বসন্ত সাহা বারান্দায় বসে রয়েছেন।
আজ বাড়ি ফিরতে রাত হয়েছে। এদিকটায় বাড়িঘর কম, তাই বাইরের অন্ধকার এখনও দূষণহীন, নির্মল। শহরের মাত্রতিরিক্ত আলো দূষণ ছাড়া আর কী? শুধু মানুষের পক্ষে পীড়াদায়ক নয়, গাছে, পথের ধারে, পার্কের ভিতরে তীব্র আলো থাকলে পশুপাখি, কীটপতঙ্গের জন্যও তা কষ্টের। বসন্ত সাহা অনেকদিন ভেবেছেন, এই বিষয় আবেদন করে একটি চিঠি লিখবেন।
গোয়ান্দা অফিসার বসে রয়েছেন ইজি চেয়ারে। বেতের ইজি চেয়ার। খুবই আরামের এই চেয়ার ছন্দা কিনেছেন কলকাতার হ্যান্ডিক্রাফট মেলা থেকে। ছন্দা প্রতি বছরই এই মেলাতে গিয়ে আপ্লুত হয়ে পড়েন এবং প্রচুর জিনিস কিনে নেন। সব যে প্রয়োজনের এমন নয়। বছর জুড়ে তার সব গিফট আইটেমই এই মেলা থেকে নেওয়া। অ্যানিভারসরি, জন্মদিন, দোল, পয়লা বৈশাখ সব ধরনের অকেশনেই এখানকার জিনিস নিয়ে যান। এটাই রেওয়াজ করে নিয়েছেন। মাটি, কাঠে, বেত, কাপড়ে তিনি স্বচ্ছন্দ। স্কুলে গিয়ে কলিগদের এইসব মেলায় গিয়ে কেনাকাটা করবার জন্য উৎসাহ দেন। গ্রামের গরিব মানুষের শিল্পকর্ম দেখে গোয়েন্দা ঘরণী এতটাই মুগ্ধ হন যে নিজেকে সামলাতে পারেন না। সবথেকে বড় কথা, হ্যান্ডিক্রাফট মেলায় গিয়ে ছন্দা দেখেছেন, পুরুষের থেকে মহিলারা কাজ বেশি করছে। আঁকা, বোনা, সেলাই, খোদাই নিয়ে বসে রয়েছে। ছোটো ছোটো মেয়েরা যেভাবে রঙ–তুলি ধরে আঁকছে, পুতুল বানাচ্ছে দেখে অবাক হতে হয়। ক্যামেরা বাগিয়ে অনেকে দাঁড়িযে পড়ে। এই তো পরশুদিন স্বামীকে বলছিলেন। বসন্ত সাহা সেদিন সকালে স্নানে ঢোকবার আগে ছবির বই উলটোচ্ছিলেন। একটু ফাঁক পেলেই বই টেনে নেওয়ার অভ্যেস তাঁর অনেকদিনের।
ছন্দা বলল, ‘আবার ছবি! অফিস যাবে না?’
বসন্ত সাহা লজ্জা পেয়ে বললেন, ‘এই তো যাচ্ছি। এই বইটা খুব ভাল। বিশ্বশিল্পের রূপরেখা। লেখক ছবির কথা, বড় বড় শিল্পীর কথা খুব সহজ ভাবে লিখেছেন।’
ছন্দা খানিকটা অভিমানের গলাতেই বললেন, ‘সবাই বড় বড় আর্টিস্টদের নিয়ে লাফালাফি করে, আর গ্রামের হস্তশিল্পের কারিগররা সামান্য সম্মানটুকুও পান না। বড় আর্টিস্টদের কাজ, জীবন নিয়ে বই রয়েছে, এই সব আড়ালে থাকা আর্টিস্টদের কথা আমার কতটা জানতে পারি?’
বসন্ত সাহা হেসে বললেন, ‘সে কথা বোল না ছন্দা। বড় আর্টিস্টদের সঙ্গে এঁদের তুলনা চলে না। তাঁদের ছবি, ভাস্কর্য, ইনস্টলেশন এক একটা দর্শন। কল্পনার এক্সট্রিম প্রকাশ। মানুষের বোধ, শিল্পচেতনাকে তারা প্রভাবিত করে। বাজারের জন্য তাঁরা কাজ করেননি। পরবর্তী কালে বাজার তাকে ব্যবহার করেছে। আর তুমি যে ধরনের লোকাল আর্ট ওয়ার্কের কথা বলছো ছন্দা, তার বেশিটাই এলাকাভিত্তিক এবং স্কিল নির্ভর। ধর পুরুলিয়ার মুখোশ, বাঁকুড়ার ঘোড়া। বংশপরম্পরায় এই শিল্প রয়ে গিয়েছে। যাঁরা এই কাজ করছেন তাঁদের আমি কোনওভাবেই ছোটো করছি না। এঁরাও এক একজন গুণী। শিল্পগুণ না থাকলে, এই স্কিল রপ্ত করা যায় না। আমি এঁদের শিল্পী হিসেবে সম্মান জানাই। আগের থেকে এখন এরা অনেক বেশি নজরে এসেছেন। গোটা পৃথিবী জুড়েই এসেছে। এই তো এত মেলা হচ্ছে, একজিবিশন হচ্ছে, তোমরা গিয়ে কেনাকাটা করছো। পার্মানেন্ট দোকানও রয়েছে।’
আরও পড়ুন, দেবেশ রায়ের স্মৃতি-সত্তা থেকে তুলে আনা কলাম মনে পড়ে কী পড়ে না
ছন্দা বললেন, ‘এটুকুই কি এনাফ?’
বসন্ত সাহা বললেন, ‘না এনাফ নয়, আরও হলে আরও ভাল হত। এধরনের আর্ট ওয়ার্ক দেখতে দেখতে সেন্স ডেভেলপ করে। আমি তোমারে সঙ্গে একমত ছন্দা যতটা পাওয়া উচিত ছিল, এরা ততটা পায় না।’
ছন্দা বললেন, ‘আমি মেলায় দেখেছি, এক একজন ক্রেতা দু–পাঁচ টাকা কমানোর জন্য যা দরদাম করে দেখলেও লজ্জা লাগে। অথচ বেড়াতে গিয়ে, হোটেলে খেয়ে, গাড়িতে ঘুরে হাজার হাজার টাকা খরচ করে বসতে তাদের কোনও সমস্যা নেই। যত সমস্যা ওই দশ টাকায়।’
বসন্ত সাহা বললেন, ‘সে আর কী করবে, সবার কি মাইন্ড সেট একরকম? সবাই শিল্প আর শিল্পীকে বুঝতে পারলে দুনিয়া চলত? এই ধর না, সুনন্দ আর মেহুলের হত্যা রহস্যের মধ্যে কোথাও একটা শিল্প লুকিয়ে রয়েছে, অথচ আমি ধরতে পারছি না।’
ছন্দা অবাক হয়ে বললেন, ‘হত্যা রহস্যে শিল্প? মানে কী?’
বসন্ত সাহা আপনমনে বললেন, ‘সেই মানেটাই তো খুঁজছি ছন্দা।’
ছন্দা উৎসাহ নিয়ে বললেন, ‘কী করে জানলে?’
বসন্ত সাহা বললেন, ‘মুকুরের সিক্রেট ডায়েরি পড়তে গিয়ে পেয়েছি।’
ছন্দা অবাক হয়ে বললেন, ‘ছবি! মুকুর আবার ছবি নিয়ে ইন্টারেস্টেড হল নাকি?’
বসন্ত সাহা বললেন, ‘না তা নয়। ও হয়নি। ও ডায়েরিতে এক জায়গায় লিখেছে।’
ছন্দা বললেন, ‘কী লিখেছে?’
বসন্ত সাহা এবার হেসে বললেন, ‘পুলিশের সিক্রেট বলা যায়? ইনভেস্টিগেশন চলেছে না?’
ছন্দা বললেন, ‘সরি।’
ছন্দা তাঁর স্বামীকে জানেন। প্রফেশনাল গোপনীয়তা ভাঙবার মানুষ তিনি নন। তিনি উৎসাহও দেখান না। নেহাত এই ভয়ংকর ঘটনার সঙ্গে মুকুর জড়িত তাই।
বসন্ত সাহা স্ত্রীর কাছে গোপন করলেও, সিক্রেট ডায়েরিতে লেখা মুকুরের কতাগুলো নিয়ে তিনি ভেবেই চলেছেন। মুকুরের ছেঁড়া ছেঁড়া লেখাটা এরকম—
‘যে ছবি টবি নিয়ে থাকছে তাকেই নামকরণের জন্য বলব ঠিক করেছি... একটা আর্টিস্টিক কিছু নাম ভেবে ঠিক করবে। ওকে টেলিফোনে বললামও। বলল, বাড়িতে নাকি আর্টস্ট ডেকে ছবি আঁকাচ্ছে... খ্যাপা একটা...সেদিন আবার বলে, হ্যাঁরে মুকুর, স্বামীকে বেঁধে রাখবার উপায় কী? জানিস কিছু? সব প্রপার্টি নিজের নামে করে রাখা? বাড়ি, গাড়ি ব্যাঙ্ক ব্যালান্স...বোঝো ঠেলা! আমি বললাম, জানিনে বাপু। তখন বলল, টাকা পয়সা গোছানোর ব্যাপারে তোর অ্যারেঞ্জমেন্ট কী? বললাম, আমি এসব নিয়ে মাথা ঘামাই না। সব সুনন্দ জানে। যেখানে সই করতে বলে করে দিই। মনে হচ্ছে, এই খ্যাপা মেয়ে আবার বিয়ে করবে।’
আরও পড়ুন, সন্মাত্রানন্দের কলাম ধুলামাটির বাউল
ব্যস্ এইটুকুই লেখা। কীসের নামকরণ, কে ছবি নিয়ে থাকছে সেসব কিছুই লেখেনি। মেয়েটি স্বামীকে বেঁধে রাখবার কথা বলছে কেন ? সম্পত্তির প্রশ্নই বা আসছে কোথা থেকে? এই লেখা কি কোনওভাবে হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত? না হলেও ইন্টারেস্টিং। মেয়েটি কে এবং সে মুকুরের পার্টিতে এসেছিল কিনা জানতে মন চাইছে। হয়তো বিষয়টা কিছুই নয়। একেবারে বাইরের কিছু। তারপরেও অকারণে মাথায় খচখচ করছে। ছবির প্রসঙ্গ আছে বলেই হয়তো করছে।
বসন্ত সাহা ভেবেছিলেন, মুকুরকে জিগ্যেস করবেন। সাগ্নিক বারণ করল।
‘স্যার মুকুরদেবীকে আমরা সন্দেহের তালিকা থেকে বাদ দিয়েছি ঠিকই, কিন্তু উনি তো জানেন না অপরাধী কে বা কারা। আমাদের এই সব প্রশ্ন মুখ ফসকে বেরিয়ে গেলে তদন্তের অসুবিধে হবে?’
বসন্ত সাহা বললেন, ‘দ্যাটস ট্রু। কিন্তু এই মনের অবস্থা নিয়ে মুকুর কি কারও সঙ্গে যোগাযোগ করবে? এতো ডিটেইলসে কথা বলব এখন?’
সাগ্নিক বলল, ‘উনি হয়তো ভেবে বলবেন না। এখন তো এলোমেলো হয়ে রয়েছেন। ভেবে কথা বলবেন না। আমার বেলায় স্যার এরকম কয়েকবার হয়েছে। সে অবশ্য চাকরি পাবার গোড়ার দিকে। একটা রবারির কেসে গিয়ে যাকে যে কথাই জিগ্যেস করেছি, সবাইকে বলে বেড়িয়েছে। টিপার যে ছিল, ডাকাতদের খোঁজখবর দিত, সে এই সব শুনে বুঝে গেল, আমি ডাকাতদের নিয়ে ইনভেস্টিগেশন করছি না, যে খবর দিয়ে তাদের ডেকে এনেছে তাকে খুঁজছি, সে পালাল। সেই থেকে আমি অ্যালার্ট থাকি স্যার। তার থেকে খানিকটা জানবার পর জিগ্যেস করাটা ঠিক হবে মনে হয়।’
বসন্ত সাহা মেনে নিয়েছেন। তবে আর দেরি করা যাবে না। যা করবার দ্রুত করতে হবে। সময় কমে আসছে। গেস্টদের সবাইকে কলকাতায় আটকে রাখা হয়েছে। এটা বেশিদিন করা যায় না। কাউকে ডিটেন করতে কোর্টের পারমিশন লাগে। এরা কেউ কোর্টে চলে গেলে মুশকিল।
বারান্দার আলো নেভানো। বসন্ত সাহা চোখ বুঁজে রয়েছেন। ঘটনাটা দেখবার চেষ্টা করছেন। কখনও সামনে অস্পষ্ট ফুটে উঠছে, কখনও মিলিয়ে যাচ্ছে।
ইতিমধ্যেই সকলকেই কমবেশি এক রাউন্ড জিজ্ঞাসাবাদ হয়ে গিয়েছে। পনেরোজনের মধ্যে সুনন্দ, মেহুল আর নেই। এছাড়া বাদ গিয়েছে বসন্ত সাহা নিজে এবং ছন্দা। ধরা হয়নি অনুকূলবাবু আর তাঁর স্ত্রীকে। মুকুরকে প্রথমে সন্দেহ করলেও পরে লিস্টের বাইরেই রাখা হয়েছে। তাহলে বাকি রইল, চার কাপল। পলাশ–কঙ্কণা, উজ্জ্বল– নয়নিকা, প্রতীক–মন্দার, দিশা–কিশোর। আর মেহুলের সেপারেশনে থাকা স্বামী তন্ময়। মোট ন’জন।
আজ দুপুরে সাগ্নিক বলেছিল, ‘স্যার মেহুল নামের মেয়েটি খুন করবার পর সুসাইড করতে পারে না? নিজে বাড়ি গিয়ে হয়তো বিষ খেয়েছে।’
বসন্ত সাহা মুখ তুলে তাকালেন। ধীরে ধীরে বললেন, ‘মোটিভ?’
সাগ্নিক একটু চুপ করে থেকে বলল, ‘হতে পারে বিট্রে। হতে পারে, পুরোনো কোন রাগ।’
বসন্ত সাহা নিজের মনে বললেন, ‘তাহলে তো রহস্য ভেদ হয়ে গেল।’
——————
এই উপন্যাসের সব পর্ব একসঙ্গে পাওয়া যাবে এই লিংকে