মুকুরের আর তিনজনকে ফোন করা বাকি। তাহলেই তেরোজনের লিস্ট কমপ্লিট হবে। লিস্ট তৈরি করবার সময় মুকুর একবার ভেবেছিল, আনলাকি থার্টিন হয়ে যাচ্ছে না তো? পরে মনে পড়ল, তেরো কোথায়? সে আর সুনন্দও তো রয়েছে। হোস্ট কি পার্টিতে জয়েন করে না? অবশ্যই করে। ক্যাটারার সবারই প্লেট গুনবে। তাহলে আর আনলাকি থার্টিন কোথায়?
যে তিনজনকে বলা বাকি সেই তিনজনই একা আসবে। সিঙ্গল। যদিও তন্ময় আর মেহুলিকে কি একা বলা যায়? এরা কিছুদিন আগে পর্যন্ত স্বামী স্ত্রী ছিল। এখন মিউচ্যুয়াল ডিভোর্স নেওয়ার জন্য সেপরেশনে আছে। বিয়ের আগে থেকেই এদের সঙ্গে পরিচয় মুকুরদের আলাপ। একসময়ে দুজনেই একসময় সুনন্দর কলিগ ছিল। পরে অফিস বদলায়। আলাদা আলাদা অফিসে চলে যায়। অফিস ছাড়বার সময় সুনন্দ একদিন বাড়িতে ডেকে খাইয়েছিল। সেই সময় থেকে আলাপ। আলাপ সুনন্দর মারফত হলেও ঘনিষ্ঠতা বেশি হয়ে উঠেছিল মুকুরের সঙ্গে। ওদের ঝামেলার পর সেই ঘনিষ্ঠতা খানিকটা কমেছে। তারপরেও ওদের নেমন্তন্ন করতেই হয়েছে। নইলে সেটা একটা বিশ্রী ব্যাপার হতো। সত্যি কথা বলতে কী এই ফ্ল্যাটটা ওদের জন্যই পাওয়া গেছে। আরও নির্দিষ্ট করে বললে, ফ্ল্যাটটা ওরাই ডেভলপারের কাছে থেকে বুক করছিল। তখনও ওরা একসঙ্গে। মেহুল একদিন মুকুরের কাছে এসে উপস্থিত হল। সেই প্রথম মুকুর ওদের ঝগড়ার কথা জানতে পারল। জেনে খুবই অবাক হল।
‘মুকুর, তোমাকে একটা জরুরি কথা জানাতে এসেছি।’
মুকুর বলল, ‘তার আগে বলো কী খাবে?’
মেহুল বলল, ‘এটা ভাল বলেছো। খিদে পেয়েছে। বাড়িতে কী আছে?’
মুকুর বলল, ‘তেমন কিছু নেই, করে দেব? আচ্ছা জোমাটোতে বলে দিচ্ছি। মিক্সড্ চাও বলি?’
তখনও মুকুর বুঝতে পারেনি এমন একটা কাণ্ড ঘটে গেছে। মাস দুয়েক ওদের সঙ্গে যোগাযোগও ছিল না। স্কুলে চাপ ছিল খুব। মেহুল তন্ময় কোভালম্ না কোথায় বেড়াতে গিয়েছিল। তাছাড়া অনেকক্ষণ পর্যন্ত খুব স্বাভাবিক ব্যবহার করছে মেহুল। অনেকক্ষণ কেন? পুরোটাই বলা যায়। কোনোরকম উত্তেজিত গলাই ছিল না। বোঝাই যাচ্ছিল না, এতবড় ঘটনা একটা ঘটে গেছে।
আরও পড়ুন, সন্মাত্রানন্দের সিরিজ ধুলামাটির বাউলের প্রকাশিত পর্বগুলি
জোমাটোতে অর্ডার সেরে মুকুর বলল, ‘তন্ময়ের খবর কী?’
‘খুব ভালো। অফিসে ওর একটা লিফট হয়েছে।’
মুকুর বলল, ‘তাই নাকি! ভেরি গুড। ওকে ফোন করে কনগ্রাচুলেশন জানাতে হবে।’
মেহুল বলল, ‘ওকে তো ধরাই যায় না। হিল্লি দিল্লি করে বেড়াচ্ছে। মুম্বাই, পুনে তো প্রতি মাসে একবার করে যেতে হয় শুনলাম। ওদিকে ট্রান্সফার হত পারে।’
মুকুর বলল, ‘সেকী! মেহুল তুমি কী করবে? তুমিও বরং ট্রান্সফার নিয়ে নাও। এতো একেবারে সুনন্দর মতো। সেও তো ঘন ঘন মুম্বাই আর বেঙ্গালুরু যাতায়াত করে।’
মেহুল হেসে বলল, ‘তুমি ট্রান্সফার নিচ্ছো না কেন মুকুর? স্যারের সঙ্গে চলে যাবে।’
মুকুরকে নাম ধরে ডাকলেও, মেহুল তন্ময় এখনো পুরোনো অভ্যেস মতো সুনন্দকে ‘স্যার’ ডাকে।
মুকুর বলল, ‘আমার কি সেই অপশন আছে? আমার স্কুলের তো আর ব্রাঞ্চ নেই, আর অন্য স্কুলে গিয়ে যে জয়েন করব, তারও উপায় নেই। তাছাড়া তোমাদের স্যার তো আর পাকাপাকি চলে যায়নি। যাতায়াত করছে। শেষ পয়েন্টটা কী জানো? কলকাতা ছাড়তে ইচ্ছে করে না।’
মেহুল অন্যমনস্ক হয়ে বলল, ‘আমি ছেড়ে দেব। খুব চেষ্টা করছি মুকুর। দেশের বাইরেই চলে যেতে চাই। ইউরোপে তো ওয়ার্ক ভিসা দিচ্ছে না, মিডল্ ইস্ট দেখব।’
মুকুর অবাক হয়ে বলল, ‘সেকী! তুমি একদিকে তন্ময় একদিকে! তোমরা তো কলকাতায় ফ্ল্যাটও নিচ্ছো।’
মেহুল ঠোঁটের কোণে হেসে বলল, ‘দূরে দূরে থাকাই তো ভাল।’
ডোরবেল বেজে উঠল। খাবার এসেছে।
মুকুর উঠে দাঁড়িয়ে ভুরু কুঁচকে বলল, ‘মানে! কী হেঁয়ালি করছো মেহুল?’
মেহুল বলল, ‘দাঁড়াও, মানে বলছি। আগে খেয়ে নিই।’
সেদিন তৃপ্তি করেই খেয়েছিল মেহুল। চাও –এর সঙ্গে গার্লিক চিকেনও নিয়েছে মুকুর। টিস্যুতে মুখ মুছে মেহুল বলল, ‘মুকুর, উই ডিসাইডেড টু ব্রেক দ্য রিলেশন।’
মুকুর বলল, ‘মানে!’
মেহুল বলল, ‘ভেরি সিম্পল। আমার ডিভোর্সে যাচ্ছি। অলরেডি সেপারেশন শুরু করেছি। মাথা গরম, রাগারাগি কিছু নয়, মিউচুয়ালি আমরা সরে যাচ্ছি।’
মুকুর থতমত খেয়ে বলল, ‘কী বলছো মেহুল! হঠাৎ কী হল? এই তো তোমারা বেড়াতে গিয়েছিলে।’
মেহুল বলল, ‘ওখানে গিয়েই আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আর নয়। এনাফ ইজ এনাফ।’
মুকুর কী বলবে বুঝতে পারছিল না। সে চুপ করে রইল। এমন সুন্দর একটা কাপলের কী হল! সে কফি করে আনল। মেহুল কফি মাগে চুমুক দিয়ে নিজে থেকেই বলতে শুরু করল। গলায় খানিকটা অন্যমনস্ক ভাব, খানিকটা অভিমান, খানিকটা নতুন করে জীবনকে দেখা। তবে উচ্চকিত নয়। যাকে আমরা ‘লাউড’ বলি।
‘মুকুর, তন্ময় নতুন করে প্রেমে পড়েছে।’
মুকুর চুপ করে রইল। সে কী বলবে? এই পারসোনাল কথায় মন্তব্য হয় না। সে যে শুনতে চাইছে এমনটাও নয়। তারপরেও মেয়েটা যদি বলে মন হালকা করতে চায় তাহলে তো বলতে দিতে হবেই। মেহুল নিচু গলায় বলতে থাকে।
‘সেই মেয়েটির পরিচয় আমি জানিনা, জানতে চাইও না। শুনেছি অতিরিক্ত সুন্দরী, অতিরিক্ত বুদ্ধিমতী। কোনো একটা বড় কোম্পানির রিসার্চ উঁইং–এ রয়েছে, একাধিক বিয়ে। ফলে কামশাস্ত্র বিষষটি খুব ভাল করেই রপ্ত করেছে। মুকুর তোমাকে এখন বলতে এখন আর সমস্যা নেই যে তন্ময় সেক্সুয়ালি ভেরি হট। তার আর্জ ভেরি স্ট্রং। আর পাঁচটা ভেতো বাঙালির মতো শুধু সন্তানের জন্ম দিতে নয়, সে সেক্স এনজয় করে। মুখে বলে, মানুষের কাছে এটা একটা ব্লেসিংসের মতো। জীবজগতে সকলেই শরীরের তাগাদায় অন্য শরীরের সঙ্গে মিলিত হয়। হরমোনাল ফাংশন। একমাত্র মানুষই জানে এনজয় করতে। মুকুর, হি ইজ অলসো ভেরি এক্সপার্ট। কখন টিমিড, কখন অ্যাগ্রসিভ। ওর ফোর প্লে ভেরি ইন্টারেস্টিং এণ্ড ইউনিক। এমন বহুদিন গেছে দিনে উই মেট টোয়াইজ অর মোর। যে কোনও মেয়ের কাছেই পুরুষ হিসেবে তন্ময় লোভনীয়।’
আরও পড়ুন, দেবেশ রায়ের স্মৃতিকথন মনে পড়ে কী পড়ে না
মুকুর মাথা নামাল। তার অস্বস্তি হচ্ছে। কোনো মেয়ে এতো খোলাখুলি যদি নিজের সেক্স লাইফ নিয়ে কথা বলে লজ্জা পাওয়ারই কথা।
মুকুর অস্ফুটে বলল, ‘ঠিক আছে...শুধু শরীর নয় মেহুল ভালোবাসার পিছনে আরও অনেক কিছু থাকে। ভরসা থাকে।’
মেহুল বলল, ‘থাকে হয়তো, সেটা বুঝতে সময় লাগে। সে সময় আমাদের এখনও আসেনি। যাই হোক, বেশ কিছুদিন ধরে আমার মনে হচ্ছিল, বেড পার্টনার হিসেবে তন্ময়ের আমাকে আর পছন্দ নয়। সরি, পছন্দ নয় কথাটা ঠিক নয়। স্যাটিসফায়েড হচ্ছে না। আদর করতে গিয়ে মাঝখানে যেন বোরড হয়ে যাচ্ছে। অথবা ফিনিশ করছে রুটিন মাফিক। তখনই আমার সন্দেহ হয়। বেড়াতে গিয়ে আমি ওকে সরাসরি জিগ্যেস করি। সে কনফেস করে। বলে, আনফরচুনেট হলেও কথাটা ঠিক। তার অনেক বেটার এক্সপিরিয়েন্স হয়েছে। এরপরই সে তার নতুন বান্ধবীর কথা বলে। নাম–পরিচয় ছাড়াই বলে। আমি খুব ঠান্ডা মাথায় বিষয়টা নিয়ে ভাবি। যে পুরুষ তার বেঁচে থাকার অন্যতম আনন্দটাই আমার কাছ থেকে পাচ্ছে না, তাকে ধরে রাখবার যুক্তি কোথায়? আমি ডিভোর্সের প্রোপোসাল দিই। তন্ময় একটু গাঁইগুঁই করে অ্যাকসেপ্ট করে নিয়েছে।’
মুকুর আশ্চর্য হল। তন্ময়কে দেখে তো বোঝা যায় না। অবশ্য বিষয়টা এতোটাই পার্সোনাল যে বাইরের কারও বোঝা সম্ভব নয়।
মেহুল শুকনো হেসে নিজেকে যেন সামলাতে চাইল। বলল, ‘যাক। যা হওয়ার ভাল হয়েছে। তন্ময় তন্ময়ের মতো লাইফ এনজয় করছে, আমি আমার মতো। এটা কোনো দোষের ব্যাপার নয় মুকুর। স্বামী, স্ত্রী কোনো জীবজন্তু নয় যে তার সঙ্গে শুধু মায়া মমতা, করুণার সম্পর্ক নিয়ে বেঁচে থাকতে হবে। আই অ্যাম হ্যাপি। বহু দাম্পত্যের ভিতরে বিষ থাকে। ধীরে ধীরে শরীরে, মনে ঢুকতে থাকে। যখন জানা যায় তখন আর করবার মতো কিছু থাকে না। এটা অনেক ভালো।’
মুকুর বলল, ‘তুমি শান্ত হও মেহুল।’
মেহুল ঝাঁঝের সঙ্গে বলল, ‘তুমি কি আমাকে অশান্ত দেখছো মুকুর? অশান্ত হলে তো ওই মেয়েটিকে আমি বিষ দিয়ে মেরে ফেলবার কথা ভাবতাম। তা কি আমি ভাবছি? ডিভোর্সের জন্য গেলে কী হবে আমাদের সম্পর্ক এখন নরমাল। বিভিন্ন অকেশনে আমরা একসঙ্গে যাইও।’ কথা শেষ করে ঠোঁটের ফাঁকে অর্থবহ হাসল মেহুল।
বলল, ‘ওসব বাদ দাও। আর একটা জরুরি কথা আছে। তোমরা ফ্ল্যাট খুঁজছিলে না?’
মুকুর প্রসঙ্গ পালটানোর জন্য তাড়াতাড়ি বলল, ‘হ্যাঁ, খুঁজছিলাম তো।’
মেহুলি সোফায় হেলান দিয়ে বলল, ‘আমরা যে ফ্ল্যাটটা বুক করেছিলাম, সেটা ছেড়ে দিচ্ছি। কলকাতায় থাকব কিনা তার ঠিক নেই। আমি তন্ময় দুজনেই ভেবেছি, প্রথমে স্যারকেই বলব। তোমরা যদি রাজি না হও তখন অন্য কোথাও বেচব। মুকুর ফ্ল্যাটটা যদি নাও আমার ভাল লাগবে। মনে হবে নিজেরই রইল।’
তন্ময়ও সুনন্দকে দেখা করে এই প্রস্তাব দিয়েছিল। তখনও তো ফ্ল্যাট কমপ্লিট হয়নি। শুধু কাঠামো ছিল। মুকুররা অনেক ভাবনাচিন্তা করে সেই ফ্ল্যাট নিয়েছে। মেহুল, তন্ময়কে নেমন্তন্ন না করলে হয়? সুনন্দ শুনে চুপ করে গিয়েছিল, তবে না বলেনি। ফ্ল্যাটে ঢোকবার সময় বললেও ওরা আসতে পারেনি। কলকাতায় ছিল না। এখন আছে। মেহুল তো বলল, বিভিন্ন অনুষ্ঠানে ওদের দেখা হয়। তাহলে সমস্যা কী?
মেহুল আর তন্ময়ের জন্য মেসেজ রাখল মুকুর। বাকি রইল একজন।
এই উপন্যাসের সব পর্ব একসঙ্গে পড়তে ক্লিক করুন এই লিংকে