Advertisment

আরও একজনের মৃত্যু, এও কি বিষে?‌: অনাবৃত ২৮

সুনন্দর মৃত্যর ঘটনা কি শুধুই অ্যাক্সিডেন্ট?‌ একটি দুর্ঘটনা মাত্র? নাকি অন্য কিছু?‌‌- প্রকাশিত হল প্রচেত গুপ্তের ধারাবাহিক গোয়েন্দা উপন্যাসের ২৮ তম পর্ব।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
Pracheta Gupta, Anabrito

অলংকরণ- অরিত্র দে

নার্সিংহোমের লাউঞ্জের একপাশে সারি সারি সোফা।

Advertisment

সেই সোফার একটায় মুকুর দু’‌হাতে মুখে চাপা দিয়ে বসে আছে। পাশে বসে আছে হৈমন্তী। মুখ থমথমে। সে বাঁ হাত দিয়ে মুকুরের একটা হাত শক্ত করে ধরে রয়েছে। ছন্দা এগিয়ে গিয়ে মুকুরের পিঠে হাত রাখতে মুকুর মুখ তুলল। তার দৃষ্টি শূন্য। সে কাঁদতেও পারছে না। বোঝাই যাচ্ছে, সু্নন্দর মৃত্যু এখন সে বিশ্বাস করতে পারেনি। একটু দূরে গোল হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে, দিশা, তন্ময়, উজ্জ্বল, কঙ্কণা, পলাশ, কিশোর। সবার চোখমুখ উদ্‌ভ্রান্ত। কিছুক্ষনের মধ্যেই স্ত্রী কাঁকনকে নিয়ে অনুকূল রায় এলেন।

আরও পড়ুন, সন্মাত্রানন্দের ধুলামাটির বাউল

বসন্ত সাহা ওদের পাশে গিয়ে দাঁড়ালেন।
পলাশ বলল, ‘‌স্যার এটা কী হয়ে গেল!‌’‌
বসন্ত সাহা বললেন, ‘‌ডাক্তারের সঙ্গে আপনাদের কথা হয়েছে?‌’‌
উজ্জ্বল বলল, ‘‌না, হয়নি। উনি এখনও নার্সিং হোমে এসে পৌছোননি। এবার আসবেন।’
‌বসন্ত সাহা বললেন, ‘‌কেটারার ছেলেটির কী নাম যেন?‌’‌
তন্ময় বলল, ‘ওখানে ছিলেন তো।‌ ‌কালই তো সুনন্দ আলাপ করিয়ে দিলেন। প্রতীক না কী নাম?‌ স্ত্রীকে নিয়ে এসেছিলেন।’‌
‌বসন্ত সাহা বললেন, ‘‌আপনাদের কারও কোনও সমস্যা হয়নি?‌’‌
দিশা বলল, ‘‌কই না তো!‌ আমরা সবাই তো একই খাবার খেয়েছি।’‌
বসন্ত সাহা চুপ করে খানিকক্ষণ ভাবলেন। বললেন, ‘‌মনে হচ্ছে, সুনন্দ বাইরের কিছু খেয়েছিল।’‌
উজ্জ্বল বলল, ‘‌তার রিঅ্যাকশন এতো পরে!‌’‌
বসন্ত সাহা নিচু গলায় বললেন, ‘‌পোস্ট মর্টেম হলে বোঝা যাবে। যাই ঘটুক খুব দুঃজনক।’‌
কঙ্কনা বলল, ‘‌আমি ভাবতেও পারছি না। এখনও ছবির মতো কালেকের সন্ধ্যেট আমার চোখের সামনে ভাসছে।’‌
দিশা বলল, ‘‌আমার কাছে গোটাটা ভিডিও করা রয়েছে। দ্য ড্রিমের নেমপ্লেটের ওপেন থেকে কেক কাটা পর্যন্ত এভরিথিং।’‌
বসন্ত সাহা ধীর পায়ে নার্সিংহোমের বাইরে এসে দাঁড়ালেন। ঝলমলে রোদ উঠেছে। যে কোনও ঘটনায় উতলা হওয়া তার অভ্যেসে নেই। কোনও একটা অ্যাক্সিডেন্ট হলেই তাকে ইনসিডেন্ট হিসেবে দেখতে হবে তার কোনও মানে নেই। দুর্ঘটনার সঙ্গে ঘটনার পার্থক্য রয়েছে। দুর্ঘটনা আকস্মিক হয়, ঘটনা ঘটানো হয়। দড়িকে সাপ ভেবে লাভ হয় না। পুলিশ যেমন ক্যাজুয়াল থাকবে না, তেমন ওভার রিঅ্যাকটিভও হবে না। সুনন্দর এই মৃত্যর ঘটনা কি শুধুই অ্যাক্সিডেন্ট?‌ একটি দুর্ঘটনা মাত্র?‌ বেশিটাই তাই মনে হচ্ছে। তারপরেও পয়েজনিংটা ঠিক কোথা থেকে হয়েছে জানা দরকার। অবশ্যই যদি সুনন্দর স্ত্রী এ বিষয়ে কমপ্লেন করে। পোস্টমর্টেম রিপোর্টের ওপরও নির্ভর করছে। তবে কোথায় একটা খচখচ করছে। কেন করছে এই মুহূর্তে বলতে পারবেন না বসন্ত সাহা, কিন্তু করছে।
নার্সিহোমের সামনে একটা সাদা গাড়ি এসে দাঁড়াল। অনুকূল রায় হন্তদন্ত হয়ে নামলেন। বসন্তবাবুকে দেখে এগিয়ে এলেন।
‘‌কী বিশ্রী একটা ব্যাপার হয়ে গেলে বলুন তো মিস্টার সাহা।’‌
বসন্ত সাহা বললেন,‘‌আপনার আর মিসেসের শরীর ঠিক রয়েছে তো?‌’‌
অনুকূলবাবু বললেন, ‘‌একেবারে ওকে। ওই ঘটনার পর আমরা তো আর কেউই কিছু মুখে দিইনি। পার্টিটাই তো ভেস্তে গেল।’
‌বসন্ত সাহা বললেন, ‘‌খুব আনফরচুনেট।’‌
অনুকূলবাবু বললেন, ‘‌কেমন করে এতটা হল বুঝতে পারছেন কিছু?‌’‌
বসন্ত সাহা বললেন, ‘‌ডাক্তার বলতে পারবেন।’
‘‌পোস্টমর্টেম হলে হয় তো দেখা যাবে, বিষক্রিয়াটা আসল নয়, সুনন্দর অন্য কোনও মেজর প্রবলেম.‌.‌.‌।’
বসন্ত সাহা বললেন, ‘‌ছিল। আমার মিসেস আজ সকালেই বলছিলেন। ওর হার্টের কী একটা সমস্যা ছিল।’
অনুকূলবাবু বললেন, ‘‌ও। তাহলে তো গোলমাল অন্য জায়গায়।’‌
বসন্ত সাহা বললেন, ‘‌হতে পারে।’‌

আরও পড়ুন, দেবেশ রায়ের স্মৃতিকথন মনে পড়ে কী পড়ে না

অনুকূলবাবুর একটা কেসের কথা মনে পড়ে গেল। ল্যান্সডাউনের এক বাড়িতে এক বৃদ্ধের মৃত্যু হয়েছিল। বৃদ্ধ একা ছিলেন। মৃতদেহ বেশ কয়েকদিন ঘরে বন্ধ অবস্থায় ছিল। দুর্গন্ধ পেয়ে প্রতিবেশীরা থানায ফোন করল। পুরনো কলকাতায়, একতলার গলির পাশের ঘর। পুলিশ গিয়ে দরজা ভাঙে। দেখা গেল, ভদ্রলোক নিজের ঘরে বিছানায় মৃত অবস্থায় পড়ে র‌য়েছেন। শরীরে পচন না ধরলে কে বলবে মারা গিয়েছেন?‌ মনে হবে ঘুমোচ্ছেন। ঘরের একটা জানলার খোলা। ভাল করে তল্লাসি চালাতে গিয়ে পুলিশ দেখতে পেল, মৃতের খাটের একপাশে দেয়ালে গুলির দাগ। একটা গুলি দেয়ালে গেঁথে রয়েছে। দেশি রিভলভারের গুলি। অথচ মৃত মানুষের শরীরে আঘাতের কোনও চিহ্ন নেই। পুলিস খুনের মামলা রুজু করল। ফরেনসিক এক্সপার্ট হিসেবে অনুকূলবাবুকেও তদন্তে ডেকে নিল। তবে সকলেই পড়ল অথৈ জলে। স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে, ঘরে কেউ ঢুকেছিল, রিভলভার থেকে গুলিও চালিয়েছে, কিন্ত সেই গুলিতে বৃদ্ধ মারা যাননি। তাহলে?‌

পোস্টেমর্টেম রিপোর্টে জানা গেল, মৃত্যুর কারণ গুলি বা অন্য কোনও আঘাত নয়। মৃত্যুর কারণ আচমকা হার্ট অ্যাটাক। তাহলে গুলি ছুঁড়ল কে?‌ ছুঁড়লই যদি গায়ে লাগল না কেন?‌ জানলা থেকে খাটের দূরত্ব কিছুই নয়। টার্গেট মিস করবার কোনও কারণ নেই। যে গুলি চালাতে এসেছিল, সে  নিশ্চয় এতটা আনাড়ি নয়। এই তদন্ত অনুকূলবাবুর আওতায় পড়ে না। তিনি পুলিশকে শুধু বলেছিলেন। গুলির ভুল নিশানা দেখে মনে হচ্ছে, ইটস্‌  মার্ডার কেস। কিন্তু  মার্ডারের ধরন আলাদা। পুলিশ জানতে চাইল, কী ধরন?‌‌ অনুকূলবাবু বলেছিলেন, ‘‌সেটা জানি না। তবে ইনভেস্টিউগেশন বন্ধ করবেন না।’‌

কয়েকমাস পরে মৃতের এক দূর সম্পর্কের ভাগ্নেকে পাকড়াও করল পুলিশ। একবারে অন্য মামলায়। অস্ত্র চোরাচালান। সেই লোককে জেরা করতে বৃদ্ধের মৃত্যু রহস্য স্পষ্ট হল। নিঃসঙ্গ মামার হার্টের অসুখের খবর জানত এই ভাগ্নে। এও জানত, ডাক্তার কোনওরকম উত্তেজনা করতে নিষেধ করছে। হঠাৎ কোনও উত্তেজনা হলে বা ভয় পেলে বড় বিপদ কিছু হয়ে যেতে পারে। ভাগ্নে ভেবেছিল জানলা থেকে ভয় দেখিয়ে মামার হার্টফেল করিয়ে দেবে। তারপর একমাত্র ওয়ারিশন হিসেবে মামার সম্পত্তির মালিক হবে। জানলার ওপাশে কালো কাপড় ঢাকে ভাগ্নেকে দেখে মামা মাঝরাতে ভয় পেয়েছিলেন ঠিকই, কিন্তু ভাগ্নে বুঝতে পারেনি তাড়াহুড়োয় তার হাত দিযে রিভলভারের গুলি ছিটকে যাবে। ওই গুলিতে অনুকূলবাবু সন্দেহ হয়। ফলে কজ অব ডেথ অন্য হলেও, ইনটেশনটা হত্যাই ছিল।

বসন্ত সাহা আগেই নিজের পরিচয় নার্সিংহোমে বলে রেখেছিলেন। লোকাল থানা থেকে পুলিশও চলে এসেছে। ডাক্তারবাবু এসে প্রথমেই মৃত সুনন্দকে পরীক্ষা করলেন। পোস্টমের্টেমের জন্য পাঠাতে বলে নিজের ঘরে এসে বসন্ত রায়কে ডেকে নিলেন।
‘‌প্রাথমিক ভাবে আপনার কী মনে হচ্ছে ডাক্তারবাবু?‌’‌

‘‌এখনও ক্লিয়ার নয়। পয়জন থেকে হার্ট ফেল?‌ নাকি স্ট্রেস না নিতে পেরে হার্টফেল?‌ এখনই বলতে পারছি না।’‌
বসন্ত ‌সাহা বললেন, ‘‌পয়জন হলে কী ধরনের পয়েজন হতে পারে বলে আপনার ধারণা ডক্টর?‌’‌
ডাক্তারবাবু বললেন, ‘‌সেটাও পোস্টমর্টেমে জানা যাবে। তবে কী জানেন, অনেক সময় খাবারের কোন খারাপ অংশ আমাদের পাকস্থলীতে গিয়ে বিভিন্ন ধরনের এনজাইমের সঙ্গে মিশে বিষের মতো অ্যাক্ট করতে থাকে।’‌

বসন্ত ‌সাহা একটু চুপ করে থেকে বললেন, ‘পোস্টমর্টেম রিপোর্ট কখনও পাওয়া যাবে?‌’‌
‌ডাক্তারবাবু সামান্য হেসে বললেন,‘‌আপনারা বললে তাড়াতাড়ি হযে যাবে। আপনি কি কিছু সন্দেহগ করছেন মিস্টার সাহা?‌’‌
বসন্ত ‌সাহা অন্যমনস্ক ভাবে বললেন, ‘না ঠিক সন্দেহ করছি এমন নয়, তবে কৌতূহল হচ্ছে। আসলে কী জানেন কাল একটা ছোটো পার্টি ছিল। আপনি জানেন নিশ্চয়। সেখানে আমিও উপস্থিত ছিলাম। সামন্য খাওয়া দাওয়া শুরু হয়েছিল। যেমন সব পার্টিতে হয়ে থাকে, এই ধরুন একটু স্টার্টার, তারপর কেক কাটা হল, সকলেই ছোটবড় টুকরো মুখে দিলাম। তারপরেই সুনন্দ অসুস্থ হয়ে পড়ল। বমি করল, বলল, শরীরে বার্নিং সেনশন হচ্ছে.‌.‌.‌ডক্টর এই অসুস্থতার কারণ যদি ওখানকার কোনও ফুড হয়, তাহলে তো সকলেরই হওয়া উচিত ছিল। সেই জন্যই কেমন একটা খটকা লাগছে। তবে কী খাবার নয়, অল্য কিছু?‌’‌

‌ডাক্তারবাবু বললেন,‌ ‘‌হতে পারে। একটু অপেক্ষা করতে হবে।’‌
ডাক্তারবাবুর ঘর থেকে বেরিয়ে আসতেই অনুকূল রায় এগিয়ে এলেন।
‘‌কিছু জানতে পারলেন?‌’‌
বসন্ত সাহা ঠোঁটের কোণে হেসে বললেন, ‘‌এখনই কী জানতে পারব?‌’‌
অনুকূলবাবু একটু চুপ করে থেকে গলা নামিয়ে বললেন, ‘আপনাকে একটা কথা বলবার ছিল।’‌
বসন্ত সাহা বললেন, ‘‌বলুন।’
অনুকূলবাবু আরও এক পা এগিয়ে এসে বললেন, ‘‌মিস্টার সাহা কাল সুনন্দ বমি করবার পর আমি একধরনের মিষ্টি গন্ধ পেয়েছিলাম। সুইট স্মেল। বমির রঙটাও ছিল কফি কালারের।’‌
বসন্ত সাহা ভুরু কুঁচকে বললেন, ‘তার মানে?’

‌অনুকূলবাবু চিন্তিত ভঙ্গিতে বললেন, ‘‌তখন অত খেয়াল করিনি। ভেবেছিলাম কেকের সেন্ট। কেকের কালার। হয়তো সেটাই ঠিক। কিন্ত এই গন্ধটা আমি জানি। রঙটাও। সালফিউরিক অ্যাসিড, হাইড্রোক্লোরিক অ্যাসিড, অ্যামোনিয়া ধরনের কিছু শরীরে ঢুকলে, এই ধরনের গন্ধ পাওয়া যায়। আপনি তো জানেন একজন ফরেনসিকের কর্মী হিসেবে এই ধরনের কাজ আমাকে করতে হয়। সেদিনও আমাকে এরকম একটা স্মেল ডিটেকশনে আমাকে পুলিশই ডেকেছিল। যদিও রিটায়ারমেন্টের পর আমি কাজ করতে চাই না। তারপরেও ডাকলেও না গিয়ে পারা যায়। সেদিন গিয়ে দেখি মৃতের ঘরে কাঁচা পেঁয়াজের গন্ধ। নিরামিশাষী মানুষের ঘরে পেঁয়াজ কোথা থেকে আসবে?‌ আমি বুঝতে পেরেছিলাম, যে পয়জন দিয়ে খুনটা হয়েছে, তাতে ফসফরাস ছিল।’‌

বসন্ত সাহা স্থির চোখে, চাপা গলায় বললেন, ‘‌আপনি কি বলতে চাইছেন, সুনন্দর মৃত্যুর পিছনে কোনও কড়া অ্যাসিডের ভূমিকা রয়েছে?‌’‌
অনুকূলবাবু চোয়াল শক্ত করে বললেন, ‘‌আমার ভুলও হতে পারে।’‌
পায়ের আওয়াজে বসন্ত সাহা মুখ ফেরালেন। করিডোর ধরে ছন্দা প্রায় ছুটে আসছেন।
‘‌কী হল!‌’‌
ছন্দা স্বামীর কাছে এসে হাঁপাতে হাঁপাতে বললেন, ‘‌আর একজন.‌.‌.‌আর একজন মারা গেছে.‌.‌.‌।’‌

এই ধারাবাহিক গোয়েন্দা উপন্যাসের সব পর্ব এক সঙ্গে পড়তে ক্লিক করুন এই লিংকে
—————

Anabrito
Advertisment