নিজের বাড়িতে স্নান সেরে আয়নার সামনে এসে যেমন একবার দাঁড়ায়, হোটেলের এই ঘরেও হৈমন্তী এখন আয়নার সামনে।
তার গায়ে নীল রঙের তোয়ালে। একা ঘরে গায়ে তোয়ালে জড়িয়ে থাকবার মেয়ে হৈমন্তী নয়। তারপরেও সে জড়িয়েছে। তার কারণ তোয়ালের রঙ। হোটেলের এই তোয়ালে নীল। গাঢ় নীল। খুব জোরে বৃষ্টির আগে যেমন মেঘ কালো হয়, তেমন বৃষ্টি ঝরে গেলে হয় ঘন নীল। একবারে সেই বালিকাবেলা থেকে নীল রঙ হৈমন্তীর পছন্দের। ড্রইং করতে বসলেই আগে নীল রঙ বের করে ফেলত। তখন আর আকাশ বা জল ছাড়া অন্য কিছু আঁকবার উপায় থাকত না। এখন যেমন তার মনে হচ্ছে, খানিকটা মেঘ গায়ে জড়িয়ে আছে।
ঐন্দ্রিলের সঙ্গে একবার পাহাড়ে গিয়েছিল। দার্জিলিঙের কাছে ঝাণ্ডিতে।
‘হিমি, আমার সঙ্গে স্পট দেখতে যাবে?’
হৈমন্তী বলেছিল, ‘স্পট! কীসের স্পট?’
ঐন্দ্রিল বলেছিল, ‘আমার সিনেমার স্পট। রেইকি করব। রেইকি জান? রেইকি হল আগে থেকে শুটিঙের জায়গা দেখা।’
হৈমন্তী উত্তেজিত হয়ে বলল, ‘কোথায় যাবে?’
ঐন্দ্রিল সিগারেটে লম্বা টান দিয়ে বলেছিল, ‘আমার ছবি গল্প জানো? ’
হৈমন্তী বলেছিল, ‘জানব কী করে? তুমি বলেছ কখনও?’
কফি হাউসের মজা হচ্ছে, অনেকে এক সঙ্গে কথা বললেও সামনে বসা লোকের কথা শুনতে অসুবিধে হয় না। বরং অন্যদের কথা কানে ঢোকে না। একটা গমগমে হাউলিং সর্বক্ষণ হচ্ছে বটে, কিন্তু তাতে কারও অসুবিধে হচ্ছে না। মাঝেমধ্যে মনে হয়, ঘরটা বানানোর সময় নিশ্চয় কোনও সাউণ্ড ইঞ্জিনিয়রের সঙ্গে কথা বলে নেওয়া হয়েছিল।
‘দেখবেন স্যার, আমার কথা বলতে যেন অসুবিধে না হয়।’
সেদিন হৈমন্তী আর ঐন্দ্রিল কফি হাউসে বসেছিল। ঐন্দ্রিল মুখে একধরনের ভাবুক ভাব এনে বলেছিল, ‘আমার ছবির গল্প পুরোটাই পাহাড়ের কোনও গ্রামে। বলতে পার টোটাল আউটডোর। ইনডোরের কারবার থাকবে না। সিনেমা আউটোরই ডিমান্ড করে। এমন একটা গ্রাম ভেবেছি যেটা বেশিরভাগ সময়েই কুয়াশায় ঢেকে থাকে। সবাই কেমম আবছা, রহস্যময়। গল্পের নায়ক–নায়িকা সেখানে যাবে। আলাদা আলাদা ভাবে যাবে। একজন চা বাগানের অডিটের কাজে, একজন বোটানির এক্সকারসনে। গাছ পাতা খোঁজে। মেয়েটি এক বিকেলে কুয়াশার পাহাড়ে পথ হারাবে। চারপাশে ঘন জঙ্গল, চা বাগান। জিপ নিয়ে ফিরছিল নায়ক। নায়িকাকে দেখে গাড়ি থামায়। তাদের আলাপ হয়। সেই আলাপ কয়েকদিনের মধ্যে প্রেমে পৌছোয়।’
হৈমন্তী বলেছিল, ‘এতো তাড়াতাড়ি প্রেম! এ তো হিন্দি সিনেমায় হয়।’
ঐন্দ্রিল বিরক্ত হয়ে বলে, ‘উফ্ যা বোঝ না তা নিয়ে এধরনের কমেন্ট কোর না।’
হৈমন্তী বলল, ‘সরি। গল্পটা শেষ কর।’
ঐন্দ্রিল বলল, ‘এটা একটা মার্ডারের গল্প। মন দিয়ে শোন। কদিন পর তারা কুয়াশা ঢাকা জঙ্গলে শরীরে মিলিত হয়। ঝরে পড়া পাতা হয় তাদের মিলনের শয্যা, কুয়াশা হয় নগ্ন শরীরের আবরণ। রতি শেষে মেয়েটি জানায়, ছেলেটিকে সে বিয়ে করতে পারছে না। তার বিয়ের সব কথা পাকা হয়ে আছে। পাত্র বিদেশের পড়ায়। কলকাতায় ফিরে সে বিয়ে করে চলে যাবে। বাইরে গবেষণা করবে। ছেলেটি মেয়েটিকে গুডবাই ডিনারে আমন্ত্রণ জানায়। সংগ্রহ করে এক কঠিন বিষ। নাম জাডু। তিব্বতি এই বিষ জাডু নামের এক পাহাড়ি বনস্পতির বাকল থেকে তৈরি হয়। যে গাছ বছরের পর বছর রোদ পায় না। কুয়াশা মেখে দাঁড়িয়ে থাকে। কুয়াশা বিষকে কড়া হতে সাহায্য করে। ডিনারের সময় ছেলেটি মেয়েটির খাবারে জাডু মেশায়।’
আরও পড়ুন, সন্মাত্রানন্দের সিরিজ ধুলামাটির বাউলের প্রকাশিত পর্বগুলি
হৈমন্তী বলে, ‘সেকী! মেয়েটাকে মেরে ফেলল!’
ঐন্দ্রিল হেসে বলল, ‘কী করবে? তার ভালবাসা তীব্র। সে চায় না তার প্রেমিকা অন্য কারও সঙ্গে মিলিত হোক। কুয়াশার মতো সে–ই শুধু ঘিরে রাখতে চায়।’
হৈমন্তী নাক কুঁচকে বলেছিল, ‘এটা কেমন গল্প? দর্শকরা এসব খুনোখুনি পছন্দ করবে?’
ঐন্দ্রিল আবার সিগারেট ধরিয়ে বলেছিল, ‘আমি দর্শকদের জন্য সিনেমা বানাব না হিমি। সিনেমা বানাব, ফেস্টিভালের জন্য। আমার নায়ক কুয়াশা মাখা বিষ দিয়ে প্রেমিকাকে খুন করবার পর কুয়াশায় মিলিয়ে যাবে। ছবির নাম দ্য মিস্ট।’
শেষ পর্যন্ত পাহাড়ে কুয়াশা দেখতে ঝাণ্ডিতে গিয়েছিল দুজনে। খরচ ঐন্দ্রিল ধার হিসেবে হৈমন্তীর কাছ থেকে নিয়েছিল।
‘চিন্তা কোর না। প্রোডিউসার টাকা দিলেই ফিরিয়ে দেব।’
হৈমন্তী চিন্তা করেনি। দুটো দিন কু্য়াশা আর মেঘ মেখে সব ভুলে গিয়েছিল। টাকাপয়সা তো কোন ছাড়।
তোয়ালেটা বুকের ওপর আলতো করে পেঁচিয়ে নিয়েছে হৈমন্তী। বুক থেকে কোমরের সামান্য নীচ পর্যন্ত ছাড়া শরীরের সবটাই অনাবৃত। ঘাড়ে, কাঁধে, উরুতে জলের গুঁড়ো। তাকে স্নিগ্ধ দেখাচ্ছে। মেয়েদের সাধারণত স্নানের পর স্নিগ্ধই দেখায়। হৈমন্তীকে যেন বেশি দেখাচ্ছে। কে বলবে এই সুন্দরী এক গভীর যড়যন্ত্রে মেতেছে?
হৈমন্তীর হাতে ড্রায়ার। চুল শুকোচ্ছে। সেই পর্ব মিটলে উঠে পড়ল। ট্রলি ব্যাগ টেনে টুকটাক কিছু জিনিসপত্র বের করে টেবিলে রাখল। কিছু কসমেটিকস্, কটা ঘরে পরবার জামা পায়জামা, মোবাইল ফোনের চার্জার। তারপর একটা কাপড়ের ভঁাজ থেকে বের করল একটা বাক্স। মাঝারি মাপের বাক্স। এই জিনিসটার জন্যই তাকে এত বড় একটা ব্যাগ এনে প্লেনের লাগেজে তুলতে হয়েছে।
মোবাইল বাজছে। ঝুঁকে পড়ে নম্বার দেখল হৈমন্তী।
‘মাই ডিয়ার, তোমার ফোনের জন্যই অপেক্ষা করছি।’
ওপাশ থেকে মুকুর উচ্ছ্বসিত গলায় বলল, ‘সবাইকে এক এক করে জেন্টল রিমাইন্ডার পাঠাচ্ছি। কাউকে ফোনে, কাউকে মেসেজে। তোর নাম একেবারে শেষে রেখেছিলাম।’
আরও পড়ুন, দেবেশ রায়ের স্মৃতিকথন মনে পড়ে কী পড়ে না
হৈমন্তী বলল, ‘শেষে! তার মানে? কীসের শেষে? ফ্ল্যাটের নাম দিলাম আমি, আর আমার নামই একেবারে শেষে?’
মুকুর হেসে বলল, ‘আরে বাবা, শেষে মানে লিস্টে লাস্ট নাম। কলকাতায় এসেছিস?’
হৈমন্তী বলল, ‘কলকাতায় যাব না।’
মুকুর আঁতকে উঠে বলল, ‘মানে, আমার ফ্ল্যাটের পার্টিতে তুই আসবি না!’
হৈমন্তী বলল, ‘ভাবছি। যার নাম দিয়েছি দ্য ড্রিম, তার কাছে গেলে যদি ড্রিম ভেঙে যায়? ভয় করছে।’
মুকুর বলল, ‘ফাজলামি রাখ। কোন ফ্লাইটে কলকাতায় আসছিস বল।’
হৈমন্তী বলল, ‘কী হবে গিয়ে? পার্টিতে ইন্টারেস্টিং কেউ তো আসছে না। হ্যান্ডসাম কোনও পুরুষ মানুষ? যার গায়ে ঢলে পড়লে এক্সাইটমেন্ট হবে।’
মুকুর বলল, ‘বাবা, তোর হল কী হৈমি! গায়ে ঢলে পড়বার জন্য একেবারে পুরুষ মানুষ খুঁজছিস যে বড়? আমার হাজব্যান্ড তো থাকবে। হি ইজ স্মার্ট এনাফ।’
হৈমন্তী বলল, ‘সুনন্দ দেখতে ভাল, তবে বড্ড বউ নেকু।’
‘বউ নেকু! সে আবার কী!’
হৈমন্তী বলল, ‘মানে জানি না। তবে দেখলে মনে হয়, বউয়ের জন্য গদগদ।’
মুকুর বলল, ‘তুই ওকে কোথা থেকে দেখলি।’
হৈমন্তী সহজ ভাবে বলল, ‘কোথায় আবার ? তোর ফেসবুকে। কখনও কোমর জড়িয়ে, কখনও হাত ধরে, কখনও কাঁধে মাথা রেখে তোরা কম আদিখ্যেতা করিস না। শুধু বেডরুমের ছবি বাদ দিয়ে সবই তো পোস্ট করেছিস। নানা, ও আমার চলবে না। সুনন্দ ক্যানসেল। পার্টিতে আর কে আসছে বল। পুরুষ মানুষের কথা বলবি।’
মুকুর হেসে বলল, ‘ফটো সবসময়ে সত্যি নাকি? ওসব তো ফর শো-ও হতে পারে।’
হৈমন্তী বলল, ‘ফর শো হোক আর না হোক, আমি ওতে নেই। নতুন কে আসছে বল, একটা স্লিট যা বেছে রেখেছি না দেখলে তোর মাথাও ঘুরে যাবে। একবারে কোমর পর্যন্ত চেরা। আর একটু ওপরও হতে পারে। সাদার ওপর ব্ল্যাক স্ট্র্যাপ, ওপরে কালো টপ। সেই কারণেই পুরুষমানুষের খোঁজ করছি।’
মুকুর বলল, ‘ছবি দেখেই সুনন্দকে বউ নেওটা বলছিস? আড়ালে কী করে বেড়াচ্ছে কে জানে বাপু। অফিসের কাজ বলে বাইরে বাইরে ঘুরে বেড়ায়, কাকে প্রেমিকা ঠাউরেছে তার ঠিক আছে। তোর পুনেও তো যায়।’
হৈমন্তী বলল, ‘তোর আর চিন্তা কী? তুই তো বলেছিস ইনসিওরেন্স থেকে ব্যাঙ্ক অ্যাকউন্টেসের সব টাকাই নিজের নামে লিখিয়ে রেখেছিস্, বলিস না।’
‘আমি কি তোর মত বুদ্ধিমতী হৈমী ? সুনন্দকে যতই ভালবাসি, নিজেরটুকু সামলে রেখেছি।’
হৈমন্তী বলল, ‘বেশ করেছিস। এবার দ্য ড্রিমের পার্টির লিস্ট বল।’
মুকুর বলল, ‘সব আসবে। সংসারী, অবিবাহিত, ডিভোর্স, লিভ টুগেদার। পুলিশ অফিসারও পাবি। তবে তিনি কি আর তোর গায়ে ঢলে পড়বেন?’
হৈমন্তী বলল, ‘তাহলে তো ইন্টারেস্টিং গ্যাদারিং।’
‘তুই কখন আসছিস? নেমপ্লেট উদ্বোধন করতে হবে না?’
হৈমন্তী বলল, ‘আমি এসে গিয়েছি ডার্লিং। এবার তোমার ফ্ল্যাটের জন্য একটা মস্ত কেকের অর্ডার দিতে বেরোব। ওপরে লেখা থাকবে হ্যাপি বার্থ ডে টু ড্রিম।’
ফোন ছেড়ে উঠে টেবিলে রাখা ছোটবাক্সটা খুলল হৈমন্তী। ঝলমল করে উঠল একসেট রুপোলি ছুরি, কাটা, চামচ। মুকুরের কিচেনের জন্য উপহার। ছুরি থাকার জন্যই ব্যাগটা প্লেনের লাগেজে পাঠাতে হয়েছিল। ছুরি হাতে নিয়ে তুলে দেখল হৈমন্তী। ছুরির হাতলটা বড্ড চমৎকার। সুক্ষ্ম কারুকাজ। ফুল আঁকা। হবে না কেন? বিদেশি জিনিস। দামও নিয়েছে অনেক। সে নিক, কলেজের বন্ধুকে উপহার দিতে গেলে একটু খরচ তো হবেই।
—————
ধারাবাহিক এই গোয়েন্দা উপন্যাসের সব পর্ব পড়ুন এই লিংক