Advertisment

প্রচেত গুপ্তের অনাবৃত: অনুকূল রায় হাতের ছাপে রহস্য ভেদ করলেন

‘‌সে তো কাজে গেছে। পুলিশ নিয়ে গেছে। বলল, কে বিষ খেয়ে মরেছে, সেখানে গিয়ে নাকি গন্ধ শুঁকতে হবে।’‌‌

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
Pracheta Gupta, Anabrito part 2

অলংকরণ- অরিত্র দে

‘‌অনুকূলকাকা’‌ যাঁর পুরো নাম অনুকূল রায়, সময় দিলেন। মুকুর মালশ্রীকে নিয়ে সটান তার বাড়িতে চলে গেল।
অনুকূল রায় মন দিয়ে ঘটনা শুনলেন। একবার নয়, পরপর দু’‌বার শুনলেন। মুকুর যতটা জানে গুছিয়ে বলবার চেষ্টা করেছিল। স্বাভাবিকভাবেই অনেক ফাঁক ফোকর থেকে গেল।
অনুকূল রায় বলেলেন, ‘তুমি যা বললে তার সবকটা পয়েন্টই তো তোমাদের ওই গোপাল ছেলেটির এগেনস্টে যাচ্ছে ভাইঝি। বিশেষ করে হাতের ছাপ তো খুব বড় একটা এভিডেন্স। মার্ডার কেস সাজাবার সময় অভিযুক্তের হাতের ছাপ খুব কাজ দেয়।’‌
মুকুর বলল, ‘অনুকূলকাকা, সামন্য কটা টাকার জন্য ও একবারে খুন পর্যন্ত চলে যাবে‌‌! এটা কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছি না। ছোটোবেলা থেকে ওকে দেখছি।’‌

Advertisment

অনুকূল রায় হেসে বললেন, ‘‌অপরাধী অনেক সময় যেমন মাথা ঠান্ডা করে ভেবেচিন্তে কাজ করে, অনেক সময় করেও না। ঝোঁকের মাথায় গোলমাল করে বসে। বড় একটা কাণ্ড করে ভাবে, এ কী করলাম!‌ কেন করলাম?‌ খুব আপশোস হয়। তখন সে রেকটিফাই করতে চায়। রেকটিফিকেশনের তো একটাই উপায়। পালিয়ে যাওয়া। এমন তো নয়, ভুল করেছি ভেবে সে যাকে খুন করেছে তার প্রাণ ফিরিয়ে দিতে পারবে। পারলে দিতো। তাই অপরাধ অনেক সময় হঠাৎও ঘটে যায়। তোমার এই ছেলেটির বেলাতেও হয়তো সেরকম কিছু ঘটেছে। ও ভেবেচিন্তে কিছু করেনি। কিন্তু ঘটনা কী জানো ভাইঝি এতে অপরাধের মাত্রা কম হয় না।’‌
পাশে বসে থাকা মালশ্রী বলল, ‘‌অনুকূলকাকা, আমি ছেলেটিকে চিনি না, তবে মুকুরকে চিনি। মুকুর যখন ওর পাশে দাঁড়াচ্ছে, বলেছে তখন নিশ্চয় সে অপরাধী নয়। তুমি কিছু করো।’‌
অনুকূল রায় ‘‌হো হো’‌ আওয়াজে হেসে উঠেছিলেন।
‘‌এটা হচ্ছে বেস্ট যুক্তি। আমার ভাইঝি ভাল তাই দুনিয়া ভাল। কোর্টে গিয়ে বলতে হবে, মি লর্ড, আমার ভাইঝি একজন অতি চমৎকার মেয়ে। তাই তার দেওয়া ক্যারেক্টার সার্টিফিকেটও চমৎকার।’‌ অনুকূল রায় হাসি থামিয়ে বললেন,  ‘‌তবে আমি যা ঘটনা শুননান তাতে নিশ্চয় অনেক গ্যাপ রয়ে গেছে। আমি তো থার্ড হ্যান্ড শুনছি। মুকুর শুনেছে তার বাবার কাছ থেকে, তার বাবা শুনেছেন পাড়া প্রতিবেশীর কাছে থেকে। সরাসরি গোপাল এবং পুলিশের কথা শুনলে সবটা বোঝা যাবে। একবার স্পটেও গেলেও হত।’‌

মালশ্রী বলল, ‘‌শোনো না। তোমার তো পুলিশের সঙ্গে ওঠা বসা।’‌
অনুকূল রায় ‌বললেন, ‘‌ওঠা বসা কিছু নয়, ওরা ডাকলে আমি যাই। নিজে থেকে তো আর গলাগলি করি না। সময়ই বা কোথায়?‌ এই তো গত সপ্তাহে ওরা ডেকেছিল বলে একটা চুরির কেস সামলে দিয়ে এলাম।’‌‌
মুকুর বলল, ‘‌হাতের ছাপ?‌’‌
অনুকূল রায় হেসে বললেন, ‘না। পায়ের ছাপ। পায়ের ছাপ থেকে চোর ধরিয়ে দিলাম।’‌
মুকুর বলল, ‘বাপ্‌রে, আপনি পায়ের ছাপেও এক্সপার্ট!‌’‌

আরও পড়ুন, সন্মাত্রানন্দের সিরিজ ধুলামাটির বাউলের প্রকাশিত পর্বগুলি

অনুকূল রায় বললেন, ‘‌এক্সপার্ট কিছু নয়, একটু লেখাপড়া করতে হয়েছিল এই যা।  হয়েছিল কী জানো ভাইঝি, চোরটা মহা ধুরন্ধর। পুলিশকে একেবারে ঘোল খাইয়ে দিয়েছিল। আমি গিয়ে দেখি, বোডরুমে হাতের ছাপ কিছু নেই। তার মানে দস্তানা ছিল। কয়েকটা পায়ের ছাপ রয়েছে, তাও সংখ্যায় বেশি নয়। পায়ে মোজা পড়লে সেই ছাপও পেতাম না। একটা না একটা ভুল তো করবেই।‌‌ পায়ের ছাপ দেখে ক্রিমিনালতে ফিক্সড করা কঠিন কাজ। একেক জনের হাঁটা বা দৌড়োনো একেকরকম। একজন যখন হাঁটে তখন তার পায়ের পাতার সামনে পিছন দুটো দিকের ছাপই পাওয়া যায়। কিন্তু যখন দৌড়োয় তখন সামনের অংশে জোর পড়ে। পিছনটা থাকে আবছা।’‌
মুকুর বলল, ‘‌আপনার ওই চোর কি দৌড়েছিল?‌’‌
অনুকূলবাবু একটু চুপ করে থেকে বললেন, ‘‌না, পুলিশকে  ধাঁধার মধ্যে ফেলতে পিছু হেঁটে পালিয়েছিল।’‌

মালশ্রী বলল, ‘‌পিছু হেঁটে পালিয়েছিল!‌ এ কেমন পালানো অনুকূলকাকা?‌’‌
অনুকূলবাবু চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বললেন, ‘‌অপরাধীরা মাঝে মাঝে এই কাণ্ড করে। অকুস্থলে তার গতিবিধি যাতে ঠিকমতো বোঝা না যায় তার জন্য একেকরকম কায়দা বের করে। পায়ের ছবি নিয়ে ঠিকমতো অ্যানালিসিস করলে বোঝা যায়। আমি গিয়ে দেখি, কয়েকটা ছাপে গোড়ালিতে চাপ বেশি। তখনই আমার সন্দেহ হয়েছিল। কেউ যদি পিছু হাঁটে তাহলে গোড়ালিতে জোর পড়বে। তোমরাও হেঁটে দেখো। শুধু গোড়ালি ছাপ বেশি নয়, একটা অংশের পর সামনে কোনো ছাপ নেই। তার মানে চোর সঙ্গে কাপড় এনেছিল। পিছু হেঁটেছে আর সামনের দিকের ছাপ মুছতে মুছতে গেছে। কয়েকটা মুছতে পারেনি। সেসব জায়গায় আবার টো–‌এর ছাপ স্পষ্ট। সামনে ঝুঁকে পড়ে পদচিহ্ন মুছতে হয়েছে যে। পুলিশকে রিপোর্টে দিলাম। ওরা কেস হিস্ট্রি ঘাঁটল। নাবু নামে একজন খ্যাতিমান চোরকে পাওয়া গেল, সে নাকি একদা এই কীর্তি করত। নাবু মরে গেছে, পিছু হাঁটবার বিদ্যেটি শিখিয়ে গেছে পুত্রকে। পুলিশ তাকে চাকদা না কোথা থেকে ধরে আনল। কটা চড় থাপ্পড় দিতেই গলগল করে সব বলে দিল।’‌

মুকুর খানিকটা অধীর হয়ে বলল, ‘‌অনুকূলকাকা, আপনি একবার যান। প্লিজ। আপনার এতো বুদ্ধি, ঠিক সত্যিটা জানতে পারবেন।’‌

আরও পড়ুন, দেবেশ রায়ের স্মৃতিকথন মনে পড়ে কী পড়ে না

অনুকূল রায় বললেন, ‘সমস্যা কী জানো ভাইঝি, এসব তদন্তে অনেক সময় ইগো কাজ করে। নিশ্চয় কোনো ফরেনসিক এক্সপার্ট কাজটা দেখছেন। আমি যদি তাকে টপকে কিছু করতে যাই সেটা ভাল দেখায় না। যদিও এরা বেশিরভাগই আমার চেনাজানা। পড়িয়েওছি। কোনো কেসে আটকে গেলে চলে আসে। বলে, স্যার একটু দেখে দিন। তারপরেও নাক গলাতে দু’‌বার ভাবতে হয়। আচ্ছা মুকুর, ওই আর্মি ভদ্রলোকের স্ত্রী আছেন?‌ উনি তো হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন, তাই না?‌’‌

মুকুর বলল, ‘‌এ খবরটা তো জানি না। ‌মনে হয়..‌.‌।’‌

অনুকূল রায় উঠে পড়লেন। বললেন, ‘‌ঠিক আছে তোমরা যখন বলছো একবার চেষ্টা করেই দেখা যাক। একজনকে ফোন করি।’‌
মুকুররা সেদিন চলে যাওয়ার পর তাদের ‘‌অনুকূলকাকা’‌ যে গোয়েন্দা অফিসার বসন্ত সাহাকে ফোন করেছিলেন একথা মুকুর জানতেও পারেনি। জানলেও কিছু হত না। কারণ, তখন বসন্ত সাহাকে মুকর চিনত না। তবে কাজেরক সূত্রে বসন্ত সাহা আর অনুকূলবাবুর পরিচয় পুরোনো।

‘‌কোনো চিন্তা করবেন না, আমি থানাকে বলে দিচ্ছি। ওরা সবরকম কোআপারেট করবে। আপনার মতো একজন এক্সপার্ট পুলিশকে সাহায্য করতে চাইছেন, এতো আমাদের সৌভাগ্য।’‌

বসন্ত সাহা গোয়েন্দা বিভাগের বড় অফিসার। কলকাতা তো বটেই, রাজ্যেরও সব থানা তাকে মান্য করে। তিনি সেদিনই বলে দিলেন, প্রাক্তণ সেনা অফিসারের মৃত্যু তদন্তে ফরেনসিক এক্সপার্ট প্রফেসর অনুকূল রায়কে সবরকম সাহায্য করতে হবে।
মুকুরের ‘‌অলুকূলকাকা’‌ এমন তদন্ত করলেন যে কারেন্ট গোপাল দশদিনের মধ্যে একবারে বেকসুর খালাস হয়ে গেল। মেজর সুনীল চৌবের মৃত্যু রহস্যও জানা গেল। ভদ্রলোক সুইসাইড করেছিলেন।

মালশ্রীর বাড়িতে এক বর্ষার সন্ধ্যেতে বসে অনুকূল রায় সবটা গুছিয়ে বলেছিলেন।
‘কেস সহজ। একটা ভুল জটিল করে দিয়েছিল।’‌
মুকুর বলেছিল, ‘‌ভুল! কী ভুল অনুকূলকাকা?‌‌’‌

অনুকূল রায় বললেন, ‘আমি আসামীর সঙ্গে কথা বলি। পুলিশের এভিডেন্স দেখি। সেই ফ্ল্যাটেও যাই। মেজরের ছেলে এসেছে। সে জানায় তার মা মারা গেছেন। তারপর আমি নার্সিংহোমে খবর নিই। ঠিকই, ভদ্রমহিলা মার গেছেন। রেজিস্টার দেখি। মৃত্যর সময় ঘটনার দিন সকালে। নার্সিংহোম থেকে আমাকে জানানো হয়, মৃত্যর দশ মিনিটের মধ্যে সুনীল চৌবেকে জানানো হয়েছে। থানায় গিয়ে মোবাইলটা দেখতে চাই। কথাটা ঠিক শেষ ফোন এসেছিল নার্সিহোম থেকেই। হিসেব মতো গোপাল ওই বাড়িতে ঢোকবার আগে। এই সময়টা পাওয়া গেছে, গোপাল আগে যে দুটো বাড়িতে কাজ করেছিল, তাদের কাছ থেকে। শুধু তাদের কাছ থেকে পুলিশকে আমি বলি, গোপালের মোবাইলে ফোনের জিপিএস রেকর্ড থেকে জানুন সকালের ওই সময়টাতে সে কোথায় ছিল। তাতে দেখা যায়, সে মেজরের পাড়ায় ঢুকেছে, নার্সিহোম থেকে ফোন যাওয়ার মিনিট কুড়ি বাদে। এবার আমার সন্দেহ হয়। কুড়ি মিনিট ধরে সুলীল চৌবে কী করছিলেন?‌ স্ত্রীর মৃত্যুর খবর পেয়ে তোয়ালে কঁাধে ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন?‌ অসম্ভব। এরপর আমি পিস্তলের ফরেনসিক রিপোর্টে খতিয়ে দেখি। দেখি, পিস্তলের বঁাটের কাছে তোমাদের হাতের ছাপ থাকলেও ট্রিগারে আঙুলের ছাপ অচেনা। আমি ফ্ল্যাট থেকে সেই ছাপ সংগ্রহ করি। ছাপ আর কারও নয়, সুনীল চৌবের নিজের। এরপর গোটা ঘ
টনা চোখের সামনে একেবারে স্পষ্ট হয়ে ওঠে।  স্ত্রীর মৃত্যুর খবর পাওয়ার কয়েক মুহূর্তের মধ্যে নিজের পিস্তল বের করে ভদ্রলোক সুইসাইড করেন। এমন অজস্র এক্সাম্পেল রয়েছে।’‌

মুকুর বলল,‘‌বাপ্‌রে আপনি ধরে ফেললেন!‌’‌

অনুকূল রায় হেসে বললেন, ‘‌ওই যে হাতের ছাপ অব্যর্থ প্রমাণ। আর ভুলটা করেছিল গোপাল। সে মৃতদেহের পাশ থেকে সব সরিয়ে ফেলেছিল। তোয়ালের ভিতর যে পিস্তলটা ছিল সে বুঝতেও পারেনি। অস্ত্রটা ডেডবডির থেকে দূরে সরে যাওয়ার ফলে সুইসাইডের কথা কারও মাথাতেও আসেনি।  ও আরও একটা ভুল করেছিল গোপাল। সে ভয় পেয়ে পালিয়েছিল।’‌

সেদিন মুকুর উঠে গিয়ে অনুকূল রায়কে প্রণাম করেছিল।
সেই অনুকূল রায়ের এবং তার স্ত্রী কাঁকনকাকিমার সঙ্গে সম্পর্ক ঘন হয়। তাদেরও নেমন্তন্ন করেছে মুকুর। কাকিমাকে ফোন করতে বললেন, ‘হাঁটুর ব্যথাটা একটু গোলমাল করছে, নইলে যাবই যাব।’‌

মুকুর বলল, ‘‌অনুকূলকাকা কোথায়?‌’‌
কাঁকনকাকিমা বললেন, ‘‌সে তো কাজে গেছে। পুলিশ নিয়ে গেছে। বলল, কে বিষ খেয়ে মরেছে, সেখানে গিয়ে নাকি গন্ধ শঁুকতে হবে।’‌

মুকুর বলল, ‘‌গন্ধ! গন্ধ কীসের?‌‌’‌
কাঁকনকাকিমা হেসে বলল, ‘‌সে তো বাপু জানিনা। তুমি পরে জেনে নিও।’
———————‌
প্রচেত গুপ্তের অনাবৃত উপন্যাসের সবকটি পূর্ব প্রকাশিত পর্ব পাবেন এই লিংকে

Anabrito
Advertisment