/indian-express-bangla/media/post_attachments/wp-content/uploads/2019/08/pracheta-geature-general.jpg)
অলংকরণ- অরিত্র দে
দুজনে তৈরি হয়ে গাড়িতে উঠতে খুব বেশি হলে সাত –আট মিনিট সময় লাগল।
বসন্ত সাহা এই ধরনের তাড়াহুড়োয় অভ্যস্ত। তিনি পুলিশ। বেশিরভাগ সময়েই ছোটাছুটি, লাফাঝাঁপির মধ্যে থাকতে হয়। ছন্দার অসুবিধে হয়। সে স্কুলটিচার। লাফাঝাঁপির কোনও দরকার পড়ে না। স্টিয়ারিঙে বসতেই এক হাতে মোবাইলের নম্বর টিপতে শুরু করলেন বসন্ত সাহা। থানা, কন্ট্রোলরুমে। ফোন কেউ ধরছে না। এত সকালে ফোন না ধরাটা অস্বাভাবিক নয়। সারা রাত জেগে ডিউটি দেওয়ার পর, সকালে কিছুক্ষণের জন্য এমনটা হতেই পারে। তাছাড়া ডিউটি শিফটিং থাকে। কিন্তু উপায় নেই, চে্ষ্টা চালাতেই হবে। ইচ্ছে করলে অন্য কোনও অফিসারকে ফোন করে দায়িত্বটা দেওয়া যায়। বসন্ত সাহা চান না। তিনি নিজে যে কাজটা পারছেন না, অন্য কেউ পারবে কী করে?
ছন্দা থমথমে গলায় বললেন, ‘গাড়ি চালাতে চালাতে ফোন কোর না।’
বসন্ত সাহা বললেন, ‘জরুরি একটা কাজ করতে হবে।’
ছন্দা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, ‘এখন আর জরুরি অজরুরি। যা হবার তো হয়েই গেছে। ইস্ মুকুরের জন্য এতো খারাপ লাগছে! কী করে মেয়েটা সামনে গিয়ে দাঁড়াব বুঝতে পারছি না।’
বসন্ত সাহা অন্যমনস্ক ভাবে বললেন ,‘সুনন্দর হার্টের কোনও প্রবলেম ছিল। সামান্য একটা ফুড পয়েজনিং...ছিল কোনও হার্টের সমস্যা?’
আরও পড়ুন, সন্মাত্রানন্দের ধুলামাটির বাউল
ছন্দা একটু ভেবে বললেন, ‘দাঁড়াও মনে করি। হ্যাঁ মনে পড়ছে, কী একটা সমস্যা ছিল যেন। মুকুর একবার বলেছিল যেন, ডাক্তারের কাছে গিয়েছিল। কী একটা হার্ট বিটের সমস্যা, ছোটো সমস্যা।’
বসন্ত সাহা গাড়ির স্পিড বাড়িয়ে বললেন, ‘হতে পারে সেটাই শেষ রাতে ট্রিগার করেছে। হার্টে ধাক্কা মেরেছে, নিতে পারেনি।’
ছন্দা বললেন, ‘ইস্ মুকুর মেয়েটা কত ছোটো...।’
বসন্ত সাহা বললেন, ‘বড় হলেও একইরকম দুঃখজনক হত। একটা বিষয় আমার খটকা লাগছে ছন্দা। কাল সুনন্দ যা খেয়েছে, আমরাও তাই খেয়েছি। এবং সেটাও খুব সামান্য। তাহলে সমস্যাট ওর একার কেন হল?’
ছন্দা বললেন, ‘তুমি বলছিলে না, আগেই বাইরে হয়তো কিছু খেয়ে থাকতে পারে। তার এফেক্ট হয়েছে হয়তো।’
বসন্ত সাহা কাঁধ ঝাঁকিয়ে বললেন, ‘এতো বড় এফেক্ট! একেবারে মারা যাবে!’
সিটের পাশে রাখা ফোন বেজে উঠল। দ্রুত ফোন কানে নিলেন বসন্ত।
‘স্যার, থানা থেকে বলছি।’
বসন্ত সাহা দ্রুত বললেন, ‘শুনুন একটা বাড়ির অ্যাড্রেস বলছি, এখনই যাবেন। ফ্ল্যাটের নাম দ্য ড্রিম। গার্ড বসান। কেউই যেন কিছুতে হাত না দেয়। বিশেষ করে কিচেন, ডাইনিং এ কেউ যেন ঢুকতে না পারে। কোনও ওয়েস্ট বিনেও যেন কেউ হাত না দেয়। ওযেস্ট বিন জানেন তো? বাসি খাবার দাবার ফেলবার জায়গা।’
ওপাশ থেকে অফিসার বললেন, ‘এখনই যাচ্ছি।’
‘যান। নেক্সট ইনস্ট্রাকশন পরে পাঠাচ্ছি।’
ছন্দা অবাক হয়ে বললেন, ‘বাড়িতে পুলিশ পাহারা বসিয়ে কী হবে!’
বসন্ত সাহা বললেন, ‘জানি না কী হবে। তবে মনে হল, বসানো দরকার। বাড়ির কোনও খাবার থেকে কিছু ঘটল কিনা জানতে হবে।’
ছন্দা নিজের মনে বলল, ‘সত্যি পার্টিটা খুব ভাল শুরু হয়েছিল। হাসিখুশি, আনন্দের।’
ঘটনা তাই। দ্য ড্রিমের জন্মদিনের পার্টি জমে উঠেছিল। আটটার মধ্যে গেস্টরা সবাই চলে এলে মুকুর হেসে বড় করে জিভ কেটে বলল, ‘সবাই এসেছে বলে আমি ভীষন ভীষন খুশি। সকলকে ধন্যবাদ।’
উজ্বল বলল, ‘তুই ধন্যবাদ দেওয়ার কে মুকুর? ধন্যবাদ তো দেবে তোর ফ্ল্যাট।’
মুকুর বলল,‘অবশ্যই। আমি ফ্ল্যাটের পক্ষ থেকে সবাইকে ওয়েলকাম জানাচ্ছি। কিন্তু একটা মস্ত ভুল করেছি।’
কিশোর বলল, ‘কী ভুল মুকুরদি? খাবার বলতে ভুলে গেছ নাকি?’
আরও পড়ুন, দেবেশ রায়ের স্মৃতিকথন মনে পড়ে কী পড়ে না
মুকুর হেসে বলল, ‘নানা, তা নয়। গেস্ট তালিকা আমি করছিলাম তেরোজনের। কিন্তু এখন দেখছি হিসেব ভুল করেছি। নিমন্ত্রিত আসলে পনেরো।’
কঙ্কনা, নয়নিকা, দিশা, মেহুল হই হই করে উঠল। সবথেকে বেশি হইহই করল হৈমন্তী। সে বলল,‘তাহলে এক্সট্রা দুজন কে এসে পড়ল?’
মজার ব্যাপার হল, কালকের পার্টিতে মেয়েরা অনেকেই শাড়ি পরে এসেছিল। যেন শাড়ি ড্রেস কোড ছিল! একেক জন একেক কায়দায় শাড়ি পড়েছিল। সবাইকে সুন্দর লাগছিল। তবে সব থেকে সুন্দর লাগছিল হৈমন্তীকে। সে পড়েছিল লাল চওড়া পাড়ের কাতান শাড়ি। জমি অলিভ গ্রিন। লাল নেটের লং ব্লাউজ। ডান পাশ থেকে আঁচল ড্রেপ করা। পরপর সাজানো বোতাম লাগা ব্লাউজের ভিতর আলতো দুটো বুক যেন উন্মুক্ত। কব্জির কাছের একটু অংশ ছাড়া শরীরের সবটাই ঢাকা ছিল। এমনকি ব্লাউজের গলা পর্যন্ত। তারপরে তাকে লাগছিল বাড়াবাড়ি ধরনের আকর্ষণীয়। এক কানে বড় এথনিক দুল। ডান হাতের আংটিও তাই। মুখে মেকাপ সামান্য। চুল দু’পাশ থেকে পাক খেয়ে নামিয়েছিল বুকের ওপর পর্যন্ত। এসে থেকে হৈমন্তী ছিল সবথেকে উচ্ছল।
হৈমন্তীর পরেই সুন্দর লাগছিল, মেহুলকে। সে সাদা লম্বা কুর্তার সঙ্গে স্যাফ্রন রঙের শাড়ি পরেছিল। শাড়িতে স্ট্রাইপ। তার আঁচলও ড্রেপিং করা। তবে সেই আঁচল ফেলা ছিল অনেকটা লম্বা করে। ছিপছিপে চেহারা এই মেয়েকে দেখাচ্ছিল বড্ড ভাল।
আলাপ হওয়ার হৈমন্তী তো মেহুলকে বলেই ফেলল, ‘তোমাকে হিংসে হচ্ছে।’
মেহুল হেসে বলল, ‘আমাকে তো সাজ দেখে হিংসে হচ্ছে, আর আমার যে হিংসে হচ্ছে তোমার মাথার ভিতরটা দেখে। ইচ্ছে করলেই তুমি আমার মতো সাজতে পারবে, তোমার মতো মাথা তো পাব না। আমি তোমার কথা মুকুরদির কাছ থেকে শুনেছি।’
উজ্জ্বলের স্ত্রী হিংসুটে নয়নিকাও শাড়ি পড়েছিল। গাজ্জি সিল্কে কচ্ছ বাঁধনি প্রিন্ট। শাড়ির রঙটাও চমৎকার। মন গ্রিন, কালো–সাদা শেডস্ রয়েছে। ছন্দা সাহা পরেছিলেন তাঁতের শাড়ি। চওড়া পাড়ে সুতোর কাজ। খুবই অভিজাত লাগছিল। তবে দিশা শাড়ি পরেনি। সে পরেছিল ড্রেস। ওয়েস্টার্ন কাট। এথনিক কায়দার এমব্র্য়ডারি করা। পোশাকটি অ্যসিমেট্রিকাল কাটের। একে বলে স্লিভসে বেল স্লিভ প্যাটার্ন। হাঁটুর ওপরে গিয়ে শেষ। দিশা নিজেই পোশাকের ব্যাখ্যা দিয়েছে। কঙ্কনাও শাড়ি পরেনি। সে পরেছিল খাদি লিনেনের শিফ্ট ড্রেস। হালকা নীল। নি লেন্থের এই পোশাকে পেটের কাছে ছোটো প্যাচ পকেট। নেকলাইনে সুতোর কাজ রয়েছে। মুকুর প্রথমে শালোয়ার পরেছিল। হৈমন্তী এসে তাকে জোর করে চেঞ্জ করাল।
‘যা শাড়ি পরে আয়। তুই না হোস্ট।’
মুকুর বলল, ‘সেই কারণেই তো শাড়ি পরিনি, ছোটাছুটি করতে হবে না।’
হৈমন্তী বলল, ‘তা হবে না। যা শাড়ি পরে আয়।’
মুকুর শাড়ি পরে এল। মুগা তসরের ওপর, শিবোরি প্রিন্ট। প্রিন্টও ভারি সুন্দর। টাই এন্ড ডাই প্রসেসে করা হয়েছে। সেই সঙ্গে রঙ মেলানো ব্লাউজ।
হৈমন্তী বলল,‘আজকের পার্টিতে তাহলে এটাই রহস্য। এক্সট্রা দুজনকে খুঁজে বের করতে হবে।’
পলাশ গলা খাঁকারি দিয়ে বলল, ‘মনে হয় আমরা। আমি আর কঙ্কণা।’
কঙ্কণা বলল, ‘একবারেই নয়। আমি কেন এক্সট্রা হতে যাব।’
মেহুল বলল, ‘আর কে এক্সটা আমি জানি না, তবে আমি যে অতিরিক্ত তাতে কোনও সন্দেহ নেই।’
কিশোর বলল, ‘কেন বাপু। আমাকে বাদ দিচ্ছ কেন?’
হৈমন্তী বলল, ‘নিজেদের মধ্যে ঝগড়া করে লাভ নেই। আমাদের পার্টি উপস্থিত রয়েছেন একজন তুখোড় গোয়েন্দা অফিসার। তাকেই বরং দায়িত্ব দেওয়া হোক। পার্টি শেষে তিনি এই রহস্যের কার্টেন রেজ করবেন।’
বসন্ত সাহা হেসে বললেন, ‘এটা কোনও ব্যাপারই নয়। আমি বলে দেব।’
এই সব কথার মাঝখানেই কেটেরারের লোকেরা এসে স্টার্টার দিয়ে গেল। দু একটা করে সকলেই মুখে দিল। সুনন্দ চুপচাপ ছিল। তার নাকি শরীরটা ভাল নয়। ম্যাজ ম্যাজ করছে। এবার সে বলল, ‘তাহলে বার ওপেন করা যাক?’
মুকুর হইহই করে বলল, ‘নানা। বার একটু পরে। আগে নেমপ্লেটের উদ্বোধন। তারপর কেক কাটা। মাই ডিয়ার গেস্টস্, আপনার শুনে খুশি হবেন, এই ফ্ল্যাটের নামকরণ করেছেন আমার বহুদিনের বন্ধু হৈমন্তী। সে–ই কেক এনেছে। আমি চাই হৈমন্তী নেমপ্লেটেরও ওপর থেকে ফুলের পর্দা সরিয়ে দিক। তারপর কেক কাটুক।’
সবাই হাততালি দিয়ে সায় দিয়েছিল।
বসন্ত সাহা নার্সিহোমের সামনে গাড়ি পার্ক করলেন। ছন্দাও নামলেন। তখনও তিনি জানেন না, শুধু সুনন্দর মৃত্যু নয়, আরও ভংয়কর খবর তাঁদের জন্য অপেক্ষা করছে।
———
এই ধারাবাহিক গোয়েন্দা উপন্যাসের সব পর্ব এক সঙ্গে পড়তে ক্লিক করুন এই লিংকে