১৭
মানুষটা মেঝের ওপর পড়েছিল উপুড় হয়ে। মাথাটা একপাশে কাত। গায়ে কালো ঘরে পরবার গেঞ্জি আর পায়জামা। দুহাত ছড়ানো। মাথার চারপাশে জমাট বাঁধা রক্ত গোল হয়ে রয়েছে। টাটকা রক্ত। সবে গড়ানো শেষ করে থমকে গেছে। বাঁ হাতের কাছে পড়ে রয়েছে দলা পাকানো তোয়ালে। একটা হাত তোয়ালের ওপর রাখা। তোয়ালের রঙ নীল। রক্তের ছিটে এসে লেগেছে। তবে এটা বোঝা যাচ্ছে, ভদ্রলোক স্নানে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন।
ইনি একজন প্রাক্তন মিলিটারি অফিসার। মেজর ছিলেন। এখনও সবাই ‘মেজরসাহেব’ বলেই চেনেন। নাম সুনীলকুমার চৌবে। বয়স পঁয়ষট্টি থেকে ছেষট্টি। দেখলে বয়স বোঝা যাবে না। লম্বা, চওড়া পেটানো চেহারা। চুল ছোটো করে ছাঁটা। ঠোঁটের ওপর পাকানো গোঁফও রয়েছে। মিলিটারি অফিসারদের যেমন হয়।
‘কারেন্ট গোপাল’ পুলিশকে জানিয়েছে, মেজরের উপুড় হয়ে পড়ে থাকবার দৃশ্য প্রথম সে দেখতে পেয়েছে। সে যখন ফ্ল্যাটে আসে, মেন দরজা ভেজানো ছিল। লকে হাত দিতেই দরজা খুলে যায়। দরজা ঠেলেই সে ঘরে ঢুকে পড়েছিল। একটু পরেই মেজরকে পড়ে থাকতে দেখে। তখনও সে জানত না, ভদ্রলোক মারা গেছেন, এবং মারা গেছেন গুলিতে। ক্লোজ রেঞ্জ থেকে গুলি মাথায় ঢুকে এফোঁড় ওফোঁড় করে দিয়েছে।
গোপাল পাড়ার ইলেকট্রিক মেকানিক। সেই কারণে নাম ‘কারেন্ট গোপাল’।
পুলিশ ‘কারেন্ট গোপাল’কে জিগ্যেস করে, ‘দরজা কেন খোলা ছিল?’
গোপাল পুলিশকে জানায়, সম্ভবত তার জন্যই খোলা ছিল। মেজর সাহেব অপেক্ষা করছিলেন।
গোপাল ঘটনার দিন সকালে ফোন পায়। মেজর নিজে ফোন করেছিলেন। গিজার কাজ করছে না। কয়েক মুহূর্ত লাল আলো জ্বালিয়েই থমকে গেছে। এখনই এসে গোপালকে সারিয়ে দিতে হবে। গোপাল ফোন পেয়েছিল সকালে। যেতে ঘন্টাখানেক লেট হয়ে যায়। এর মধ্যে আরও একবার ফোন যায়। সেই ফোনে সুনীল চৌবে তাকে তাড়া দেন।
পুলিশ জানতে চায়, কেমন ভাবে তাড়া দেন? বকাবকি করেন?
গোপাল বলে বকাঝকা করেননি। মিলিটারি হলেও তিনি কখনও রাগারাগি করতেন না। তবে গম্ভীর গলায় কথা বলেতেন। সেদিনও তাই বলেছেন।
‘কখন আসছো গোপাল?’
‘আসছি স্যার। একটু পরেই আসছি।’
‘আমার তাড়া আছে যে। হসপিটাল যেতে হবে। আমার মিসেস কদিন ধরে হসপিটালে ভর্তি রয়েছেন।’
‘স্যার, একটা এমারজেন্সি কাজ সেরেই যাচ্ছি।’
‘আমারটাও এমারজেন্সি কম নয়। দেরি কোর না। স্নান করে বোরোতে পাচ্ছি না। ওদিকে ডক্টরের সঙ্গে দেখা করতে হবে। তুমি দেরি করলে কিন্তু আমাকে ঠান্ডা জলেই স্নান করে ফেলতে হবে। রেজাল্ট উইল বি ব্যাড। আমার গলা ব্যথা হয়েছে।’
‘স্যার একটু অপেক্ষা করুন।’
আরও পড়ুন, সন্মাত্রানন্দের সিরিজ ধুলামাটির বাউলের প্রকাশিত পর্বগুলি
গোপাল পুলিশকে জানিয়েছে, তারপরেও মেজরের ফ্ল্যাটে যেতে তার দেরি হয়। দেরি না করে উপায় ছিল না। গোপালকে কাজ করতে হয় প্রায়োরিটি বুঝে। সে মনে মনে সেভাবেই লিস্ট বানায়। এর আগে দুটো বাড়িতে তাকে যেতে হয়েছিল। প্রথম বাড়িতে মেন সুইচে গোলমাল হয়েছে। গোটা বাড়ির কারেন্ট চলে গেছে। বাড়ির ছেলে মোটরবাইক নিয়ে এসে হাজির। হইচই লাগিয়ে দিল। মোটরবাইকের পিছনে বসিয়ে এখনই নিয়ে যাবে। তাই গেল। সেই বাড়ির কাজ শেষ করতেই দ্বিতীয় বাড়ি থেকে ফোন এলো। আর্থিং-এর ঝামেলা হয়েছে। জলের কলে, রেফ্রিজারেটরে হাত দিলে চিন্চিন্ করে কারেন্ট লাগছে। বড় কিছু অ্যাক্সিডেন্ট হলে সর্বনাশ হয়ে যেতে পারে। গোপালের মনে হয়েছিল, গিজারের থেকে বেশি জরুরি। সে ওই বাড়িতে চলে যায়।
পুলিশ জিগ্যেস করে, দুটো বাড়ির নম্বর কত?
গোপাল একটি বাড়ির নম্বর বলতে পারে, দ্বিতীয় বাড়ির নম্বর বলতে পারে না। শুধু বলে, চারমাথার মোড়ের মা কালী ভাণ্ডারের দুটো বাড়ি পরে।
পুলিশ জানতে চায়, তারপর কী হল?
‘কারেন্ট গোপাল’ জানায়, তারপরে সে নাকি একটু ভয়ে ভয়ে ছিল। যতই প্রাক্তন হোক, মিলিটারি বলে কথা। তবে এর আগেও বেশ কয়েকবার এই ফ্ল্যাটে কাজ করেছে গোপাল। মানুষটা কখনও রাগারাগি করেন নি। সবথেকে বড় কথা, পয়সাকড়ি নিয়ে দরাদরি করতে হয় না। একদিন তো একটা দারুণ ব্যাপার হয়েছিল। সেই গল্প গোপাল অনেককে বলেছে। পুলিশকেও বলল।
গোপাল মেজরের ফ্ল্যাটে গিয়েছিল টিউবলাইটের সেট বদলাতে। ডোরবেল টিপতে ম্যাডাম এসে দরজা খুলে দিলেন। ভিতরে ঢুকে গোপাল দেখল, বসাবার ঘরের সোফায় মেজর বসে। হাতে একটা রিভলভার। সামনের টেবিলে রাখা আছে শিশি, ঝাড়ন, নানা মাপের লম্বা, সরু, মুখ থ্যাবড়া ব্রাশ। সেসব দিয়ে সাহেব রিভলভার পরিষ্কার করছেন। গোপালের চোখ তো ছানাবড়ার মতো হয়ে গেল। সে এত কাছ থেকে কখন বন্দুক, রিভলভার দেখেনি। সেদিন নাকি যতক্ষণ সে মেজরের বাড়িতে ছিল, রিভলভার পরিষ্কারের কাজ চলেছে। একসময়ে সে আর থাকতে পারে নি। মেজরকে জিগ্যেসও করে বসে।
‘স্যার, কিছু মনে না করলে একটা প্রশ্ল করতাম।’
রিভলভারের নলে লম্বা বুরুশ ঢুকিয়ে সুনীল চৌবে বলেন, ‘এই পিস্তল নিয়ে জিগ্যেস করবে তো?’
গোপাল ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায়। কী করে বুঝতে পারল? একেই বলে বুদ্ধি।
‘হ্যাঁ স্যার। এত কাছ থেকে আমি কখনও রিভলবার দেখি নি।’
‘এটা রিভলভার নয়, নাইন এমএম পিস্তল। এটাকে বলে এমনাইন বেরেট্টা। জার্মান কোম্পানির তৈরি। ওয়ারফিল্ডে খুব ভাল কাজ করত। এখন অবশ্য অনেক মডার্ন জিনিস বেরিয়ে গেছে।’
‘কারেন্ট গোপাল’ গদগদ গলায় বলে, ‘স্যার, এটা আপনার?’
‘হ্যাঁ। লাইসেন্সও রয়েছে। আর্মি থেকে রিটায়ারমেন্টের সময় আমি স্পেশাল পারমিশন করিয়ে ছিলাম। আমার ওপর থ্রেট রয়েছে। যখন কাজ করেছি দেশের অনেক গুপ্ত শত্রুকে ঘায়েল করতে হয়েছে। তাদের দলের কারও তো আমার ওপর রাগ থাকতে পারে।’
গোপাল হাত কচলে বলেন, ‘এটা আপনি সঙ্গে রাখেন স্যার?’
কম কথার মানুষ সুনীল চৌবে বললেন, ‘কখনও কখনও।’
গোপাল পুলিশকে বলেছিল, সেদিন একরকম ছুটতে ছুটতেই সে গিজার সারাতে আসে। চেনা মিস্ত্রি বলে ফ্ল্যাটে ঢুকতে সমস্যা হয়নি। সিকিউরিটি আটকায়নি। সে লিফটে ঢুকে সোজা তিনতলায় চলে যায়। বাঁদিকের কোনার ফ্ল্যাটই মেজরের। পুলিশ ফ্ল্যাটের কেয়ারটেকার, সিকিউরিটি এবং অন্যান্য বাসিন্দাদের কাছ থেকে জানতে পেরেছে, মেজর স্ত্রীকে নিয়ে এই ফ্ল্যাটে উঠেছিলেন তিন বছর আগে। ছেলে আর ছেলের বউ থাকে বিদেশে। ছেলে ওখানে চাকরি করে। সুনীল চৌবের ইচ্ছে ছিল একমাত্র ছেলে তাঁর মতোই মিলিটারিতে যোগ দিক। দেশের জন্য কাজ করুক। ছেলে রাজি হয়নি। এতে তিনি খুবই হতাশ হয়েছিলেন। দেশসেবা তাঁদের বংশ পরম্পরার কাজ।
আরও পড়ুন, দেবেশ রায়ের স্মৃতিকথন মনে পড়ে কী পড়ে না
তাছাড়াও ছেলের বউয়ের সঙ্গে তাঁদের সম্পর্ক সুবিধের ছিল না। মেয়েটি ফরাসি। দেশেপ্রেম তো দূরের কথা, তার এই দেশ নিয়ে কোনো আগ্রহ নেই। শ্বশুর শাশুড়ি এবং পুত্রবধূর মধ্যে রিলেশন কী সে সম্পর্কেও তার কোনো ধারণা নেই। মেজর সুনীল চৌবে এটা মেনে নিতে পারতেন না। ফলে দু পক্ষের আসা যাওয়া খুবই কম। ছেলে দেশে এলেও হোটেলে ওঠে। ফ্ল্যাটবাড়ির বাসিন্দারা এসব খবর জেনেছিল মুখে মুখে। এমনকি এও জেনেছিল, মেজরের পৈতৃক সম্পত্তি অনেক। সেসব তিনি একটি এনজিওকে দান করে দিয়েছেন। তারা মৃত সেনাকর্মীদের অসহায় পরিবারকে প্রতিপালন করে। এই নিয়ে ছেলের সঙ্গে নাকি ঝগড়াও হয়েছে খুব।
সুনীল চৌবে আর তাঁর স্ত্রী ফ্ল্যাটের বাকিদের সঙ্গে তেমন মেলামেশা করতেন না। দেখা হলে সামান্য হেসে মুখে ফিরিয়ে নিতেন। কখনও হাসতেনও না। তবে একবার ফ্ল্যাটে আগুন লেগেছিল। মাঝরাতে, মিটারবক্সে। মেজর সাহেব ভয়ংকর সাহস দেখিয়ে সেই আগুন নিভিয়ে ফেলেন দমকল আসবার আগেই। আর একবার লিফট খারাপ হয়ে যাওয়ায়, চারতলার অসুস্থ এক বৃদ্ধকে কোলে করে নিচে নামান। অ্যাম্বুলেন্সে তোলা হয়।
‘কারেন্ট গোপাল’ পুলিশকে বলেছে, ভেজানো সদর দরজা সে ফাঁক করে ঢুকে পড়ে। দুবার নাকি ‘স্যার, স্যার’ বলে চিৎকারও করে। কোনো সাড়া পায়নি। তখন আরও একটু ভিতরে যায়। যেহেতু তার ফ্ল্যাট চেনা, আগেও কয়েকবার এসেছে, অসুবিধে হয়নি। এরপর ড্রইংরুম টপকে বেডরুমে ঢুকেই মেজরকে দেখতে পায়। ঘরের মাঝখানে হুমড়ি খেয়ে পড়ে আছেন।
গোপাল নাকি ছুটে যায়। সে যে তখনও জানত না সুনীল চৌবে আর ইহলোকে নেই। কাছে গিয়ে রক্ত দেখে ভাবে, পড়ে গিয়ে মাথা টাথা কিছু ফেটে গেছে। সে দ্রুত হাতের পাশে পড়ে থাকা তোয়ালেটা দলা পাকিয়ে ছুড়ে দেয় দূরের টেবিলে। ছিটকে যাওয়া মোবাইল ফোনটা সরিয়ে রাখে খাটের ওপর। তারপর ‘স্যার, স্যার...’ বলতে বলতে মেজরের মুখটা নিজের দিকে ফেরায়। শিউরে ওঠে। বাঁ দিকটা ছিন্নভিন্ন হয়ে গেছে। কান, কপাল, মাথার খুলি আলাদা করা যাচ্ছে না।
পুলিশ ঠান্ডা গলায় বলে, ‘তারপর?’
গোপাল বলে, সে এতটাই ভয়ে পেয়ে যায় যে কাউকে কিছু না বলে ফ্ল্যাটের বাইরে চলে আসে। দরজা টেনে দেয়। সিঁড়ি দিয়ে লাফিয়ে লাফিয়ে নামতে থাকে। সিকিউরিটি গার্ডের হতভম্ব চোখের সামনে দিয়ে গেট দিয়ে রাস্তায় বেরিয়ে পড়ে। তারপর প্রায় ছুট দেয়।
পুলিশ অবাক হয়ে জানতে চায়, সে কেন ছুটেছিল?
কারেন্ট গোপাল কাঁদো কাঁদো গলায় বলে, ‘স্যার খুব ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। মাইরি বলছি।’
পুলিশ গোপালকে লক আপে পোরে। মৃতের শরীরে, তোয়ালেতে এবং তোয়ালে মোড়া আর্মি পিস্তলের নিচের দিকে গোপালের হাতের ছাপ পাওয়া যায়।
——————
প্রচেত গুপ্তের অনাবৃত উপন্যাসের সবকটি পূর্ব প্রকাশিত খণ্ড পাবেন এই লিংকে