ছন্দা হাঁপাতে হাঁপাতে বললেন, ‘মেহুল মারা গেছে।’
বসন্ত সাহা অবাক হয়ে বললেন, ‘মেহুল! হু ইজ মেহুল? সে কে?’
ছন্দা কাঁপা গলায় বললেন, ‘মুকুরদের পরিচিত। কাল পার্টিতে ছিল মেয়েটি। অল্প বয়স। তুমি দেখনি?’
বসন্ত সাহা মাথা নাড়লেন। অনুকূলবাবুও মনে করতে পারলেন না। বিস্ফারিত চোখে বললেন, ‘কাল সেও পার্টিতে ছিল! কী ভাবে মারা গেল?’
ছন্দা থেমে থেমে ঘটনাটা বললেন।
মেহুল মেয়েটি একা বালিগঞ্জের ফ্ল্যাটে থাকে। আজ সকালে কাজের লোক গিয়ে দেখে দরজা বন্ধ। সে বারবার ডোরবেল টেপে। কেউ দরজা খোলে না। সাধারণত এরকম হয় না। মেহুল একদিনের জন্য বাইরে গেলেও জানিয়ে যায়। ফোন করে দেয়। এতবার বেল বাজানোর পর কাজের মাসির সন্দেহ হয়। সে দরজায় চাপ দিয়ে দেখে দরজা ভিতর থেকে বন্ধ। এরপর সে ভয় পায়, লোকজন ডেকে আনে। দরজা ভাঙা হয়। দেখা যায় মেহুল সম্পূর্ণ নগ্ন অবস্থায় বাথরুমে সামনে উপুড় হয়ে পড়ে আছে। বমিও করেছে। ওই ফ্ল্যাটে একজন ডক্টর থাকেন। তিনি আসেন। পরীক্ষা করে জানেন, মেয়েটি মারা গেছেন এবং কাল রাতেই মারা গিয়েছে। শরীরে রাইগার মর্টিস শুরু হয়ে গিয়েছে। ডক্টরের ধারণা, কড়া ধরনের কোনও পয়েজনের কারণ মৃত্যু।’
বসন্ত সাহা থমথমে মুখে বললেন, ‘তোমায় এত কে খবর দিল?’
‘তন্ময়ের কাছে ফোন এসেছে। মেহুলের এক সময়ের হাজব্যান্ড।’
বসন্ত সাহা বললেন, ‘তন্ময় ছেলেটি ঠিক আছে?’
ছন্দা বললেন, ‘সে তো আমাদের সঙ্গেই ছিল। মুকুরের কাছে। একসময়ে সুনন্দর অফিসে ও আর মেহুল চাকরি করত। এখন সেপারেশনে রয়েছে।’
আরও পড়ুন, সন্মাত্রানন্দের ধুলামাটির বাউল
বসন্ত সাহা উত্তেজিত ভাবে বললেন, ‘আমাকে ওই মেয়ের ঠিকানাটা দিতে পারবে।’
ছন্দা বললেন, ‘আমি জানি না। এই অবস্থায় মুকুরকে জিজ্ঞেস করা ঠিক যাবে না। ওই এলাকার পুলিশ জানবে। নিশ্চয় ফ্ল্যাটের লোকেরা থানায় ফোন করেছে।’
বসন্ত সাহা বললেন, ‘আচ্ছা, আমি দেখে নিচ্ছি। বালিগঞ্জ তো? এই তো কাছেই হবে।’
ছন্দা বললেন, ‘তুমি কি ওখানে যাচ্ছ?’
বসন্ত সাহা চিন্তিত ভঙ্গিতে বললেন, ‘হ্যাঁ, যেতে হবে। তোমাকে গাড়ি পাঠিয়ে দিচ্ছি।’
‘আমাকে গাড়ি পাঠাতে হবে না। আমি ফোন করে ক্যাব ডেকে নেব।’
বসন্ত সাহা নিচু গলায় বললেন, ‘মুকুর সুনন্দর রিলেটিভরা কেউ এসেছে?’
ছন্দা একটু চুপ করে থেকে বললেন, ‘ওদের খুব কিছু আত্মীয় টাত্মীয় আসবে বলে মনে হয় না। মুকুরের কাছ থেকেই শুনেছিলাম, ও সবার সঙ্গে তেমন যোগাযোগ রাখে না।’
বসন্ত সাহা বললেন, ‘কেন!’
ছন্দা বললেন, ‘অতটা জানি না। শুনেছি বাচ্চা টাচ্চা হয়নি বলে আত্মীয়রা বড্ড জ্বালাতন করে।’
অনুকূল রায় বললেন, ‘ননসেন্স। আজকের যুগেও এসব হয়!’
ছন্দা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, ‘আর কী, এখন তো সব শেষ হয়ে গেল।’
বসন্ত সাহা এবার ছটফট করে উঠলেন। অনুকূলবাবুর দিকে তাকিয়ে বললেন ‘ওসব এখন থাক, আমার সঙ্গে চলুন।’
অনুকূল রায় হতভম্ব হয়ে বললেন, ‘আমি! আমি কোথায় যাব?’
বসন্ত সাহা অনুকূলবাবুর হাত ধরে বললেন, ‘আমার সঙ্গে যাবেন ওই মেহুল মেয়েটির ফ্ল্যাটে যাবেন।’
অনুকূল রায় আরও অবাক হয়ে বললেন, ‘আমি গিয়ে কী করব?’
বসন্ত সাহা চোয়াল শক্ত করে বললেন, ‘গন্ধ চিনবেন। আমি বলে দিচ্ছি, এই কেস দুটোতে যেন আপনাকে এক্সপার্ট হিসেবে অ্যাপয়েন্ট করা হয়।’
গাড়িতে উঠে অনুকূলবাবু বললেন, ‘আপনি কি কোনওরকম ফাউল প্লের সিগন্যাল পাচ্ছেন মিস্টার সাহা?’
বসন্ত সাহা স্টিয়ারিঙে হাত রেখে বললেন, ‘বুঝতে পারছি না। সেই কারণে অস্বস্তি হচ্ছে। আপনার গন্ধের ওপর অনেকটা নির্ভর করবে।’
গাড়ি চালাতে চালাতেই পর পর ফোন করতে লাগলেন বসন্ত। প্রথম ফোনটা থানায়।
‘স্যার, আমরা খবর পেয়ে রিচ করে গিয়েছি।’
‘একজন লেডি কনস্টেবল পাঠান।’
‘পাঠিয়েছি।’
‘আমাদের ডক্টর কেউ নেই ?’
‘স্যার দরকার হবে না, পোস্টমর্টেমে হলেই বোঝা যাবে।’
আরও পড়ুন, দেবেশ রায়ের স্মৃতিকথন মনে পড়ে কী পড়ে না
‘ঠিক আছে। খবর দিয়ে দিন, আমি পৌছোবার আগে কেউ যেন কোনও জিনিসে হাত না দেয়। বিশেষ করে তন্ময় বলে একজন আছেন, ওই মহিলার এক্স হাজব্যাণ্ড। ও যেন কিছু টাচ না করে।’
বসন্ত সাহা পরের ফোনটা করলেন সাগ্নিক মুখার্জিকে। এই ছেলেটি বছর তিনেক হল পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগে এসেছে। বয়স খুব বেশি হলে তেত্রিশ চৌত্রিশ বছর। আনইম্প্রেসিভ, আনস্মার্ট চেহারার ছেলেটিকে দেখলে ভরসা করা মুশকিল। পুলিশ বলে তো মনেই হয় না। মনে হয়, এই অফিসার ক্রিমিনাল ধরবে কী! অথচ এমন বুদ্ধিমান,স্মার্ট ছেলে গোয়েন্দা বিভাগ খুব কমই পেয়েছে। অনেক বড় অফিসারের মতো বসন্ত সাহাও ছেলেটিকে পছন্দ করেন। তিনি মনে করেন, সাগ্নিকের চোখে না পড়বার মতো চেহারা, বোকাসোকা লুক, নিজেকে আড়ালে রাখবার ভঙ্গি কাজে অনেক বেশি সাহায্য করে। ও অনেক সহজে লোকের মধ্যে ঢুকে যেতে পারে। ক্রিমিনালরা ওকে চট করে সন্দেহ করতে পারে না।
‘সাগ্নিক, হাতে কটা ফাইল ?’
ফোনের ওপাশ থেকে সাগ্নিক বলল, ‘দুটো স্যার। একটা চুরি, একটা মার্ডার।’
বসন্ত বললেন, ‘একটা কাজে আমাকে অ্যাসিস্ট করতে পারবে?’
সাগ্নিক বলল, ‘ইটস মাই প্লেজার স্যার। আপনার সঙ্গে কাজ করবার জন্য ডিপার্টমেন্টের সবাই তো মুখিয়ে থাকে।’
বসন্ত সাহা হেসে বললেন, ‘তবে একটা শর্ত আছে সাগ্নিক।’
‘বলুন স্যার। যা বলবেন, মেনে নেব।’
বসন্ত সাহা বললেন, ‘কেসটা কিন্তু তুমি সলভ করবে না, করব আমি। আগের একটা কেস রঞ্জনী আগেই সলভ করে আমাকে একেবারে লজ্জার মধ্যে ফেলেছিল।’
ফোনের ওপাশে সাগ্নিক হেসে বলল, ‘কার সঙ্গে আমার তুলনা করছেন স্যার! রঞ্জনী ম্যাডাম ইজ ব্রিলিয়ান্ট। আমি ওঁর নখের যুগ্যি নয়। স্যার কেসটা কী জানতে পারি?’
বসন্ত সাহা বললেন, ‘অবশ্য পারবে। আপাতত শুনে রাখ ফুড পয়জনিং। তবে কেস এখন কেস হয়ে ওঠেনি সাগ্নিক। আমার অস্বস্তির মধ্যেই রয়েছে। মে বি আমি বেশি ভাবছি। ইটস অ্যান অ্যাকসিডেন্ট।’
সাগ্নিক ওপাশ থেকে বলল, ‘আপনি বেশি ভাববেন না স্যার। নিশ্চয় কিছু একটা আপনাকে প্রিক করেছি।’
‘হ্যাঁ করছে। ঘটনা আমার সামনে ঘটেছে কিন্তু কিছু বুঝতে পারিনি। এটা মেনে নিতে পারছি না। যাক রেডি থেকো লাগলে ডাকব।’
বাথরুমে কাছে সাদা কাপড়ে ঢাকা নগ্ন লাশ। কে বলবে, গতকাল সন্ধ্যেবেলা এই মেয়ে চোখ ধাঁধানো পোশাকে সেজেছিল? সাদা লম্বা ঝুলের কুর্তার সঙ্গে পরেছিল শাড়ি। সেই শাড়ির রঙ ছিল স্যাফ্রন। স্ট্রাইপও ছিল। অনেকটা লম্বা করে ফেলা সেই আঁচল ছিল ড্রেপিং করা। তবে। ছিপছিপে চেহারা এই মেয়েটিকে এতই ভাল দেখাচ্ছিল যে অনেক পুরুষই আড়চোখে দেখছিল।
বাথরুম বেডরুমের একপাশে। বোঝাই যাচ্ছে, বিছানা থেকে উঠে বাথরুমে যাওয়ার মুখে মেয়েটি হমড়ি খেয়ে পড়ে। অনুকূল রায়কে নিয়ে বসন্ত সাহা ডেডবডির পাশে গিয়ে দাঁড়ালেন। লেডি কনস্টেবল, লোকাল থানার ওসি সরে দাঁড়ালেন। বসন্ত চাপা গলায় বললেন, ‘গন্ধ?’
অনুকূল রায় লাশের মাথার কাছে হাঁটু মুড়ে বসলেন। হাত বাড়িয়ে মেহুলের মাথার ওপর থেকে কাপড় সরালেন। মেয়েটির মুখে যন্ত্রণার ছাপ নেই। যেন নিশ্চিন্তে ঘুমোচ্ছে।
অনুকূলবাবু লম্বা করে শ্বাস নিলেন। একবার, দু’বার, তিনবার। তারপর উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, ‘এক গন্ধ। যদিও গন্ধ ফিকে হয়ে গিয়েছে।’
বসন্ত সাহা মুখ শক্ত করে একটুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, ‘তাহলে ধরে নেওয়া যেতে পারে পয়জনটা সেম ?’
অনুকূলবাবু বললেন, ‘পসিবিলিটি উড়িয়ে দেওয়া যায় না।’
ডেডবডি পোস্টমর্টেমের জন্য নিয়ে যেতে বলে বসন্ত সাহা ঘর ফাঁকে করতে বললেন। এমনকি তন্ময়কেও চলে যেতে হল। দ্রুত ঘরের চারপাশে চোখ বোলালেন। তারপর এগিয়ে এলেন বিছানার কাছে। বালিশ, চাদর পরিপাটি। দেখে মনে হচ্ছে না রাতে কেউ এখানে শুয়েছে। খাটের একপাশে সাদা লম্বা ঝুলের কুর্তা আর একটা স্যাফ্রন রঙের শাড়ি অগোছালো ভাবে পড়ে। কালো রঙের ব্রা, প্যান্টি রয়েছে। কালকের পোশাক? হতে পারে। মেয়েটি কি পোশাক খোলবার সময় অসুস্থ হয়ে পড়েছিল ? শোওয়ার আগেই?
হঠাৎই অনুকূলবাবু বলেন, ‘ওটা কী?’
খাটের নিচে কতগুলো কাগজের টুকরো। কাগজ নয়, কোনও ফটো কুচিকুচি করে ছেঁড়া হয়েছে।
বসন্ত সাহা হুমড়ি খেয়ে বসে পড়লেন।
————
এই ধারাবাহিক গোয়েন্দা উপন্যাসের সব পর্ব এক সঙ্গে পড়তে ক্লিক করুন এই লিংকে