৩
পি এস শিবস্বামী সালাই বিকেলের পড়ন্ত আলোয় শুয়ে আছে। মাদ্রাজ শহরের জনবহুল পথ—মানুষ এ পথের উপর দিয়ে হেঁটে চলে যায়, অথচ এ পথকে সহজে লক্ষ করে না। অথবা, পথ বলে কি কিছু আছে? মানুষের পায়ের পাতার নীচে যে-ধারণাটা গড়ে ওঠে, সেই ধারণাটাকেই তো ‘পথ’ বলে এতদিন চিহ্নিত করে আসছে মানুষ।
বিকেলের এই পথে তাঁর সঙ্গে দেখা হয়েছিল আমার। প্রথমে একটু অবাকই হয়েছিলাম। শ্বেতাঙ্গ। মাথা কামানো। গায়ে খয়েরি রঙের কাষায়। বছর চল্লিশেক হবে বয়েস। ইংরেজিতেই অভিবাদন জানিয়ে বলেছিলাম, গুড আফটারনুন। তিনি আমাকে অবাক করে দিয়ে সামান্য ঝুঁকে বিশুদ্ধ সংস্কৃত ভাষায় বলেছিলেন, শুভাপরাহ্নম্!
হাঁটতে হাঁটতে পথের পাশে একটা পার্কের বেঞ্চিতে বসে আলাপ হল। নাম ম্যাথিউ। জাতে জর্মান। ভারতে এসে ধর্মশালায় দলাই লামার কাছে প্রব্রজ্যা গ্রহণ করেছেন। নতুন নাম হয়েছে ‘বোধিধর্ম’। এ নামে একজন বিখ্যাত বৌদ্ধ ভিক্ষু বহু যুগ আগে ভারত থেকে চীনে গিয়েছিলেন ধর্মপ্রচারের জন্য। সেকথা আমি তাঁকে বলতে তিনি মৃদু হাসলেন।
আরও পড়ুন, প্রচেত গুপ্তের ধারাবাহিক গোয়েন্দা উপন্যাস অনাবৃত
তিনি আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন, তুমি কি সন্ন্যাসী?
আমি বললাম, হ্যাঁ।
কী? শঙ্করপন্থী? অদ্বৈতবাদী?
হ্যাঁ।
তাঁর দৃষ্টি এক মুহূর্তে তীক্ষ্ণ খরশান হয়ে উঠল। তার পরমুহূর্তেই অনাবিল হাসিতে ভরে গেল তাঁর চোখমুখ। বললেন, জানো তো, তোমরা আমাদের প্রবল প্রতিপক্ষ।
জানি। কী আর করা! আপনারা তো আর ঔপনিষদ আত্মা মানলেন না।
না মানার যথেষ্ট কারণ আছে। তুমি আমার বাসস্থানে এসো। তোমাকে আমি এমন করে বোঝাবো যে, তোমার অদ্বৈতবাদে আস্থাই চলে যাবে।
বটে? তাহলে তো যেতে হচ্ছে! কোথায় থাকেন?
মৈলাপুরে একটা ভাড়াবাড়িতে উঠেছি। এখানে বিবেকানন্দ কলেজে সংস্কৃত পড়ি।
পড়েন? তার মানে? আপনার আর সংস্কৃত পড়ার দরকার কী? এই তো আমার সঙ্গে মাঝে মাঝে হু-হু করে সংস্কৃতে কথা বলছেন।
দরকার আছে। এই কলেজের সংস্কৃতবিভাগে খুব ভাল করে পতঞ্জলির মহাভাষ্য পড়ানো হয়। সেই লোভেই...
বুঝলাম, আমার সঙ্গে বড় আকর্ষণীয় মানুষের দেখা হয়েছে। আরও দু-চার কথা হল। ঠিক হল, পরের দিনই আমি তাঁর কাছে যাবো। ম্যাথিউ সাহেবের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে যখন ফিরে আসছি, তখন পথের দুপাশে সন্ধ্যার আলো জ্বলে উঠেছে।
আমি প্রতিদিন বিকেলে তাঁর বাসায় যেতে লাগলাম। ম্যাথিউ সাহেবের ঘরটি ছোটো, বইপত্রে ঠাসা। টেবিলের উপর কাঠের তৈরি বুদ্ধের ধ্যানমূর্তি। প্রজ্ঞাপারমিতার মূর্তিও আছে বইয়ের সেলফে। আর কেন জানি, একপাশে তামার তৈরি একটা ঘট।
মেঝেতেই ঘুমোন। চারিধারে বইয়ের প্রাচীর। ছোটো একটা কাঠের তৈরি পীঠিকা। তাতে অনেক সময় কাগজ রেখে মাটিতে পা-মুড়ে বসে কীসব লেখেন। ছোট্টো একটা রান্নাঘর। গ্যাসের ব্যবস্থা আছে। আর একটা কুকার।
আরও পড়ুন, দেবেশ রায়ের স্মৃতিকথন মনে পড়ে কী পড়ে না
তিনি আমাকে বসুবন্ধুর ‘বিংশিকা’ আর ‘ত্রিংশিকা’ পড়াতে শুরু করলেন। ত্রিংশিকার উপর স্থিরমতির ভাষ্য আছে। বসুবন্ধু দেখিয়েছেন, চেতনা বা বিজ্ঞানই একমাত্র সত্য। আর সব যা কিছু—এই দেহ, গেহ, যাবতীয় বস্তুনিচয় সকলই সেই চেতনার স্পন্দন বা বহিঃপ্রক্ষেপ। যেমনটা আমরা স্বপ্নে দেখি, জাগ্রৎকালে অনুভূত এই জগতটাও ওই স্বপ্নের মতই অবাস্তব। সত্য কেবল মন। আর যা-কিছু, সব মনেই আছে, তবু সেগুলোকে আমরা যেন বাইরে দেখছি।
আমি বললাম, বেশ কথা! তা সবই যখন মনের রচনা আর সে-কারণেই সবই যখন অবাস্তব হল, তখন এই সবকিছুর রচয়িতা মনটাকেই বা বাস্তব বলে ধরা কেন? মনটাকেও নিঃসার বলা হোক তবে!
আর সব পদার্থ মনেই আছে, অথচ সেগুলোকে আমরা ‘যেন মনের বাইরে’ দেখছি—এই যদি হয়, তাহলে ‘বাইরে’ বলে কিছু একটা আছে নিশ্চয়ই। নৈলে ‘যেন বাইরে’ কথাটা আসছে কোত্থেকে?
পড়ানোর সময় ম্যাথিউ সাহেবের স্থানকালের হুঁশ থাকে না। বসে বসে তর্ক করতে করতে পা ব্যথা হলে আমার কোলের উপর পা তুলে দিয়ে আরাম করতেন। বিকেলে এসেছি, সন্ধে গড়িয়ে রাত্রি সাড়ে এগারোটা হল, তাঁর খেয়াল নেই। কিছুটা তাঁর প্রভাবেই হয়ত আমারও সময়জ্ঞান থাকত না। শেষে পাহারাওয়ালার বাঁশির শব্দে আমাদের হুঁশ ফিরত।
ম্যাথিউ সাহেব বার বার কড়া ব্ল্যাক কফি খেতে ভালবাসতেন। এটা ঠিক বৌদ্ধ ভিক্ষুর উপযোগী নয়। তা নিয়ে আমি তাঁকে ঠাট্টাও করতাম। তিনি ঠাট্টা সহজভাবেই নিতেন। বলতেন, কী করব! এ অভ্যাসটা আমি ছাড়তে পারিনি।
আমি তাঁর সঙ্গে খুব তর্ক করতাম। আসলে উভয় মতেই যুক্তির ফাঁক আছে। ফাঁকটা একমাত্র চরম অনুভূতি দিয়েই বোজানো যায়। যাঁরা অনেকদিন চর্চা করেছেন, তাঁরা সেটা জানেন। তর্কের সময় নিজের মতের ওই ফাঁকগুলো লুকিয়ে ফেলে, বিপক্ষবাদীর মতের ফাঁকগুলো হাঁ-করে দেখানোই রণনীতি। ম্যাথিউ সাহেবও সেটা জানতেন। কিন্তু ছেলেমানুষের মতো রেগে গিয়ে নিজের মতের নিগ্রহস্থানগুলি আমার সামনে উন্মুক্ত করে ফেলতেন। আর তখনই আমি উদ্যত বাজপাখির মতো সেগুলির উপর ঝাঁপিয়ে পড়তাম।
এক ছুটির দিনের বর্ষামুখর দ্বিপ্রহরে আমি গেছি তাঁর দোতলার ঘরে। কুকারে খিচুড়ি রান্না হচ্ছে। ম্যাথিউ সাহেব বসুবন্ধুর সেই ত্রিস্বভাব তত্ত্বের ভিতর একেবারে ডুবে আছেন। পরিকল্পিত, পরতন্ত্র, পরিনিষ্পন্ন। আমি দেখলাম, এইবেলা খিচুড়ি না নামালে ধরে যাবে। দুটো কাচের প্লেটে খিচুড়ি নামিয়ে সামনে এনে বললাম, খেয়ে নিন। খিচুড়ি আর আলুর চিপস আছে। ম্যাথিউ সাহেব এক হাতে বই নিয়ে আরেক হাতে খিচুড়ি খাচ্ছেন। জামাকাপড়ে খিচুড়ি পড়ছে, খেয়াল নেই। মাঝে দেখলাম, জানালা দিয়ে বৃষ্টিধোয়া শহরের দিকে একেবারে উদাস হয়ে তাকিয়ে আছেন। তারপর হঠাৎ হুঁশ ফিরতে অন্যমনস্ক স্বরে বললেন, তোমার চোখদুটি ঠিক আমার মায়ের মতো।
আমি বললাম, না। মায়ের মতো নয়। তা ছাড়া প্রব্রজিত সন্ন্যাসী বা ভিক্ষুর পূর্বাশ্রমের স্মৃতিচারণের অধিকার নেই।
তিনি খুব স্তিমিত কণ্ঠে বললেন, ইউ আর টু হার্ড টু ইয়োরসেলফ। ইট হার্টস।
মনে হল, কোন সুদূর উইজবাডেন শহরে জন্মেছিলেন ম্যাথিউ সাহেব; শুনেছি মা এখনও আছেন সে-শহরে। জ্ঞানের অন্বেষণে চলে এসেছেন ভারতে, কোথায় না কোথায় বাউন্ডুলের মতো ঘুরছেন। আজ এই বৃষ্টিভেজা দুপুরে হয়ত মনে পড়ছিল তাঁর ফেলে আসা মায়ের কথা। আসলে ‘মা’ শব্দটাই তো এমনই একাক্ষরা—একা এবং খরা। বেচারিকে কষ্ট দিলাম অযথাই। কী হত ও কথাটা না বললে?
আরও পড়ুন, জয়া মিত্রের কলাম জল মাটি: পৃথিবীর পোশাক
আমি তাড়াতাড়ি সামলে নিয়ে বললাম, বাদ দিন ওসব। কবিতা শুনবেন? আপনার শুষ্ক মনের মাটি ভিজে নরম হবে বাংলা কবিতার রসে।
তিনি বললেন, শুষ্ক কে? তুমি, না আমি?
আমি বললাম, আমি। এখন কবিতা শুনুন।
বলো।
আমি বললাম, শুনুন—
‘আজ সেই ঘরে এলায়ে পড়েছে ছবি
এমন ছিল না আষাঢ় শেষের বেলা
উদ্যানে ছিল বর্ষাপীড়িত ফুল
আনন্দভৈরবী’
তারপর অতি অপটু তর্জমায় কবিতাটির ভাব তাঁকে বলতে যেতেই তিনি বললেন, বলতে হবে না। বুঝতে পেরেছি।
আমি বললাম, কী করে বুঝলেন? এ তো বাংলাভাষা। আপনি জানেন না।
তিনি বললেন, তোমাদের দেশের বর্ষার কথা এখানে আছে না? একটা হারিয়ে যাওয়া...একটা চলে যাওয়া...স্মৃতিকাতরতা আছে না এ কবিতায়?
কীভাবে বুঝলেন?
ওই কবিতার ছন্দোস্পন্দ থেকে। ভাষা তো জানি না আমি।
দেখলাম, ম্যাথিউ সাহেবের চোখের পাতায় যেন কতো মেঘ করেছে।
তারপর বেশ ক-দিন তাঁর কাছে আর যাইনি। পরে যেদিন গেলাম, দেখি খুব অভিমান হয়েছে। কথা বলছেন না। কফি বানিয়ে আনলাম। খেলেন না। কী একটা বই খালি খালি চোখের সামনে ধরে আছেন। আর নীচের ঠোঁটটা কাঁপছে।
আমার খুব হাসি পেল। মনে পড়ল, বহু দিন আগে একটি কিশোরী মেয়েকে অঙ্ক পড়াতাম। ক-দিন কামাই করলে সেও এমনই অভিমান করত। তারও এমন নীচের ঠোঁট কাঁপত।
আমি বললাম, কথা বলুন। এটা কি ঠিক হচ্ছে?
তিনি হঠাৎ চিন্তিত স্বরে বললেন, না, ঠিক তো নয়ই। আমিই বুঝতে পারছি না, কেন এটা হচ্ছে।
কী হচ্ছে, আমাকে বলুন।
তুমি ক-দিন আসোনি কেন? আমি তোমার জন্যে সারাদিন... সারা সন্ধে...ঘরবাহির করছি...এটা কেন আমার হল? যুক্তি দিয়ে বুঝতে পারছি, এই আকর্ষণ পরম নয়, অথচ মন থেকে এটা যাচ্ছেও না। তোমরা বেদান্তীরা একেই তো মায়া বলো, না?
আমি বললাম, আপনারাও বলেন। আসুন, বিচার করুন। ‘আমি’ মানেটা কী? রূপ, বিজ্ঞান, বেদনা, সংজ্ঞা, সংস্কার—কোনটা আমি? কোনোটাই না। পেঁয়াজের খোসা ছাড়ালে কিছু থাকে? কিচ্ছু না। অপার শূন্যতা। অনাত্মা। তাহলে কার প্রতি আপনার আকর্ষণ?
তিনি বললেন, ওফ। তুমি একটু থামো না, বাপু!... আচ্ছা, বলো তো দেখি, তোমার সংসর্গে আমার মনে এতো স্মৃতির পাহাড় জেগে ওঠে কেন? কেন এতো অতলান্ত মায়া জেগে ওঠে আমার?
আমি চুপ করে গেলাম। অনেকক্ষণ পরে ধীরে ধীরে বললাম, সে আছে। ছোটোবেলায় আমার সঙ্গে এক বাউলানির দেখা হয়েছিল। মনুবাউলানি। সে তার চোখের কাজল আমার চোখে পরিয়ে দিয়ে গেছিল। তার থেকেই কারো কারো সর্বনাশ হয়!
মেলার ভিড়ে হারিয়ে যাওয়া অসহায় শিশুর মতো ম্যাথিউ সাহেব বলে উঠলেন, তাহলে এখন আমি কী করব?
দুজনেই নিশ্চুপ। ঘরে অখণ্ড নীরবতা। কথা হল না আর। বাইরে আকাশ আবার ঘন হয়ে উঠছে। বাতাসে আসন্ন বৃষ্টির ঘ্রাণ...
চলে এসেছিলাম। তারপর হপ্তাখানেক পর যেদিন গেলাম, দেখি ম্যাথিউ সাহেব নেই। ঘর ফাঁকা।
বইখাতা, আসবাবপত্র কিচ্ছু নেই। কতগুলো ছেঁড়া কাগজ শুধু মেঝের উপর বাতাসে এদিক ওদিক লুটোচ্ছে।
ম্যাথিউ সাহেব যে কোথায় চলে গেছেন, কেউ জানে না। তাঁর খবর কেউই আর বলতে পারল না।
------
ধুলামাটির বাউল আগের পর্বগুলি পাবেন এই লিংকে