১৮
সকলেই ধরে নিল, গোপালই খুন করছে।
ধরে নেওয়ার কারণ ছিল। পুলিশ মোটিভও সাজিয়ে ফেলল। বেশিরভাগ সময় পুলিশের কাজই তাই। সে উলটো দিক থেকে হিসেব করে। উত্তর যেন জানাই ছিল। এবার এগোতে এগোতে অঙ্কটা বানিয়ে ফেলে। এক্ষেত্রেও তাই হল। প্রাক্তণ সেনা অফিসারের হত্যার কারণ, মার্ডার ফর গেইন। মারতে পারলে অর্থ লাভ। অনেকের মতোই ‘কারেন্ট গোপাল’ –এর কাছে খবর ছিল, এবাড়িতে নগদ টাকাপয়সা গয়নাগাঁটি রয়েছে। এই ধরনের ‘খবর’ পাওয়া অসম্ভব কিছু নয়। সবসময়েই চোর ডাকাতরা পেয়ে থাকে। এই ফ্ল্যাটবাড়িতে অনেকেই এসব ‘গল্প’ জানত। নিশ্চয় সেখান থেকেই গোপালের কানে এসেছে। মেজেরসাহেবের স্ত্রী হাসপাতালে শুনে লোভ সামলাতে পারেনি গোপাল। সে তখনই মনে মনে ভেবে নেয়। দুটো বাড়িতে কাজ নিয়ে সময় নষ্ট করে। সে চাইছিল মেজর অধৈর্য হোক। হলেও অন্যমনস্কও থাকবে। সূক্ষ্ম সাইকোলজি নিয়ে খেলতে চায়। সাকসেসফুলও হয়।
পুলিশ বলেছে, গোপাল আগে থেকেই জানত অফিসারের একটা পিস্তল আছে। একথা সে স্বীকার করেছে। এমনকি ধরে নেওয়া যেতে পারে, সেই পিস্তল আলমারির কোথায় রাখা হতো সেটাও সে জেনে ফেলেছিল। মুখে এখনও বলছে না। পরে বলবে। কোনোও অপরাধী চট করে অপরাধ স্বীকার করে না। কবুল করতে সময় লাগে। এখানে লাগবে। যেদিন সে সুনীল চৌবের হাতে পিস্তলটা দেখেছিল, সেদিন আলমারি বা দেরাজ ধরনের কোথাও থেকে অস্ত্র বের করতে দেখাটা অসম্ভব নয়। রাখবার সময়েও দেখে থাকতে পারে। আবার এমনটাও হতে পারে ঘটনার দিনও মেজর সাহেব জিনিসটা বের করছিলেন। আবার নাও হতে পারে। কোনটা ঠিক তদন্তে জানা যাবে। গোপাল সেদিন ফ্ল্যাটে ঢোকবার আগেই মেজরসাহবের স্ত্রী হাসপাতালে, তিনি রয়েছেন একা। সে এই সুযোগটাই নিয়েছিল।
প্রশ্ন, সে কিছু চুরি করেনি কেন?
পুলিশ বলেছে, ভয় পেয়ে যায়। অমন ছিন্নভিন্ন মেজরকে দেখে সে নিজেকে ঠিক রাখতে পারেনি। ঘাবড়ে গিয়ে পালিয়ে যায়। অতীতে এমন বহু উদাহরণ রয়েছে। অপরাধী ভয় পেয়েছে। অপরাধ সম্পূর্ণ করবার আগেই পালিয়ে গেছে। যারা নতুন তাদের পক্ষে পালিয়েঅ যাওয়াটা আশ্চর্যের কিছু নয়। আবার এমনটাও হতে পারে, একেবারে খুন করে ফেলবার ইচ্ছে হয়তো ছিল না। শুধু আঘাত করতে চেয়েছিল। তবে যাই হোক, খুনটা যে গোপাল করেছে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। সর্বত্রই তার হাত ছাপ পাওয়া গেছে।
আরও পড়ুন, সন্মাত্রানন্দের সিরিজ ধুলামাটির বাউলের প্রকাশিত পর্বগুলি
‘কারেন্ট গোপাল’ মুকুরের বাপেরবাড়ির পাড়ার ছেলে। খুবই পরিচিত। গোপালের বাবা একসময়ে মুকুরদের বাড়িতে কাজ করেছেন। তিনি অবশ্য ইলেকট্রিকের কাজ করতেন না, ছিলেন কারপেন্টার। সেই বৃদ্ধ এসে মুকুরের বাবার পায়ে পড়লেন।
‘দাদা, ছেলে খুন করেনি। একাজ গোপাল করতে পারে না। তাকে বাঁচান।’
মুকুরের বাবা বললেন, ‘পাড়ার সবাই তো তাই মনে করে। সকলেই গোপালকে পছন্দ করে। ছোটোবেলা থেকে দেখছে। কিন্তু কী করব বল? প্রমান তো অন্য কথা বলছে। যে পিস্তলের গুলিতে আর্মি অফিসার মারা গেছেন, সেই পিস্তলে গোপালের হাতের ছাপ পাওয়া গেছে যে। শুধু পিস্তল কেন? ঘরের সর্বত্রই ছাপ রয়েছে।’
গোপালের বাবা হাউমাউ করে কেঁদে বললেন, ‘শুধু হাতের ছাপ পাওয়া গেলেই কি কেউ অপরাধী হয়ে যায়? এখন যদি ...এখন যদি বলতে নেই... আমি চলে যাওয়ার পর কোনো গুণ্ডা বদমাই এসে আপনাকে কিছু করে তখন আমার কী হবে? আপনার গায়ে তো আমার হাতের ছাপ পাওয়া যাবে না। যাবে না দাদা? আমি তো আপনার পা ধরেছি...তবে কী আমি দোষ করলাম ? ছাপ ছাড়া আর কোনো প্রমাণ লাগে না?’
মুকুরের বাবা আমতা আমতা করে বললেন, ‘এতো বলতে পারব না। তবে হাতের ছাপই তো আসল। গোপাল হঠাৎ অস্ত্রটা ধরতেই বা গেল কেন?’
গোপালের বাবা আবার হাউমাউ করে বললেন, ‘হতে পারে না, কিছুতেই হতে পারে না। আপনি ওকে বাঁচান।’
মুকুরের বাবা সেদিন শান্ত করে গোপালের বাবাকে ফেরত পাঠিয়েছিলেন। মনটা খারাপ হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু এছাড়া আর কী বা করতে পারতেন তিনি? খুনের মামলা নিয়ে বেশি ঘাঁটাঘাঁটি করা উচিত নয়। তারপরেও বিকেলে তিনি মুকুরকে ফোনে সব বলেন। তখন সবে বিয়ে হয়েছে মুকুরের। সেও গোপালকে ভাল করে চিনত। ছেলেটা একটু খেপুটে হলেও ভাল। ‘দিদি, দিদি’ করত। বাবার মুখে ঘটনা শুনে তারও মন খারাপ হয়ে গেল।
‘বুঝলি মুকুর আমারও কেমন যেন ধাঁধার মতো লাগছে। গোপালের বাবা যে বলল, হাতের ছাপই কি অপরাধী চেনার আসল উপায়?’
আরও পড়ুন, দেবেশ রায়ের স্মৃতিকথন মনে পড়ে কী পড়ে না
‘তা তো বটেই বাবা। ওয়েপনে যার হাতের ছাপ পাওয়া যাবে সেই তো দোষী।’
মুকুরের বাবা আনমনে বলেছিলেন, ‘তাও তো বটে।’
সেদিন বাবার ফোন ছাড়বার পরেই অনুকূলকাকুর কথা মনে পড়ে যায় মুকুরের। স্কুলের বন্ধু মালশ্রীর কাকা। পুলিশ ডিপার্টমেন্টে চাকরি করেন, কিন্ত পুলিশ নন। ফরেনসিক এক্সপার্ট। ফিঙ্গার প্রিন্ট নিয়ে বিদেশে পড়াশোনা করেছেন। এখন অপরাধের মনস্তত্ত্ব নিয়ে কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়িয়ে বেড়ান। জটিল কেসে ডাক পড়লে পুলিশকে সাহায্য করেন। যে কয়েকবার মালশ্রীর বাড়িতে ভদ্রলোকের সঙ্গে দেখা হয়েছে হাতের ছাপ নিয়ে অনেক গল্প শুনেছে মুকুররা। কীভাবে হাতের ছাপ খুঁজতে হয়, চিনতে হয় সব বুঝিয়ে ছিলেন। এমন একটা ইন্টারেস্টিং সাবজেক্ট শুনতেও তো মজা লাগত।
‘বুঝলে ভাইঝিরা, অপরাধ বিজ্ঞানে হাতের ছাপ খুব ইমপর্টান্ট একটা ব্যাপার। দরজার লক্, জানলার রড, কাপড় জামা, ফার্নিচার, সব জায়গায় ছাপ থাকে। মানুষের হাতের আঙুলে একধরনের আউটলেট আছে। ভালো বাংলায় যাকে বলা হয় গ্রন্থি। সেখান থেকে একধরনের অয়েলি সাবস্টানস্ সিক্রেশন হয়। তবে সবসময়ে হয় না কিন্তু। আঙুল যদি কোনো কিছুর ওপর চাপ ফেলে তবেই হবে। এই তেল ছাপ ফেলে যায়। ছাপ বোঝবার সবথেকে সমস্যা হল সেটা যদি অস্পষ্ট হয়। বিভিন্ন ধরনের গুঁড়ো দিয়ে সেই অস্পষ্ট ছাপতকে স্পষ্ট করতে হয়। অ্যালুমিনিয়ম পাউডার, ভুসোকালির গুঁড়ো, পারদ, খড়িমাটি ব্যবহার করতে হয়।’
মালশ্রী বলত, ‘বাঃ, এতো খুব সোজা। একটু চেষ্টা করলে আমরাও পারব। এবার থেকে আমাদের জিনিসে যে হাত দেবে পাউডার ছড়িয়ে ধরে ফেলব।’
অনুকূলকাকা হেসে বলতেন, ‘তা পারবে, তবে বুরুশের কায়দা জানতে হবে। বুরুশে বেশি করা পাউডার লাগিয়ে সেই পাউডার আবার ঝেড়ে ফেলতে হবে।’
মুকুর অবাক হয়ে বলত, ‘সে আবার কী! নেব আবার ফেলেও দেব?’
অনুকূলকাকা বলতেন, ‘সেই জন্য শিখতে হয়। বেশি পাউডার থাকলে কাজ ভেস্তে যাবে। বুরুশে যেন সামান্য পাউডার লেগে থাকে। এবার অস্পষ্ট ছাপের ওপর সেই বুরুশ টানতে হবে খুব সাবধানে। আঙুল থেকে সিক্রেশন হওয়া তেল সেই পাইডারকে ধরে নেবে। ছাপ স্পষ্ট হবে। ওপর থেকে পাউডার ছড়াতে গেলে ছাপ পাওয়া যাবে না।’
মুকুররা তো থ’। এতো পুরো ম্যাজিক!
অনুকূলকাকা বলতেন, ‘হাতের ছাপ শুনতেই সোজা, কিন্তু খুঁজে পেতে অলেক লেখাপড়া জানতে হয়। হোয়াইট লেড, সিলভার নাইট্রেট খুব কাজে লাগে। তারওপর অনেক ধরনের সলিউশন বানাতে হয়। যেমন ধর, লিউকো ম্যালাচিট নামের এক ধরলেরে কেমিকাল খানিকটা ইথার আর কয়েক ফোঁটা গ্লোসিয়াল অ্যাসিটিক অ্যাসিডের সঙ্গে মিশিয়ে নিলে দারুণ কাজ পাওয়া যায়। হালকা ছাপের ওপর এই সলিউশুন ছড়িয়ে দিলে নীল রঙের ছাপ পাওয়া যাবে।’
মুকুর বলতো, ‘বাপ্রে! ক্রিমিনাল ধরবার কত টেকনিক।’
অনুকূলকাকা মাথা নেড়ে নেড়ে বলতেন, ‘নইলে যে অপরাধ প্রমাণই করা যেত না। বেকসুর খালাস হযে যেত। শুধু কি আঙুলের ছাপ ভাইঝি? গন্ধে, পায়ের ছাপেও অপরাধ বোঝা যায়।’
মুকুর তার পুরোনো খাতা হাতড়ে মালশ্রীর ফোন নম্বর খুঁজতে লাগল। যে করেই হোক অনুকূলকাকাকে ধরতে হবে। গোপালকে বাঁচাতে হবে।
—————
প্রচেত গুপ্তের অনাবৃত উপন্যাসের সবকটি পূর্ব প্রকাশিত পর্ব পাবেন এই লিংকে