনন্দ এবার রাগ করেই উঠে পড়ল। বলল, ‘যাও, তুমিও নেমে যাও না। নেমে গিয়ে ঝরনায় দাঁড়িয়ে নৃত্য করো।’
সুনন্দ খানিকটা দূরে সরে গিয়ে সিগারেট ধরাল। মুকুর আকাশ, পাহাড়, জঙ্গল দেখার পর আবার নিচে তাকায়।
আরে! মেয়েটা কি সত্যি পাগল? ঝোরা কন্যা এবার তো ভয়ানক কাণ্ড করেছে। গায়ের ভেজা জামা খুলে ছুড়ে ফেলে দিয়েছে। গায়ে শুধু কালো রঙের ব্রা। কোমরের বেল্টটা খুলে নিচু হয়ে ট্রাউজারটাও খুলে ফেলল। এখন শুধু প্যান্টি। এতদূর থেকে প্যান্টির রঙ বোঝা যাচ্ছে না। মুকুর বুঝতে পারল, আর দেখা উচিত না। মেয়েটি নিশ্চয় ভাবছে, এই পাহাড়-জঙ্গলে মেঘ আর কুয়াশা ছাড়া কেউ কোথাও নেই। সে প্রকৃতির সঙ্গে প্রকৃতির মতো আদিম হয়ে মিশে যেতে চাইছে।
মুকুর চোখ সরিয়ে নিতে গিয়েও পারল না। প্রায় নগ্ন তরুণী এবার দুপাশে দু’হাত ছড়িয়ে এক পাক ঘুরেও নিল। এক সময়ে দেখা সাবানের বিজ্ঞাপনের মতো। এবার মুকুর দেখতে পেল, তরুণী একা নয়। ঝোরার থেকে একটু দূরে দাঁড়িয়ে ক্যামেরা বাগিয়ে আছে এক তরুণ। সে ফটো তুলছে। হাঁটু মুড়ে, বসে পড়ে, কাত হয়ে নানা কায়দায় ছবি তুলছে। সে অবশ্য শার্ট-প্যান্ট পরে আছে। ছেলেটি কে? ওর স্ত্রী? তাই হবে। মেয়েটি সরে এসেছে, ছেলেটি তাকে একটা তোয়ালে ছুড়ে দিল। তার মানে তৈরি হয়ে এসেছে। ছেলেটি কিছু একটা বলল। মেয়েটি গা মুছতে মুছতে ব্রা খুলে ফেলল। তোয়ালে কাঁধে রেখে পাথরে বসে পোজ দিতে শুরু করল।
মুকুর আর পারল না। সে উঠে সরে গেল। এবার দেখাটা অপরাধ হচ্ছে।
সেদিন দুপুরেই কটেজে ওই ছেলেমেয়ের সঙ্গে আলাপ হয়ে গেল। পাশের কোয়াটার্রে উঠেছে। দিশা আর কিশোর। দুই বন্ধু। হইচইয়ের মধ্যে থাকে। কাজ করে বড় কোম্পানিতে। লিভ টুগেদার করছে। বিয়ের কথা ভাবছেই না। কিশোরের আবার ফটোগ্রাফির শখ। পাহাড়ে সঙ্গিনীর ফটো তুলতে এসেছে। নানা পোজের ছবি। এবার কাছ থেকে দিশাকে দেখল মুকুর। অতি সুন্দরী বললে কম বলা হবে। কিশোর ছেলেটি মিশুকে। ওরাই আলাপ করল এবং জমিয়ে নিল। সারাদিনটা চমৎকার, কিন্তু সন্ধ্যের পর ভীষন একা। তাই পরের দুদিন হুইস্কি, পকোড়া সহযোগে সন্ধ্যে থেকে রাত পর্যন্ত জমিয়ে গল্প হল। সুনন্দও মজে গেল। ওর বেড়াতে আসার বিরক্তিটাও কমল যেন।
রাতে নিজের কটেজে ফিরে মুকুর হালকা হেসে বলল, ‘অমন সুন্দরীকে পেয়ে মুড ঠিক হয়ে গেল?’
সুনন্দ বলল, ‘মেয়েটি সুন্দরী তাতে কোনোও সন্দেহ নেই। তবে কিশোরও কম সুন্দর নয়। আর দেখছি ও তো তোমাকে বেশি পাত্তা দিচ্ছে। তুমিও সুন্দরী বলে।’
মুকুর হাই তুলে বলেছিল, ‘তাও তো সেদিন ঝরনার পুরো দৃশ্যটা দেখতে পাওনি। তাহলে মাথা ঘুরে পড়ে থাকতে।’
সুনন্দ বলল, ‘ওসব ওদের বলতে যেও না যেন। লুকিয়ে প্রেম দেখা কোনো কাজের কথা নয় মুকুর।’
‘দেখিনি, চোখে পড়ে গিয়েছিল।’
সুনন্দ ভুরু কুঁচকে বলল, ‘কী চোখে পড় গিয়েছিল?’
কম্বলের তলায় সুনন্দর কাছে ঘেঁষের মুকুর বলেছিল, ‘শুনে কাজ নেই। কাছে এসো।’
সুনন্দ কম্বলের ভিতরই মুকুরের সোয়েটার নাইটি খুলতে খুলতে বলল, ‘কিশোর ছেলেটা ইন্টারেস্টিং। ফটো তোলে আর থ্রিলারের ভক্ত। একটা মার্ডারের গল্প বলল, আমি তো শুনে থ। পয়জন ইউজ করে খুন। কীভাবে বিষটা গেল বুঝতেই পারা যায় না। বাপ্রে!’
মুকুর সুনন্দর স্লিপিং সুট খুলতে খুলতে বলল, ‘এখন খুনের গল্প বাদ দাও তো।’
মুকুরের নিমন্ত্রিতের লিস্টে দিশা আর কিশোরও রয়েছে। সুনন্দর উৎসাহই বেশি। ওরা এখন সবসময় একসঙ্গে থাকতে পারে না। দিশা পুনেতে বদলি হয়েছে। এখন অবশ্য কলকাতায়।
দিশার ফোন পাওয়া গেল না। মুকুর ওর জন্য মেসেজ রাখল।
——————
প্রচেত গুপ্তের অনাবৃত উপন্যাসের সবকটি পূর্ব প্রকাশিত খণ্ড পাবেন এই লিংকে