Advertisment

অনাবৃত ২৬: পার্টি কেন ভেস্তে গেল?‌ কার ফোন এল ছন্দার মোবাইলে?‌

পুলিশ ডিপার্টমেন্টের এই তুখোড় গোয়েন্দা অফিসারের মাথায় রক্ত, হত্যা, রিভলভার ছাড়াও নানা ধরনের সাবজেক্ট ভর করে। তখন সেই বিষয়ের ওপর তিনি একেবারে হমড়ি খেয়ে পড়েন। - প্রকাশিত হল প্রচেত গুপ্তের গোয়েন্দা উপন্যাসের ২৬ নং পর্ব।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
Pracheta Gupta, Anabrito

অলংকরণ- অরিত্র দে

বইয়ের নাম ‘‌দ্য ন্যুড ইন ক্যানভাস।’‌

Advertisment

বিলেতের খুব বিখ্যাত এক প্রকাশকের বই। তবে চেহারায় বড় নয়, পেপার ব্যাক। বিশ্বের বিখ্যাত শিল্পীদের ন্যুড স্টাডি নিয়ে আলোচনা। এই ধরনের ছবি কীভাবে দেখতে হয়, বুঝতে হয় সহজ ভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। সেই অর্থে এই বই ‘‌বিগিনারস্‌‌’দের জন্য। শিল্প রসিক তৈরি করবার প্রথম ধাপ। যারা সবে এই বিষয়ে চর্চা শুরু করেছে তারা পড়ে অনায়াসে বুঝতে পারবে।

বসন্ত সাহা ক্যাটলগ দেখে অ্যামাজন থেকে এই বই আনিয়েছেন।‌ পুলিশ ডিপার্টমেন্টের এই তুখোড় গোয়েন্দা অফিসারের মাথায় রক্ত, হত্যা, রিভলভার ছাড়াও নানা ধরনের সাবজেক্ট ভর করে। তখন সেই বিষয়ের ওপর তিনি একেবারে হমড়ি খেয়ে পড়েন। কিছুদিন আগে ক্লাসিকাল সঙ্গীত নিয়ে লেখাপড়া শুরু করেছিলেন, এখন মেতেছেন শিল্পকলা নিয়ে। এই সাবজেক্টে বই, ম্যাগাজিন আনাচ্ছেন। এই শখ কিছুদিন হল হয়েছে। প্রাচীন মিশরের চিত্রকলা নিয়ে একটা প্রবন্ধ পড়তে গিয়ে এই উৎসাহ তৈরি হয়। নব্য আসিরীয় সাম্রাজ্যের রাজা দ্বিতীয় আশুরনাসির পাল ছিলেন একজন শিল্পরসিক মানুষ। যদিও সে সময়ে শিল্প নিয়ে ভাবনা চিন্তা করবার কথা ভাবাই যেত না। এটা ছিল ৮৮৩ সাল থেকে ৮৫৯ খিস্ট্রপূর্বাব্দ। কত প্রাচীন তা অনুমানেরও বাইরে। লন্ডনের ব্রিটিশ মিউজিয়ামে এই রাজার একটি গ্লেজড টেরাকোটার মূর্তি পাওয়া যায়। ছবির মতো। সুমেরু সভ্যতার শিল্পকলা একটি ঘটনা। ছবির বিচারে এর বিন্যাস চমকিত করে। এই প্রবন্ধটি পড়ে গোয়েন্দা অফিসার প্রথম শিল্পকলা বিষয়ে পড়াশোনার প্রতি আকর্ষণ বোধ করেন। এর আগে আকাদেমি বা অন্যান্য গ্যালারিতে কিছু আর্ট একজিবিশন তিনি দেখেছেন, কিন্তু লেখাপড়ার টান অনুভব করেননি। একেই বোধহয় বলা হয়, প্র‌্যাকটিস থেকে থিওরি। বসন্ত সাহার পড়া শুরু হয়। এক এক করে নিও–‌ক্লাসিসিজম, ইম্প্রেশনিজম, কিউবিজম্‌, পোস্ট মর্ডানিজম্‌ নিয়ে বই ও লেখাপত্তর পড়ে ফলেন। এসবই বিভিন্ন ধরনের আর্টফর্ম। কিছুদিন হল ‘‌শিল্পে নগ্নতা’‌র ওপর এই বইটা নিয়ে পড়েছেন। বইতে লেখাটা যেন একেবারে নতুনদের ক্লাস নেওয়ার ভঙ্গি!‌

আরও পড়ুন, দেবেশ রায়ের স্মৃতিকথন মনে পড়ে কী পড়ে না

বসন্ত সাহা, যিনি পুলিশ মহলে ‘‌বি ‌সাহা’‌ নামে পরিচিত তিনি এই সকালে বসে আছেন তাঁর ফ্ল্যাটের বারান্দায়। এখানে বসে তিনি ভোরের চা খান। শীত গ্রীষ্ম, বর্ষা বাদ যায় না। দু’‌কাপ চা চাই। এক কাপ খাওয়া হয়ে গেছে। দ্বিতীয় কাপ নিয়ে স্ত্রী কখন এসে পিছনে দাঁড়িয়েছে, তিনি বুঝতেও পারেননি। কাল সন্ধের পর থেকে অনেক ঝামেলা গিয়েছে। একটা পার্টিতে গিয়েছিলেন সেখানে একটা বিশ্রী কাণ্ড হয়েছে। পার্টিটা ছিল বেশ ইন্টারেস্টিং। এক পারিবারিক বন্ধু পরিবারের ফ্ল্যাটের জন্মদিন। বর্ষপূর্তি। বসন্ত সাহা পার্টি অ্যাভয়েড করেন। একেই তো পুলিশের উচ্চপদে কাজ করেন বলে সদা সর্তক থাকতে হয়, তার ওপর আজকালকার পার্টির মূল আকর্ষণ যে মদ্যপান, তাতে ভদ্রলোকের কোন আসক্তি নেই। তিনি মদ খান না। ফলে পার্টিতে যাওয়ার তেমন কোনও তাগিদ অনুভব করেন না। অফিসিয়াল যেসব পার্টিতে না গেলে নয় সেটুকুই। কিন্ত কালকের পার্টিটা ছিল পরিচিতজনের। হোস্ট ছিল পরিবারের কর্ত্রী। বয়স বেশি নয় মেয়েটির, স্কুল শিক্ষিকা। মেয়েটি প্রাণবন্ত কিন্তু সংযত, শিক্ষিত। বসন্ত সাহা পছন্দ করেন। সেই কারণেই যাওয়া। তবে গিয়ে যে এরকম মারাত্মক ঘটনা ঘটবে কে জানত?‌ অ্যাম্বুলেন্স ডেকে, নার্সিং হোমে পাঠিয়ে কোনও রকমে সামাল দেওয়া হয়েছে। পার্টি যদিও ভেস্তে যায়।

বাড়িতে দেরিতে ফিরে ঘুমও হয়েছে দেরিতে। বসন্ত সাহা এবং তার স্ত্রীর অভ্যেস হল, রাত করে ঘুমোলেও ভোরে ঘুম ভাঙবে। মেয়ের স্কুলের জন্য তার মাকে তো উঠতেই হয়। তারও স্কুলে যাওয়ার আছে। টিচারদের লেট করবার উপায় নেই। পুলিশ অফিসারের বউ হলে তো আরও নেই। কলিগরা বলবে, ক্ষমতা আছে বলে সুবিধে নিচ্ছে।

বসন্ত সাহা ভেবেছিলেন, বিছানায় আর একটু গড়াবেন। পারলেন না। কেমন যেন অস্বস্তি হচ্ছিল। উঠে পড়েছেন। মু্খ টুখ ধুয়ে ‘‌দ্য ন্যুড ইন ক্যানভাস’‌  নিয়ে বসেছেন। কালকের ঘটনা থেকেও মনটাকে সরাতে চান।

গোয়েন্দা ডুব দিয়েছেন, শিল্পী রেনোয়ার ছবির মধ্যে।

বইয়ের ঝরঝরে ইংরেজি বাংলা করলে অনেকটা এরকম হয়—
‘‌‘‌পাঠক, আমরা এখন যে শিল্পীর ছবি নিয়ে আলোচনা করব তাঁর নাম রেনোয়া (‌১৮৪১–‌১৯১৯)‌। বাঁ দিকের পাতায় যে ছবিটি আপনি দেখছেন তার নাম ‘‌দ্য বাথার্স’‌। এই ছবিটি ‘‌অতি বিখ্যাত’‌ বললেও কম বলা হয়। শ্রেষ্ঠ ছবির একটি। বিশ্বের তাবড় শিল্পরসিকরা এটি নিয়ে আলোচনা করেছেন। তিন বছর ধরে আঁকা। ছবিতে আপনি দেখছেন, স্নানরতা চার অপরূপ সুন্দরীকে। সকলেই নগ্ন। কিন্তু সেই নগ্নতায় কোনওরকম কামত্তোজনার প্রকাশ নেই। আছে সৌন্দর্য। ছবিটিতে রয়েছে জঙ্গল এবং পাশে নদী। নগ্নিকারা কেউ দাঁড়িয়ে, কেউ পাথরে বসে। আলতো, উদাসীন, অলস ভঙ্গি। কেউ কথা বলছে, কেউ শুনছে অবহেলায়, কেউ কৌতূহল নিয়ে তাকিয়ে। একজন একটু দূরে হাঁটু জলে দাঁড়িয়ে প্রসাধনে ব্যস্ত। আড়াল থেকে তাদের কেউ দেখছে কিনা সে বিষয়ে ভ্রুক্ষেপ নেই। জলের ধারে আসা হরিণের মতো এরা সুন্দর কিন্তু সচকিত নয়। লজ্জার দায় নেই। ‘‌দ্য বাথার্স’‌ ক্লাসিকাল ন্যুড স্টাডির এক অমূল্য আখ্যান। আপনি যখন ছবিটির দিকে তাকান, তিন রমণীর কথা, ফিসফিসানি, হাসি শুনতে পান। সেই কূজন তাদের  গ্রীবা, স্তন, কটিদেশ, জানুর মতোই পরিশীলিত। রেনোয়ার কাজ অন্যরকম। খানিকটা স্ট্রাকচারাল, খানিকটা বিমূর্ত। মনে রাখতে হবে, এই ছবি ভাস্কর্যের থ্রি ডাইমেনশন গঠনকে মাথায় রেখে আঁকা হয়েছে। শিল্পীদের মধ্যে একসময় স্বাভাবিকতাবাদ ছিল একটি ধারা। রেনোয়া সেই ধারা থেকে সরলেন। প্রেক্ষাপটের স্বাভাবিক অংশটি এখানে হল গৌণ। জঙ্গল, নদী, পাথর নয়, নারীর অনাবৃত শরীর এখানে প্রাধান্য পেয়েছে। শুধু শরীর নয়, এই চার রূপবতী অনায়াসে তাদের মনের আবরণ সরিয়ে রেখেছে।’‌’‌

পড়ুন সন্মাত্রানন্দের ধূলামাটির বাউল

‘‌বইটা একটু বন্ধ করবে?‌’‌
বসন্ত সাহা বই বন্ধ করতে বললেন, ‘‌অবশ্যই করব।’‌

ছন্দা চায়ের কাপ বাড়িয়ে স্বামীর উলটো দিকের চেয়ারে বসলেন। সামনের বেতের টেবিলে ছবি বিষয়ক বিভিন্ন বই আর ম্যাগাজিন ছড়ানো।

বসন্ত সাহা চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বললেন, ‘‌মন খারাপ?‌’‌
ছন্দা চুপ করে র‌ইলেন। বসন্ত সাহা বললেন, ‘‌আমারও খারাপ লাগছে। এমন একটা ঘটনা ঘটবে ভাবতেও পারিনি।’‌
ছন্দা বলল, ‘কাল রাতে ‌মুকুর খুব কান্নাকাটি করছিল।’‌
বসন্ত সাহা দূরের আকাশের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘‌করবারই কথা। শখ করে অমন চমৎকার একটা গেট টুগেদারের আয়োজন করেছিল সেখানে যদি এরকম একটা ইনসিডেন্ট হয়ে যায় সেটা তো মন খারাপই করে।’‌
ছন্দা বলল,‌ ‘‌মুকুর তো বলছিল, সব দোষ ওর।’‌
বসন্ত বললেন, ‘‌এতে ওর দোষের কী হয়েছে?‌ কোনও কারণে খাবারে বিষাক্ত কিছু পড়েছিল। ‌ফুড পয়জন তো হতেই পারে। অনেক সময়েই তো এরকম ঘটে। টিকটিকি বা ওই জাতীয় কিছু পড়ে যায়.‌.‌.‌।’
ছন্দা দুঃখিত গলায় বলল, ‘ফুড পয়জনিং তো কম হয়নি, একেবারে নার্সিং হোম পর্যন্ত ছুটতে হল, শুরুতেই পার্টিটা ভেস্তে গেল।’‌
বসন্ত সাহা বললেন,‌ ‘‌একজন যদি ওভাবে বমি করতে করতে কাতরাতে থাকে, পার্টি তো বন্ধ করতেই হবে। আর যে সে তো নয়, একেবারে হোস্ট। গৃহকর্তা। সুনন্দ আছে কেমন?‌ খবর নিয়েছো?‌’‌

ছন্দা বলল, ‘‌এত সকালে খোঁজ কী নেব?‌ সবে তো সাড়ে ছ’‌টা বাজে। মুকুর নিশ্চয় কাল সারারাত জেগেছে। স্বামীর কাছে নার্সিং হোমে ছিল হয়তো।’‌

বসন্ত বললেন,‌ ‘তা হবে। ফুড পয়েজনিং হলে তো বেশি কিছু হবে না।  সুনন্দ নিশ্চয় আজকের মধ্যে অনেকটা রিকভার করবে। তুমি খানিকক্ষণ পরেই না হয় মুকুরকে ফোন করো।’‌

ছন্দা একটু অন্যমনস্ক ভাবে বলল, ‘‌জানো, মুকুর বলছিল, ওদের যে কেটারার কাজটা করছিল সে কোনও গোলমাল করেছে.‌.‌.‌’‌
বসন্ত সাহা মুখ স্ত্রীর দিকে মুখ ফিরিয়ে বললেন, ‘‌মানে!‌’

‘‌মানে আমি বলতে পারব না। লোকটার সঙ্গে নাকি সুনন্দর কী গোলমাল হয়েছিল। লোকটা নাকি টাকাপয়সা কী সব সুনন্দর কাছে ধার চেয়েছিল। সুনন্দ দেয়নি বলে.‌.‌.‌ মুকুর বলছিল, ওই কেটারার নাকি পার্টি ভেস্তে দিতে খাবারে কিছু গোলমাল করছে।’

‌বসন্ত সাহা বললেন,‘ছাড়ো তো এসব কথা। এই কারণে কেউ নিজের পায়ে কুড়ুল মারে?‌ ব্যবসা চৌপাট করে দেয়?‌ বাঙালির দোষ চাপানো আর সন্দেহ হল দুটো অসুখ। আমি আমার কর্মজীবনে যে কত দেখেছি। সবাই সবাইকে সন্দেহ করে।’‌

ছন্দা বললেন, ‘‌কী জানি। তবে আমারও মনে হয় এটা মুকুর ঠিক বলছে না। এই ঘটনার সঙ্গে কেটারের কতটা ‌সম্পর্ক?‌ আমার যেতেই তো সবাইকে স্টাটার সার্ভ করা হল। কাবাব আর চিজ বল।’‌

‌বসন্ত সাহা বললেন, ‘‌সে তো আমরা সবাই খেয়েছি। কই আর কেউ তো অসুস্থ হয়ে পড়িনি।’‌
ছন্দা বললেন, ‘‌ঠিক বলেছো। সুনন্দ অসুস্থ হল আর একটু পরে। ওই মেয়েটা, কী যেন নাম?‌ মুকুরের কলেজের বান্ধবী সে–‌ই তো কেক কেটে বিলি করল।’‌

বসন্ত সাহা ভুরু কুঁচকে বললেন, ‘কেক তো আমিও খেলাম.‌.‌.‌ তুমিও খাওনি?‌’‌
ছন্দা বললেন, ‘‌খেয়েছি এবং ঠিকই তো আছি।’‌

বসন্ত সাহা বললেন, ‘এই কারণেই তো বলছি, ওখানকার খাবার টাবার নয়, সুনন্দ বাইরে থেকে কিছু খেয়েছিল।’‌

ঘরের ভিততে ছন্দা সাহার মোবাইল বেজে উঠল ঝন্‌ঝন্‌ করে। ছন্দা উঠে গিয়ে ফোন ধরল। মুহূর্তখানেক পরে আর্তনাদ করে উঠল।

‘‌সেকী!‌ তুমি এসব কী বলছ মুকুর!‌’

বসন্ত সাহা চেয়ার ছেড়ে উঠে পড়লেন।
‌————‌

এই ধারাবাহিকের সব পর্ব একসঙ্গে পড়তে ক্লিক করুন এই লিংকে
Anabrito
Advertisment