শ্রীদুর্গা ফার্মেসি
মুগবসান, মেদিনীপুর পশ্চিম
এখানে খুচরা ও পাইকারি-হারে আয়ুর্বেদিক ঔষধ বিক্রয় করা হয়
কৃষ্ণচূড়ার লাল পাপড়ি-ছড়ানো পিচের রাস্তাটা যেখানে মাটির রাস্তায় এসে মিশেছে, সেইখানে ক্লাবঘরের উল্টোদিকে ছোটো নিরালা একটি দোকান। সাজসজ্জা থেকেই বোঝা যায়, পুরোনো আমলের; পেছনে আয়ুর্বেদিক ওষুধের বয়াম-ভরা কাচের আলমারি রেখে সামনে টুলের ওপর বসে থাকা মানুষটিও বেশ পুরোনো। তা হবে ষাটের উপর বয়স। ফরসা স্থূলাকার শরীর, একমাথা পাকা চুল, কাঠবিড়ালির লেজের মতন বিশাল পাকা গোঁফ, দেখলেই মনে হয় সব সময় যেন হাসছেন। নাম, নিরাপদ ভট্টাচার্য। টেবিলের উপর ঝুঁকে খলনুড়ি দিয়ে সারাদিন গভীর মনোযোগে কীসব যেন চূর্ণ করে চলেছেন।
তিনি শুধু ওষুধ-বিক্রেতাই নন, কবিরাজও। রক্তে শর্করার মাত্রাধিক্য, ব্লাড-রিপোর্ট দেখালাম। এলোপাথাড়ি বহু চিকিৎসা করিয়েছি, ফল তেমন কিছুই পাইনি। কবিরাজ চোখ-জিভ সব দেখলেন। নাড়ি ধরে চোখ বুজে বসে রইলেন কিছুক্ষণ। তারপর সামনের টুলে বসতে বললেন। আমার দিকে তাকিয়ে হেসে বললেন -
"কী করা হয়?"
"এই ছেলেদের পড়াই। কখনও বা কিছুই করি না।"
"থাকেন কোথায়, বাবা?"
"থাকাথাকির ঠিক নেই। আপাতত সমীরদের বাড়িতে আছি।"
"জিভটা আমাকে দিয়ে যান।"
"মানে?"
"মানে, আমার ওষুধ খুব তিতো। খেতে খুবই খারাপ। কিন্তু নিয়মিত সেবন করলে মায়ের কৃপায় অনেকটা ভাল হয়ে যাবেন।"
‘মায়ের কৃপায়’ কথাটা বলে দেওয়ালের দিকে তাকিয়ে প্রণাম করলেন। কুলুঙ্গিতে দেখলাম মা দুর্গার পট। ও, তাহলে ওই জন্যেই নাম ‘দুর্গা ফার্মেসি’!
"এই চন্দ্রপ্রভা-বটিকা দিচ্ছি। খালিপেটে সামান্য মধু দিয়ে মেড়ে খাবেন। আর এই মেদনাশিনী। ভাল করে চিবিয়ে খাবেন খাওয়ার পর। আর এই হচ্ছে..."
এই বলে তিনি আলমারির পাল্লা খুলে খুঁজছেন, পাচ্ছেন না। সামান্য গলা তুলে ডাকলেন, "দুগগা-আ..."
দোকানের ভেতরের দিকের দরোজাটা একটু ফাঁক হল। ফর্সামতো বছর-পঞ্চান্নর এক মহিলা বেরিয়ে এলেন। মেরুন রঙের শাড়ি পরা। মাথার চুল কিছুটা সাদা হয়েছে। মহিলা নিরাপদ কোবরেজের কাছে এসে বললেন, "ডাকছ কেন?"
ও মা! এই মহিলার নামও দুর্গা? তবে কি এঁর নামেই ওষুধের দোকান?
নিরাপদ ভটচাজ বললেন, "যকৃৎসুষমা-র বোতলটা কোথায় রাখলে দুগগা, পাচ্ছি না তো!"
"ওই তো বাঁ-দিকের আলমারিতে। কালই তো রাত জেগে বানিয়ে দিলাম।"
আরও পড়ুন, প্রচেত গুপ্তের ধারাবাহিক গোয়েন্দা উপন্যাস অনাবৃত
মহিলা চলে গেলেন। বৃদ্ধ বয়াম থেকে ওষুধ নিয়ে একটা প্যাকেটে মুড়ে আমাকে দিয়ে বললেন, "দিনে দু-বার। খাওয়ার পরে এক চামচ। জল দিয়ে। খুব তেতো। খেলেই বমি পাবে। কিন্তু খেয়ে চুপচাপ শুয়ে থাকবেন। ঠিক হয়ে যাবে।"
"আচ্ছা, একটা কথা... মানে, যদি কিছু মনে না করেন..."
"অত দোনোমোনো করছেন কেন, বাবা? বলুন..."
"বলছি, দোকানটা কার নামে?"
"কার নামে আবার? আমার নামে। আমিই মালিক। হঠাৎ এ প্রশ্ন?"
"উঁহু, আপনি বুঝলেন না। বলছি, দোকানের নাম তো শ্রীদুর্গা ফার্মেসি। তো-"
"অ, এই ব্যাপার! দোকান মায়েরও নামে, আবার বউয়েরও নামে। আমার স্ত্রীর নামও দুগগা। বৌকে ডাকলেও মায়ের নামই করা হয়ে যায়," নিরাপদ ভটচাজের গোঁফের ফাঁকে কৌতুক ঝিলিক দিয়ে উঠল।
মানুষটিকে আমার বেশ লাগল। শিশুর মতো সরল। বেখেয়ালে, আনাড়ি। এতক্ষণ কথা হচ্ছে, এখনও আমার নাম জিগগেস করেন নি। বললাম, "উনিই কি ওষুধ বানান?"
"হ্যাঁ। ওই-ই বানায়। ও কি আজকে ওষুধ বানায়? ও হচ্ছে আমার স্বর্গত গুরুদেব শ্রীহরকালি চাটুজ্যের মেয়ে। হরকালি ছিলেন রাজকবিরাজ, নাড়াজোল-রাজপরিবারে চিকিৎসা করতেন। ওষুধ তৈরি দুগগা বাপের কাছেই শিখেছে।"
কোথায় যেন একটু রোমান্সের ইঙ্গিত পাচ্ছি! ব্যাপারটাকে থিতোতে না দিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, "তা হরকালি নিজের মেয়েকে কবিরাজি শেখালেন না কেন?"
"শিখিয়েছিলেন তো। আমরা একসঙ্গেই তাঁর কাছে পাঠ নিয়েছি। তবে কী জানেন, তখন ওর বালিকা বয়স - বড় চঞ্চল। নাড়ি দেখার সময় মন স্থির করতে হয়। ওর মন সাতদিকে ছুটছে। তাই ওই ওষুধ বানানোতেই মেতে উঠল..."
মনে মনে ভাবলাম, চাঞ্চল্যের খবর তাহলে আরেকটু নিতে হয়। বললাম, "আপনার গুরুদেব তবে আপনার হাতেই মেয়েকে সম্প্রদান করে যান?"
আরও পড়ুন, দেবেশ রায়ের স্মৃতিকথন মনে পড়ে কী পড়ে না
"না। নাহ," এই বলে নিরাপদ ভটচাজ একটি দীর্ঘশ্বাস গোপন করলেন। তারপর একটু এদিক ওদিক তাকিয়ে, একটু ইতস্তত করে বললেন, "ঘরের কথা পরকে বলা কি চলে? তবে এ বয়সে আর সেসব বলতেই বা কী? আপনি ভদ্দরলোকের ছেলে, তা বলাই যায়... দুগগার বিয়ে হয়েছিল কালতা-পাঁচখুরির শিবনাথ চক্কোত্তির সঙ্গে।"
আমি গল্পের সুগভীর সুঘ্রাণ পেলাম। বাইরে শ্রাবণের আকাশ ঘন হয়ে আসছে। নিরাপদ ভটচাজের কাছে সরে এসে নিতান্ত নিরীহ মুখে প্রশ্ন করলাম, "শিবনাথবাবুও কি কবিরাজ ছিলেন?"
"কে শিবনাথ? না-না। শিবনাথ ছিল পূজারি বামুন। কষ্টে-সৃষ্টে সংসার চালাত। শিবনাথের মা-জননীটি ছিলেন মহিয়সী মহিলা। কীসব তুক করে শিবনাথের মাথাটা খেয়েছিলেন। দুগগার উপর শিবনাথ অত্যাচার করত খুব। গায়ে হাতও তুলত। শাশুড়ি আর স্বামীর অত্যাচারে দুগগা সেই যে বাপের আশ্রয়ে এসে উঠল, আর শ্বশুরবাড়িতে ফেরত গেল না।"
"হরকালি চাটুজ্যে মেনে নিয়েছিলেন?"
"মেনে কি নেন সহজে? প্রথমে শিবনাথকে বোঝাতে গেলেন পাঁচখুরি। তা সে বুঝলে তো! উলটে শিবনাথের মা হরকালি চাটুজ্যেকে তেড়ে অপমান করল। তখন হরকালি চাটুজ্যেও উগ্রমূর্তি ধরলেন। থানা-পুলিশ-আদালত সবই হল। বধূনির্যাতনের অভিযোগ। কিন্তু তখনও আইন তত সবল হয়নি। বহু আগের কথা তো! শিবনাথও আর বৌকে নিল না। দুগগাও আর গেল না। বছর পাঁচেক পর শিবনাথ আবার এক বিয়ে করে বসল।"
"এক স্ত্রী বর্তমান থাকাতে আবার বিবাহ? এ তো একেবারেই আইনসংগত নয়।"
"নয়ই তো। কিন্তু দুগগার বাবা হরকালি চাটুজ্যে ততদিনে গত হয়েছেন। দুগগা একা। এর বিহিত করতে হলে কোর্টকাছারি হবে। দুগগা একা মেয়েমানুষ - তায় নিতান্ত গরীব। আর এইসব মামলাটামলা কাঁড়িকখান্নেক টাকা খরচ করে ঝামেলা কিনে আনা। দুগগা আর কোর্টে গেল না। তবে শাঁখাসিঁদুরও পরত না।"
"আপনি তখন কোথায়?"
"আমি? আমি তখন কবিরাজি শিখে হাটেমাঠে রোজগারের ধান্দা করে বেড়াচ্ছি। মোটেই পেরে উঠছি না। গঞ্জের বাজারে দোকান দিয়ে মাছি তাড়াচ্ছি। যে-গাঁয়ে তিনটে এমবিবিএস পাস করা ডাক্তার, নাকের ডগায় শহর, সেখানে আমার মতো হাতুড়েকে কে পাত্তা দেবে, বাবা?"
"হ্যাঁ, আয়ুর্বেদের কদর ইদানীং যেমন, সে সময়ে তো -"
"একেবারেই নদীর ধারে ঘর, বানের জলে মর-অবস্থা। কেউ পোঁছেই না। শেষে ভাবলাম, ছেড়েই দিই এ ওষুধের কারবার। এর থেকে বরং শহর থেকে গামছা, কাপড় নিয়ে এসে হাটে দোকান দিয়ে বসব।"
"তাই করলেন নাকি?"
"করতেই যাচ্ছিলাম। এমন সময় একদিন গঞ্জ থেকে ফেরার পথে দুগগার সঙ্গে দেখা...সন্ধেবেলা। মুখ-আঁধারি হয়েছে, দুগগা চৌধুরীদের বাড়িতে রান্নার কাজ সেরে ফিরছে... একথা ওকথা..."
"কী কথা?"
"ব্যাঙলতা," বলেই নিরাপদ কোবরেজ ফিক করে হাসলেন। বুড়ো বেশ চালাক তো! ঠিক আমার দুষ্টুমি ধরে ফেলেছেন! হাসিটা গোঁফের আড়ালে চালান করে দিয়েই আবার বলতে লাগলেন, "একথা ওকথা... হতে হতে শেষে দুগগাকে মনের দুঃখ সব বললাম...হরকালি কোবরেজের শিক্ষা সব জলে গেল...এখন আমি দেব গামছার দোকান। শুনে দুগগা খুব রাগ করলে।"
"রাগ হওয়াই স্বাভাবিক। তাঁর বাবার শিক্ষা..."
"ঠিক। দুগগা রাগ করে বলল, তুমি কাপড়ের দোকান দেবে? আমি বেঁচে থাকতে তা হতে দেব না। তুমি কবিরাজির দোকান দিয়ে বোসো, নিরাপদদা। গঞ্জে নয়, আমাদের ভিটেয়। আমি তোমাকে সব ওষুধ বেটে দেব। সেই আমাদের শুরু।"
"কিন্তু উন্নতি করলেন কীভাবে? এখন তো দেখছি..."
"মায়ের কৃপা আর দুগগার হাতযশ। দেখুন বাবা, হরকালি কবিরাজ কতকগুলি ওষুধ আমাদের মোটেও শিখিয়ে যাননি। সে বিদ্যা তিনি দিয়ে গিয়েছিলেন দুগগাকে। এই যে মধুমেহ, তারপর বাতব্যাধি কিংবা অর্শ - আমরা এগুলির মামুলি নিদানই জানতাম। কিন্তু দুগগার ওষুধ মন্ত্রের মতো কাজ দিতে লাগল। অ্যালোপ্যাথিক ডাক্তার ফেল। এই তো শম্ভুনাথ ডাক্তারের কাছে অনাদির মা দশ বচ্ছর শুয়ে শুয়ে ওষুধ খাচ্ছিল, হাঁটুর ব্যথা আর ভাল হয় না - সেই লোক দুগগার ওষুধে এক মাসের মধ্যে উঠে বসল, ছয় মাসে ব্যথা কর্পূরের মতো উবে গেল। ওই থেকেই চারপাশের গাঁয়ে আমাদের নামযশ, ইনকাম, ওই দুগগার জন্যেই দোকানটি টেনে নিয়ে যেতে পারছি, বাবা!"
"আপনারা সেই থেকেই একসাথে আছেন?" আমি আবার গল্পে ফিরতে চাই।
"তা আছি। তবে গাঁ-গঞ্জ, বোঝেনই তো। আমাদের নিয়ে খুব কথা হচ্ছিল। শেষে আমি গড়বেতার সর্বমঙ্গলা মন্দিরে মায়ের সামনে ওকে সিঁদুর পরিয়ে নিয়ে এলাম। গ্রামে বললাম, আমাদের মন্দিরে বিয়ে হয়েছে। তা এই নিয়ে খুব হৈচৈ, গ্রামের কালীতলায় বিচের-টিচের হল... শেষে আমাকে কিছু জরিমানা সাব্যস্ত করে তবে লোকে মেনে নেয়।"
"বুঝলাম। শিবনাথ চক্কোত্তি কিছু ঝামেলা করেননি? তিনি তো ডিভোর্স দেননি।"
"আরে বিবাহ নাই, তার বিবাহ-বিচ্ছেদ!"
"সে কী! এই তো বললেন, হরকালি তাঁদের বিবাহ দিয়ে গিয়েছিলেন!"
"বাবা! আগুন জ্বেলে ঘি মাখিয়ে চারটি বেলপাতা পুড়িয়ে সাতপাক মারলেই কি আর বিয়ে হয়? বিয়ে হয় মনের সঙ্গে মনের। সেই বিয়েই তো হয়নি শিবনাথের সঙ্গে ওর। শিবনাথের কানে কথাটা পৌঁছেছিল বটে! থানা-পুলিশ করার ভয়ও দেখিয়েছিল। কিন্তু তার বেশি আর কিছু করেনি। আমি সবকিছুর জন্য তৈরি ছিলাম, বুঝলেন! জেল, হাজত যা হয় হোক। কিন্তু শিবনাথ আর এগোলো না।"
"এগোবে কী করে? সে নিজেই তো একটা বেআইনি বিয়ে করে বসে আছে।"
"সেই। মায়ের যা ইচ্ছা! আমাদের গাঁ-ঘরে এরকমই সব গল্প, বাবা! যাই হোক, অনেক কথা হলো আপনার সঙ্গে। বর্ষাটিও বেশ নেমেছে। একটু চিনি ছাড়া চা খাবেন নাকি আদা দিয়ে? দুগগা-আ -"
ধুলামাটির বাউলের সব পর্ব পাবেন এই লিংকে