Advertisment

ধুলামাটির বাউল: সন্মাত্রানন্দের জীবনপথ (২)

সন্মাত্রানন্দের জীবনরথ যে সব সড়ক-ঘাট-মাঠ পেরিয়ে চলে এসেছে, তা নিরতিশয় আগ্রহোদ্দীপক। চলার পথের আহরিত অভিজ্ঞতাসমূহের কথা তিনি লিখতে শুরু করেছেন ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলায়।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
Dhula Matir Baul, Sanmatrananda

ছবি- মধুমন্তী চ্যাটার্জি, গ্রাফিক্স- অভিজিত বিশ্বাস

মণিকর্ণিকা ঘাটের পৈঠায় বসে সূর্যাস্ত দেখছিলাম। অস্তসূর্যের আভা গঙ্গার বুকের উপর উদাসীন সন্ন্যাসীর উত্তরীয়ের মতো পড়ে আছে। কাছেই কাশীর মহাশ্মশান। কতো অগণ্য চিতা জ্বলছে যে! কতোজন চলে যাচ্ছেন। কাশীতে মরলেই মুক্তি, মানুষের বিশ্বাস। কী সত্য, তা জানি না। তবে যুগযুগ ধরে মানুষ এমনই মেনে আসছে।

Advertisment

ঘাটের পৈঠার উপর নানা প্রদেশের মানুষ। কেউ পুণ্যার্থী, কেউ ভক্ত, কেউ সাধু, কেউ বা আমার মতো ভবঘুরে। আচ্ছা, ভবঘুরেদের কি মুক্তি হয়? নাকি তারা বারবার পৃথিবীতে ঘুরতে আসে? কয়েকজন বৃদ্ধা বিধবা ঘাটের নীচের দিকের পৈঠায় বসে একমনে সান্ধ্য জপ করে চলেছেন। ঠোঁট নড়ছে। সাদা থান পরনে। হাতে জপের মালা।

এঁরা সব কাশীতে এসে থাকেন শেষ বয়সে। কম ভাড়ার ছোটো ছোটো ঘরে। অনেকেই বাঙালি। কারুর বাড়ি ছিল বাঁকুড়া্য, কারুর মুর্শিদাবাদে, কারুর চব্বিশ-পরগণায়, কারুর বা মেদিনীপুরে। শেষ জীবনটা বাবা বিশ্বনাথের চরণে কাটিয়ে দিতে এসেছেন। বাড়ির কথা মনে পড়ে কখনও কখনও। বাড়ি থেকে বেশি কেউ খোঁজখবর নেয় না। মাঝেমাঝে একটা পোস্টকার্ড। কিংবা অল্প টাকার মানি-অর্ডার। তবু মনে পড়ে। ছোটখোকার মেয়েটার বড্ড ঠান্ডার ধাত। জ্বর বাঁধিয়ে বসেনি তো? বুলুর নাতবৌ কেমন হল? শুনেছি, রাঙা টুকটুকে। স্বভাবচরিত্র কেমন? শান্ত না মুখরা? গৌর চাকরি পেল, নাকি এখনও কাঠ বেকার? আহা! ওর মা-র বড়ো কষ্ট। আর বাঁড়ুজ্জেদের কাঁঠালগাছটায় এবার ফল এসেছে? যা গুড়ের মতো মিষ্টি কাঁঠাল!

আরও পড়ুন, প্রচেত গুপ্তের ধারাবাহিক গোয়েন্দা উপন্যাস অনাবৃত

জপ করতে করতে এসব চিন্তা আসে। আবার মনকে ধমক দেন। কী ভাবছিস কী মন এই শিবপুরীতে এসে? এখনও বিষয়চিন্তা! ছিঃ! তাড়াতাড়ি মালা ঘুরতে থাকে। ঠোঁট নড়তে থাকে। মণিকর্ণিকার ঘাটে চিতা জ্বলতে থাকে।

কদিন হল কাশী এসেছি। আস্তানা গেড়েছি তুলসীঘাটের কাছে। বিশ্বনাথ-অন্নপূর্ণার দর্শন হল। ছত্রে প্রসাদ পাওয়া হল। বীরেশ্বর, তিলভাণ্ডেশ্বর, দুর্গাবাড়ি সবই হল। নৌকায় করে সন্ধ্যাবেলা ঘাটে ঘাটে ঘুরে ঘুরে গঙ্গা-আরতিও দেখা হয়েছে। এখন এসে বসেছি মণিকর্ণিকায়। দিনান্তের প্রণাম।

আচার্য শঙ্করের উপকথাময় জীবনী মনে পড়ছে। ষোলো বছরের তরুণ শঙ্কর। কাশীর ঘাটে বসে বেদান্ত ব্যাখ্যা করেন। ব্রহ্ম সত্য, জগৎ মিথ্যা। যে শক্তিতে এ জগতটা হয়েছে, যার শক্তিতে জগতটা নড়ছে চড়ছে, তাকেও তিনি মানছেন না।

একদিন ভোরবেলায় এই মণিকর্ণিকা ঘাটের একটি গলিপথ ধরে প্রাতঃস্নানে আসছিলেন। ভোরের স্তিমিত অন্ধকার। ধীরে ধীরে আলো আসছে। সেই আচ্ছন্ন আলোর মধ্যে শঙ্কর দেখলেন, গলিপথ জুড়ে এক রমণী মৃত স্বামীর দেহ কোলে করে বিলাপ করছে।

দৃশ্যটি এমন অভিনব কিছুই নয়। কাশীতে এমন হামেশাই দেখা যায়। হয়ত সৎকারের পয়সা নেই। তাই মৃতদেহ কোলে নিয়ে করুণ বিলাপ, যাতে পথচারীদের দৃষ্টি আকৃষ্ট হয়। সহানুভূতির করুণায় সৎকারের উপায় হয়। এ রোরুদ্যমানা রমণীও হয়ত সেই উদ্দেশ্যেই বসে বসে কাঁদছে। তাই বলে গোটা পথ জুড়ে মৃতদেহ রেখে কাঁদতে হবে? শঙ্কর স্পষ্টতই বিরক্ত হলেন। মৃতদেহ ডিঙিয়ে তো আর গঙ্গাস্নানে যেতে পারেন না। শান্ত কিন্তু সুস্পষ্ট ভাষায় রমণীকে সম্বোধন করে বললেন, মা! মৃতদেহটিকে একপাশে সরিয়ে রাখুন।

কান্না থামিয়ে ততোধিক শান্ত স্বরে রমণী বলল, বেশ তো! তুমিই বাবা মৃতদেহটিকে তোমার পথ থেকে সরে যেতে বলো না কেন?

উন্মাদ হয়ে গেছেন, মা? মৃতদেহ কি অন্যের সাহায্য ছাড়া নিজের থেকে সরে যেতে পারে? তাই কখনও হয়?

কেন হবে না, বাবা? তুমিই তো বেদান্ত ব্যাখ্যা করে লোককে বুঝাও যে, শক্তি বিনা এই জগতটা নিজের থেকেই নড়ছে চড়ছে। তাহলে এ মৃতদেহ নিজের থেকে সরে যাবে না কেন?

কথাটি শঙ্করের মর্মমূলে গিয়ে আঘাত করল। মনে হল, সতিই তো! কী অসম্ভব কথা তিনি ব্যাখ্যা করে চলেছেন! এই সমস্ত জগতকে সেই এক শক্তিই তো পরিচালনা করে চলেছে। তিনিই তো জগজ্জননী!

চমকে সম্মুখে তাকিয়ে দেখলেন, সে শবদেহও নেই, সে শোকাতুরা রমণীও নেই। সবই ভোজবাজির মতো উবে গেছে।

আরও পড়ুন, দেবেশ রায়ের স্মৃতিকথন মনে পড়ে কী পড়ে না

আরেকদিন। ওই একই গলিপথ। সেদিন আরেক বিপদ। পথ জুড়ে এক অস্পৃশ্য চণ্ডাল। কাঁধে তার মাংসের ভার। চারিপাশে চারটে ভয়ালদর্শন কুকুর। চণ্ডাল মদ খেয়েছে এবং অশ্রাব্য ভাষায় গালিগালাজের ফোয়ারা ছেটাতে ছেটাতে আসছে। এই অশুচি চণ্ডালের স্পর্শভয়ে সঙ্কুচিত শঙ্কর পথের একপাশে সরে গিয়ে ঘৃণাভরে বলে উঠলেন, দূরমপসর রে চণ্ডাল! ওরে চণ্ডাল, দূরে সরে যা।

চণ্ডাল হা-হা অট্টহাস্য হেসে উঠে মদবিহ্বল লোচন ঘূর্ণিত করে বলল, সরে যেতে তো বলছ, ঠাকুর! তা বলো দেখি, কে কার থেকে সরে যাবে? শরীর, না আত্মা? যদি বল, আমার শরীর তোমার শরীরের থেকে সরে যাক, তাহলে বুঝব বৃথাই তোমার বেদান্তপাঠ। ওই পড়েইছ, অনুভূতি কিছুই হয়নি। শরীর মাত্রেই অপবিত্র। মল-মূত্র-অপবিত্র সব পদার্থের আধার এই শরীর। পিতামাতার শুক্রশোণিতে উৎপন্ন। আমার শরীর যেমন অপবিত্র, তোমার শরীরও তেমনই অপবিত্র। কাজেই শরীর সরে যাওয়ায় কোনো লাভই হবে না। আর যদি বল, আমার আত্মা তোমার আত্মার থেকে সরে যাক, তাহলে বলব—তুমি গণ্ডমূর্খ! আত্মা তো এক, অদ্বিতীয়। তোমার আর আমার কোনো ভেদই নেই। আবার আত্মা তো সর্বব্যাপী! সরে যাবেটা কোথায়? সরে যাবার ফাঁকা জায়গা কই? সব জায়গা জুড়েই তো আত্মা রয়েছে। তুমি বেদান্ত প্রচার করেছ ঠাকুর, বেদান্ত বোঝোনি।

চণ্ডালের এই কথায় শঙ্করের সম্বিৎ ফিরল। মনে হল, তাঁর জ্ঞান অসম্পূর্ণ ছিল। সেই অসম্পূর্ণতা দূর করতেই স্বয়ং বিশ্বনাথ মাতাল চণ্ডালের ছদ্মবেশে এসেছেন। শঙ্কর সেই চণ্ডালের চরণে রাখলেন তাঁর প্রভাতবেলার গুরুপ্রণাম।

আশ্চর্য সব উপকথা! উপকথা নাকি ঘটনা, কে বলবে? সে যাই হোক, এই কাশীতেই এমন অদ্ভুত ঘটনা বা কিংবদন্তী প্রচলিত। মনে মনে ভাবছিলাম, কাশীর নিকটস্থ আরেক তীর্থের কথা। সারনাথ। যেখানে ভগবান বুদ্ধ তাঁর সেই বিখ্যাত ধর্মচক্রপ্রবর্তনসূত্র প্রথম প্রচার করেছিলেন। কেমন হয় কাল ভোরবেলা চলে গেলে? বেশি দূরে তো নয়!

ভবঘুরের যা ভাবা, তাই কাজ। পরেরদিন ভোরবেলা মানুষ সবে যখন ঘুম থেকে উঠছে, সেই ঝুঁঝকো ভোরবেলা গোধূলিয়ার মোড় থেকে একটা অটো ধরলাম। বলল, আধঘণ্টার মধ্যেই সারনাথে পৌঁছে দেবে।

কিছুদূর যাওয়ার পরেই অটোড্রাইভার একটা হিন্দি গান জোরে চালিয়ে দিল। কী তার আওয়াজ! আবার পথের মোড়ে দেখা মিলল এক বেশ্যার। সে সারারাত জেগে থেকে ভোরবেলা পথের পাশে দাঁড়িয়ে আড়মোড়া ভাঙছিল। ড্রাইভার শিস দিয়ে মেয়েটাকে ডেকে এনে আমার পাশে বসিয়ে দিল।

বিকট শব্দে গান হচ্ছে, আর তার সঙ্গে সঙ্গে সেই মেয়ে নাচতে শুরু করল। সে এমন নাচ যে, প্রায় আমার কোলের উপর উঠে পড়ে আর কি! মহা মুশকিল! যাই হোক, কিছুটা যাওয়ার পর মেয়েটি অটো থেকে নেমে গেল। আমিও হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম।

সারনাথ পৌছে মহাবোধিমন্দিরে তথাগতর দর্শন পেলাম। মন্দিরের এক পাশে দেশনারত বুদ্ধের মূর্তি। তাঁর চারিদিকে পাঁচজন ভিক্ষু। কৌণ্ডিন্য, মহানামা, অশ্বজিত, ভদ্র আর বাষ্প। তথাগত যখন উরুবেলায় তপস্যা করছিলেন, এরা পাঁচজনও তাঁরই সঙ্গে তপস্যায় বসেছিলেন। কিন্তু তারপর তথাগত যখন কঠোর তপশ্চর্যা পরিত্যাগ করে মধ্যপন্থা অবলম্বন করলেন, তখন এঁরা সিদ্ধার্থকে বনের মধ্যে একা ফেলে রেখে চলে আসেন।

বোধিলাভের ঠিক পরেই তথাগত এঁদের খোঁজে সারনাথে এলেন। প্রথমে তো এই পাঁচজন তথাগতকে দূর থেকে দেখে উপেক্ষা করবেন স্থির করেছিলেন। কিন্তু তিনি যখন এঁদের সম্মুখে উপস্থিত হলেন, তখন এঁরা দেখলেন, তাঁদের পরিচিত সেই সিদ্ধার্থ আর নেই। এ যেন নতুন মানুষ। জ্ঞানের আলোতে তাঁর মুখ যেন ঝলমল করছে।

তথাগত এই পাঁচজন ভিক্ষুকেই প্রথম উপদেশ দেন। শুনতে শুনতে তাঁদের একজন স্রোতাপন্ন অর্থাৎ অনুভূতির প্রথম সোপানে উন্নীত হলেন। তিনি কৌণ্ডিন্য।

মন্দিরের পেছনদিকে হাঁটতে হাঁটতে ধামেক স্তূপ, ধর্মরাজিকা স্তূপ দেখা হল। তারপর কুমারদেবী-প্রতিষ্ঠিত দ্বাদশ শতাব্দীর এক বৌদ্ধ সঙ্ঘারামের ভগ্নাবশেষ। বেশিরভাগটাই মাটির নীচে। একটা সিঁড়ি এঁকেবেঁকে পাতালে চলে গেছে।

আমি ওই সিঁড়ি দিয়ে নীচে নামতে লাগলাম। সিঁড়িটা যেখানে শেষ হল, সেটা একটা দালান। দালানের চারিপাশে ছোটো ছোটো ঘর। এই কক্ষগুলিতে বৌদ্ধ ভিক্ষুরা থাকতেন। মধ্যে স্তূপগৃহ। এইখানে তাঁরা প্রার্থনা করতেন। তারপর একটা খোলা জায়গা। জায়গাটা উঁচু হওয়ায় আবার মাটির উপরে চলে এলাম। একটা নিষ্পত্র বৃক্ষ তার আঁকাবাঁকা ডালপালা নিয়ে আকাশের গায়ে চিত্রার্পিত।

হঠাৎ যেন শুনতে পেলাম, পেছনের দালানে বহু মানুষের অস্পষ্ট মিলিত গুঞ্জন। কে যেন বলছে, এত বড় অনাচার! ভিক্ষু সুপ্রতীক শ্রেষ্ঠীকন্যা মেঘবতীকে নিয়ে কাব্যরচনা করেছে?

আরেকজন বলছে, কাব্য বলে কাব্য! প্রণয়কাব্য!! ভিক্ষু হয়ে কবিতা লিখে সে শ্রেষ্ঠীকন্যাকে প্রেম নিবেদন করেছে! এ কী দুর্দৈব!!

সকলের গুঞ্জনকে থামিয়ে দিয়ে এক বৃদ্ধ স্থবিরের কণ্ঠস্বর শোনা গেল, ভিক্ষু সুপ্রতীক! বলো তুমি কী করবে? দোষ স্বীকার করে প্রায়শ্চিত্তস্বরূপ প্রতিমোক্ষ পাঠ করবে, নাকি সঙ্ঘত্যাগ করবে?

এইবার এক তরুণ ভিক্ষুর কণ্ঠস্বর, আমি কোনো অন্যায় করিনি, স্থবির। প্রণয় পাপ নয়। প্রায়শ্চিত্তের প্রশ্নই ওঠে না। আমি সঙ্ঘ ছেড়ে চলে যাচ্ছি।

তারপর সব নীরব। পিছন ফিরে দেখলাম, নাটক থেমে গেছে। কেউ কোত্থাও নেই।  বহু যুগ পূর্বের শূন্য অবসিত সঙ্ঘারামের ধ্বংসাবশেষ।

সারনাথের পেছনে তারের জালি দিয়ে ঘেরা অনেক হরিণ চরতে দেখেছিলাম। তাদের দেখে পাতাশুদ্ধ একটা গাছের ডাল ধরতেই একটি হরিণী নির্ভয়ে আমার হাত থেকে পাতা খেতে লাগল। হরিণীটির চোখদুটি দেখে মনে হল, যেন কতকালের চেনা।

সেই কি তবে আমার মেঘবতী? আমিই কি তবে তার সুপ্রতীক? কত শত বৎসর পূর্বের কথা সেসব...?

বিকেলের ছায়া গাঢ়তর হয় জন্মান্তরের অস্ফুট অন্ধকারের মতো।

-----------

ধুলামাটির বাউল আগের পর্ব পাবেন এই লিংকে

dhula matir baul
Advertisment