Advertisment

ধুলামাটির বাউল: কারাগৃহ

আমি এঁদের চোখগুলো দেখছিলাম। নিতান্ত সাধারণ চোখ। সেখানে পাপের চিহ্নমাত্র নেই। নেই অনুশোচনার আগুনও। যা আছে, তা হল পরিবারবিচ্ছিন্ন, পরিচিতিবিচ্ছিন্ন, জীবন-থেকে-ছিটকে-পড়া মানুষের নির্ভেজাল অসহায়তা।  

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
Dhulamatir Baul

ছবি- মধুমন্তী চ্যাটার্জি

আমি বেশ কয়েকবার জেলে গিয়েছিলাম।

Advertisment

না, না, চমকে উঠবেন না। যা ভাবছেন, তা নয়। খুলে বলি।

স্বামী বিবেকানন্দের জন্মদিন উপলক্ষ্যে আগরতলা সংশোধনাগার বা আগরতলা জেলের কারাবাসী বন্দীরা খুব বড়ো বড়ো ফুলের মালা, পুষ্পস্তবক ইত্যাদি বানিয়ে রামকৃষ্ণ আশ্রমে পাঠাতেন ফি-বছর বারোই জানুয়ারি। আমার কাজ ছিল জেল থেকে ফুল, মালাগুলি সংগ্রহ করে নিয়ে আসা এবং কারাগারের আবাসিকদের জন্য ফল, মিষ্টি প্রভৃতি আশ্রমের পক্ষ থেকে দিয়ে আসা। তাঁদের সঙ্গে দু-চার কথা বলা। ধীরে ধীরে সংশোধনাগারের আবাসিক ও কারাকর্মীদের সঙ্গে আমার এক ধরনের বন্ধুত্ব হয়ে যায়। জেলর সাহেব তো আমাকে ভালোবাসতেন খুবই।

রবীন্দ্রভারতী, রোদ্দুর রায় ও ইন্টারনেটের খাপ বিশেষজ্ঞরা

প্রথম যেবার গিয়েছিলাম, সেদিন শীত বেশ আছে। জেলের প্রবেশপথে চিঠি ও পরিচয়পত্র দেখালাম। বিশাল বিশাল গেটের ইয়াব্বড় সব তালা খুললেন রক্ষীরা। সেই অনেকগুলো দরজা খোলা, ব্যারিকেড পেরোনোর জটিল প্রক্রিয়া সম্পন্ন হল দশ মিনিট ধরে। গেট খোলার ঘড়ঘড় আওয়াজ শুনতে শুনতে মনে হল, হ্যাঁ, জেল একখানা বটে। এর অনেক উঁচু, অনেক মোটা প্রাচীরের আড়ালে যাঁরা আছেন, তাঁরা যে সমাজের পক্ষে কী ভয়ংকর, তা এই দ্বারোন্মোচনের আওয়াজেই মালুম হচ্ছে।

গেট তো খোলা হল। তারপর সশস্ত্র সান্ত্রীরা আমাকে জেলর সাহেবের (‘সাহেব’ কথাটা সেই ঔপনিবেশিক শাসনের কাল থেকে আমাদের ভাষায় ঢুকে পড়েছে এবং আমরাও তাকে সযত্নে ব্যবহার করে চলেছি, না বললে আবার কেউ ভাববেন যথোপযুক্ত সম্মান করছি না, তাই ‘সাহেব’ই সই) ঘরে নিয়ে গেল। জেলর আমাকে বসতে বললেন। দেখলাম, তিনি খুবই আমুদে লোক, যথেষ্ট মিষ্টভাষী, শুধু এরকম একটা কঠিন দায়িত্ব তাঁর বাইরের দিকটাকে একটু রুক্ষ করে তুলেছে মাত্র। তিনি আমাকে খুবই আদরযত্ন করলেন। দুজনেই কার কোথায় বাড়ি, তাঁর বাড়ি আছে, আমার আপাতত বাড়ি নেই, কে কী খেতে ভালোবাসি, কার কী শখ, এবার কেমন বর্ষাটর্ষা হল, চাষবাসের কী অবস্থা, দেশের রাজনীতি কেমন চলছে, আসন্ন নির্বাচনে কে টিকবে কে উল্টোবে ইত্যাকার যাবতীয় কথাবার্তা—যা দুজন বাঙালি একে অপরের সঙ্গে দেখা হলে একবার আদ্যোপান্ত আউড়ে নেয়, তার সবকিছুই আউড়ে নিলাম দুজনে। তারপর তিনি বললেন, ‘চলুন, আপনাকে জেল ঘুরে দেখাই।’

বইয়ের জন্য প্রেম, নাকি প্রেমের জন্য বই?

এই জেল-ঘুরে-দেখা ব্যাপারটায় আমার আপত্তি ছিল। জেল কোনো লাইব্রেরি, পশুশালা, মিউজিয়ম বা এশিয়াটিক সোসাইটি নয় যে, তা দর্শনীয় বা ঘুরে দেখার জিনিষ। মানুষ, সে যে-অবস্থাতেই পড়ুক না কেন, সে কষ্ট পাচ্ছে বা বন্দী হয়ে আছে, এটা দেখতে যাওয়া সেই সব কারাবাসী মানুষদের অপমান করা ছাড়া আর কিছুই নয়। আমি তাই বললাম, ‘খুব বেশি সময় নেই। কারাবাসিকদের জন্য যে মিষ্টিগুলো এনেছি, সেগুলো আপনাকেই দিয়ে যাই, আপনি তাদের বিতরণ করে দেবেন আর যদি চান, তাদের সঙ্গে একটু আড্ডা দিতে ইচ্ছুক।’

তিনি একটু দোনোমোনো করতে লাগলেন। বললেন, ‘কেউ কেউ আছে ফৌজদারি মামলার আসামী, তাদেরকে বাইরে আনা মুশকিল। আচ্ছা, আপনি যখন বলছেন কিছু হবে না, কয়েক ঘণ্টার জন্য সবাইকে একটা হলঘরে জমায়েত করছি, তারপর কিছু হলে আপনি বুঝবেন।’

আমি আর কী বুঝব? দায়িত্ব তো তাঁর। সেকথা তিনিও বিলক্ষণ জানেন। তারপরেও ভদ্রলোকের কেমন জানি আমার কথা শুনে মনটা আলগা হয়েছে দেখে আমি রাজি হয়ে গেলাম।

ছাপা বই বনাম পিডিএফ, বাংলার হাল ও হকিকৎ

জেলর আমাকে নিয়ে ভেতরের দিকে গেলেন, দুপাশে দুই সশস্ত্র সান্ত্রী। ওব্বাবা! অফিসঘর পেরিয়ে গিয়ে দেখি আরেক প্রস্থ ইয়া মোটা ইয়া উঁচু প্রাচীর। কড়াক্কড় শব্দে তারও দরজা খোলা হল। সেই দরজার দুপাশে বড্ড মোটা কালো কালো অক্ষরে একদিকে লেখা ‘লোভে পাপ, পাপে মৃত্যু’। অন্যদিকে লেখা ‘পাপ করিলে সাজা পাইতে হয়’।

ভাবছিলাম। ধরা যাক, কোনো একজন লোক কোনো একটা অপরাধ করেছেন। সামান্য বা ভয়াবহ সামাজিক অন্যায়। বিচারে তাঁর কারাবাস সাব্যস্ত হয়েছে। সেই লোককে যখন জেলে নিয়ে ঢোকাবে, তখন প্রবেশপথের পাশে এই দুটি মহার্ঘ্য বচন তাঁর চোখে পড়বে। যাতে চোখে পড়ে, সেইজন্যেই অমন করে লেখা। এই যে পাপবোধ, নিজেকে ‘পাপী’ ভাবা, নিজেকে ‘দাগী’ ভাবা, এরপর আর মানুষটার উন্নতির আশা আছে? আমি পাপী, আমি দাগী, এরকম ভাবতে ভাবতে মানুষটা একেবারে চিরতরে পাপী হয়ে উঠবেন। যে যা ভাবে, সে নিজে তাই-ই হয়ে যায়। পাপী ভাবলে পাপী হবে। অন্যায় করেছি, এর পর এমন অন্যায় আর  করব না, আবার আমি ভালো হব, এমন ভাবলে সে দিনে দিনে ভালো হয়ে উঠবে। দেওয়াল কখনও চুরি করে না, গরু কখনও মিথ্যে কথা বলে না, কিন্তু দেওয়াল চিরকাল দেওয়ালই থাকে, গরু চিরকাল গরুই থাকে। মানুষই অন্যায় করে, আবার শুধরে নিয়ে সেই মানুষ-ই দেবতা হয়ে ওঠে একদিন—এই না ছিল স্বামী বিবেকানন্দের কথা, যাঁর আজ জন্মদিন? কারাগারের দেওয়ালে পাপের বিজ্ঞাপন দেখতে দেখতে কথাগুলো বিষণ্ণ চিত্তে ভাবছিলাম।

সেই প্রাকার পার হয়ে অনেকটা বিস্তৃত সবুজ ঘাসে ঢাকা মাঠ। সেই মাঠের মধ্যে বেড়া দেওয়া বিশাল ফুলের বাগান। জবা, গাঁদা, ডালিয়া, রজনীগন্ধা, ক্রিসেনথিমাম, গোলাপ, জিনিয়া আরও কতো রঙবেরঙের ফুল। তারপর সবজি বাগান। জিজ্ঞেস করলাম, ‘কারা এসব চাষ করেছে?’ জেলর হেসে বললেন, ‘এই কারাগারের বন্দীরাই।’  আমি বললাম, “উফফফ! ‘পাপী’রা এমন সুন্দর ফুল ফুটিয়েছে?” তিনি বললেন, ‘মশাই! আপনার কথা বুঝতে   পেরেছি। তো আপনি কি বলেন দেশে আইন-আদালত, জেল-হাজত থাকবে না?’ আমি বললাম, “তা কই বললাম? বিলক্ষণ থাকবে। অন্যায় করেছে আর সাজা পাবে না? কঠোর সাজাই পেতে হবে। তবে কিনা এমন ‘পাপী’ বলে দেগে দেওয়া কোনো সভ্য দেশে হয় কিনা আমি জানি না। আমার অভিজ্ঞতার পুঁজি অল্প। তবে আপনারা জেলের সামনে সাইনবোর্ডে যে বড়ো বড়ো অক্ষরে ‘সংশোধনাগার’ কথাটা লিখে রেখেছেন, সেই ‘সংশোধন’ কি ‘পাপী’ বলে চিরতরে দেগে দিলে আর হবে? খুব বেশি হলে এটা একটা পাপস্খালনের নরকেই  পরিণত হবে এবং তাই-ই হয়।” জেলর খানিক তাঁর গোঁফজোড়া পাকাতে পাকাতে চিন্তা করে বললেন, ‘কিছুটা  সেই দিকেই চেষ্টা চলছে কয়েক দশক হল। আপনি সব খবর জানেন না। তবে ওই আরকি! পুরোনো ব্যবস্থার ভূত এখনও আমাদের ছেড়ে যায়নি।’ আমি বললাম, ‘তা তো দেখতেই পাচ্ছি। তা না হলে এমন রাক্ষুসে প্রাচীর, তাড়কাকার গেট আর অমন কটকটে দেওয়াল লিখন এখনও টিকে থাকে?’ তিনি আর কিছু না বলে একটু বিষণ্ণ হাসলেন।

“বইমেলার আগুনের কারণ একটি দায়িত্বজ্ঞান সিদ্ধান্ত”

লন পেরিয়ে একটা টানা বারান্দাসমন্বিত লালরঙা বাড়িতে উঠে এলাম। মোটা মোটা থাম, লাল রঙের মেঝে, নীচু ছাদ, সারি সারি সেলের সামনে দিয়ে বারান্দাটা অনেক দূরে চলে গেছে। অস্তগামী সূর্যের বিপরীতে মোটা মোটা থামগুলির ছায়া নিষেধের উদ্যত তর্জনীর মতো বারান্দার মেঝেতে পরপর এসে পড়েছে। চারিদিক নিঃশব্দ। শুধু জেলার, সান্ত্রী ও অতিথির জুতোর মস্‌ মস্‌ আওয়াজ যেন সেই নৈঃশব্দ্যের পাথর কাটছে।

তারপর একটা বড়ো হল ঘরে জেলর আমাকে নিয়ে গেলেন। কোথাও একটা ঘণ্টা বাজল। এক এক করে বন্দী আবাসিকরা এসে ঢুকলেন। তা হবে শ-পাঁচেক লোক বা তার বেশি। সকলেরই একই ধরনের পোষাক। ডোরাকাটা হাঁটু অবধি প্যান্ট আর একইরকম ডোরাকাটা হাফহাতা জামা। শীতের দিন, তাই একটি করে মোটা চাদর বা কম্বল। মাটিতে সতরঞ্জি পাতা ছিল। আমরা সবাই সেখানে বসলাম। হলের ভেতর একটা মঞ্চ ছিল। বেশ সুন্দর করে সাজানো।

একজন একটি আবৃত্তি করলেন। রবীন্দ্রনাথের ‘বন্দী বীর’। কী স্পষ্ট উচ্চারণ! আরেকজন গান গাইলেন। সেও রবীন্দ্রসঙ্গীত। কী গান, এখন আর মনে নেই। তবে তার সুর হল পেরিয়ে, বারান্দা পেরিয়ে, ঘাসের লন পেরিয়ে, লাল রঙের দৈত্যাকার প্রাচীর পেরিয়ে দূর আকাশে গিয়ে মিশে গেল যেন। দুজন তবলা বাজালেন। চার পাঁচজন আমাদের দেখালেন যোগাসন। আরেকজন হাস্যকৌতুক করলেন। মিমিক্রি। অসাধারণ অভিনয় ক্ষমতা। সেই ফুলের মালাগুলি, পুষ্পস্তবকগুলি একজন আবাসিক স্বামীজীর জন্য, ঠাকুরের জন্য খুবই শ্রদ্ধার সঙ্গে আমার হাতে দিলেন।

আমি এঁদের চোখগুলো দেখছিলাম। নিতান্ত সাধারণ চোখ। সেখানে পাপের চিহ্নমাত্র নেই। নেই অনুশোচনার আগুনও। যা আছে, তা হল পরিবারবিচ্ছিন্ন, পরিচিতিবিচ্ছিন্ন, জীবন-থেকে-ছিটকে-পড়া মানুষের নির্ভেজাল অসহায়তা।

পরে আমি সেকথা জেলরকে বলেছিলাম। তিনি রেগে গিয়ে বললেন, ‘আপনি যা ভাবছেন, তা নয়। এরা কেউ দুধে ধোওয়া তুলসীপাতাটি তো নয়। কেউ চুরি করেছে, কেউ ডাকাতি, কেউ খুন, কেউ ধর্ষণ। এখানে এসেও এরা ভালো ছেলেটি হয়ে থাকে না। রক্ষীদের সঙ্গে যোগসাজশ করে গাঁজা, মদ চোরাপথে নিয়ে আসে। এ ওর খাবার কেড়ে খেয়ে নেয়, মাস্তানি করে, মারপিট করে। আপনাকে দুটো কবিতা আর গান শুনিয়ে দিল, আর আপনি অমনি গলে জল হয়ে গেলেন। এসেছেন তো দুঘণ্টার জন্য। জেলের দায়িত্ব নিতে হলে বুঝতে পারতেন, কতো ধানে কতো চাল!’

আমি বললাম, ‘তা ঠিক। আপনি অবশ্যই আপনার অভিজ্ঞতাটা বলছেন। কিন্তু তবে যে শুনতে পাই, কেউ কেউ জেলে বসে পড়াশোনা করে বিএ, এমএ পাশ করে...’

—তা করে বৈকি! তবে তাদের সংখ্যা অল্প। আমরাও তাদের জন্য শিক্ষক নিয়োগ করি।

—তা বেশ। কিন্তু সবার জন্যেই কি একই ব্যবস্থা? শ্রীঅমুকচন্দ্র তমুককে দেখলাম না আজ?

—মশাই, আপনার উপর যা রাগ হচ্ছে না, আপনাকেই জেলে ঢুকিয়ে দিতে ইচ্ছে হচ্ছে। যার নাম করলেন, তিনি একজন রাজনৈতিক বন্দী। তিনি এঁদের সঙ্গে আসেননি গল্পগুজব করতে। তাঁর একটু...তাঁর একটু...মানে উপর থেকে অর্ডার আছে, স্পেশাল ব্যবস্থা।

—বুঝলাম। তবে শুনেছি, তাঁকে নিয়েও তো ফৌজদারি মামলাই চলছিল। আর এখানে অনেকেই আছেন, এই ধরুন যিনি আবৃত্তি করলেন, তিনি...

—ও ছিল ব্যাঙ্কের ম্যানেজার। ওকে ফাঁসানো হয়েছিল। অভিযোগ অপ্রমাণ করতে পারেনি।  অপরাধ  করেনি, কিন্তু শাস্তি হয়েছে। জানি। কিন্তু কী করব? এরকমও কিছু কিছু আছে।

আবার একটা ঘণ্টা পড়ল। বারান্দা দিয়ে সারি সারি কারাবাসিকরা কানা-উঁচু থালা হাতে দাঁড়াল। গামলা থেকে ভাত আর লাউয়ের তরকারি হাতায় করে একজন জেলকর্মী সানকিতে ঢেলে দিচ্ছিল। রাতের আহার।

সন্ধে হল। জেলারের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে কারাগারের দুই প্রস্থ প্রাকার পেরিয়ে বেরিয়ে এলাম। আমার পেছনে ঘড়ঘড় করে জেলগেট বন্ধ হয়ে গেল। সামনে এগিয়ে গেলাম। দেখলাম, রাস্তায় সন্ধ্যার আলো জ্বলে উঠেছে। সুবেশ সুবেশা সুসামাজিক মানুষের ভিড়, যানবাহন। আমি কারাগারে প্রবেশ করলাম।

এই সিরিজের সব লেখা একত্রে

dhula matir baul
Advertisment